প্রকাশনার ১৬ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

৮ই ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
২৩শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
১৭ই জমাদিউস সানি, ১৪৪৭ হিজরি

বোতলজাত ৬ টাকার পানি বিক্রি হয় ২০ টাকায়

editor
প্রকাশিত নভেম্বর ১১, ২০২৪, ০৩:০৭ অপরাহ্ণ
বোতলজাত ৬ টাকার পানি বিক্রি হয় ২০ টাকায়

Manual7 Ad Code

 

প্রজন্ম ডেস্ক:

বোতলের পানি এখন দেশের কোটি কোটি মানুষের ভরসা। বাড়িতে পরিবারের জন্য ব্যবহার ছাড়াও হোটেল-রেস্তোরাঁ, উৎসব, সরকারি-বেসরকারি অনুষ্ঠান—সর্বত্র ব্যবহৃত হয় বোতলের পানি। দিনে দিনে এই পানি হয়ে উঠেছে দৈনন্দিন জীবনের অপরিহার্য অনুষঙ্গ। ভোক্তাস্বার্থের পক্ষে কাজ করা সংগঠনগুলোর অভিযোগ, এই নির্ভরশীলতার সুযোগ নিয়ে কোম্পানিগুলো উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির তুলনায় অযৌক্তিকভাবে পণ্যের দাম বাড়িয়েছে। অনুসন্ধান বলছে, বাজার দখলে রাখতে পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতাদের বড় মুনাফা দেওয়া চড়া দামের বড় কারণ।

গত শতকের নব্বইয়ের দশকে দেশে বোতলে পানির ব্যবহার শুরু হয়। শুরুর দিকে এই পানি কিনে খাওয়া প্রায় বিলাসিতা মনে হলেও গত সাড়ে তিন দশকে জীবনযাপনের প্রায় সাধারণ অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে এটি। ক্রমেই বেড়েছে বাজার। প্রতিযোগিতা কমিশনের পর্যালোচনা অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশে এই পানি বিক্রি হয়েছিল ৫৫ কোটি ২৪ লাখ ৫৯ হাজার লিটারের বেশি। আর ২০২২-২৩ অর্থবছরের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত (যে পর্যন্ত তথ্য পাওয়া গেছে) বিক্রি হয়েছে প্রায় ৪০ কোটি লিটার।

Manual7 Ad Code

 

একলাফে বড় মূল্যবৃদ্ধি

শীর্ষস্থানীয় কোম্পানিগুলো ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ে আধা লিটার পানির বোতলের দাম একবারে ১৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২০ টাকা নির্ধারণ করে। গত সেপ্টেম্বর মাসে প্রতিযোগিতা কমিশনের তৈরি করা ‘বোতলজাত পানির অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিবিষয়ক অনুসন্ধান প্রতিবেদনে’ এ তথ্য রয়েছে। এতে কোম্পানিভেদে মুনাফা বেড়ে যায় ৭১ দশমিক ২৩ থেকে ৪২০ শতাংশ পর্যন্ত। অনেক বেড়ে যায় ডিস্ট্রিবিউটর ও খুচরা বিক্রেতাদের লাভের অংশও। ফলে ৫০০ মিলির এক বোতল পানির উৎপাদন খরচ ৬-৭ টাকা হলেও ক্রেতাকে তা কিনতে হচ্ছে ২০ টাকায়। অনেকের অভিযোগ, ৭-৮টি কোম্পানি বাজারের ওপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে খুচরা ও পাইকারি বিক্রেতাদের মুনাফা অস্বাভাবিক হারে বাড়িয়েছে। দাম বাড়ার কারণ হিসেবে ডলারের দাম ও কাঁচামালের আমদানি খরচ বৃদ্ধিকে দায়ী করেছিল কোম্পানিগুলো। তবে বিশ্লেষণ করে সরকারের প্রতিযোগিতা কমিশন দেখতে পায়, সার্বিকভাবে উৎপাদন খরচ বেড়েছে নামমাত্র।

প্রতিযোগিতা কমিশন তাদের অনুসন্ধানে ঢাকা ওয়াসাসহ (ব্র্যান্ড নাম শান্তি) মোট ৮ কোম্পানির উৎপাদন খরচ বিশ্লেষণ করে। এতে যোগসাজশ করে দাম বাড়ার প্রাথমিক প্রমাণ পাওয়া যায়। ওয়াসা ছাড়া বাকি ৭টি কোম্পানির বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এগুলো হলো কোকা-কোলা বাংলাদেশ বেভারেজ লিমিটেড (কিনলে), ট্রান্সকম বেভারেজেস (অ্যাকুয়াফিনা), মেঘনা বেভারেজ (সুপার ফ্রেশ), পারটেক্স বেভারেজ (মাম), সিটি গ্রুপ (জীবন), আকিজ ফুড অ্যান্ড বেভারেজ (স্পা) এবং প্রাণ বেভারেজ লিমিটেড (প্রাণ)।

প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, উৎপাদন খরচ আর খুচরা দামের মাঝখানের ১৩-১৪ টাকা উৎপাদনকারী, ডিস্ট্রিবিউটর এবং পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতার মধ্যে ভাগ হচ্ছে। মুনাফার ভাগ সবচেয়ে বেশি খুচরা বিক্রেতার। তথ্যমতে, উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির তুলনায় ডিস্ট্রিবিউটর ও পাইকারি ব্যবসায়ীর মুনাফা বেড়েছে ১ দশমিক ৩৫ গুণ। খুচরা বিক্রেতার ক্ষেত্রে তা বেড়েছে ৪ দশমিক ৩৪ গুণ পর্যন্ত।

 

মামলার অগ্রগতি থমকে

প্রতিযোগিতা কমিশন ৭টি কোম্পানির বিরুদ্ধে মামলা করলেও কমিশনের সদস্যদের কোরাম না থাকায় শুনানি স্থগিত রয়েছে। কমিশনের সদস্য হাফিজুর রহমান বলেন, ‘এ কমিশনে সাধারণত চারজন সদস্য থাকেন। চেয়ারম্যানসহ পাঁচজন সদস্য শুনানি গ্রহণ করেন। তবে শুনানির জন্য ন্যূনতম তিন সদস্যের কোরাম প্রয়োজন হয়। কিন্তু বর্তমানে আমরা সদস্য রয়েছি মাত্র দুজন। আমাকে আবার এফবিসিসিআইয়ের নির্বাচনের জন্য প্রশাসকও নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।’

বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের অনুসন্ধানেও এই অনৈতিক মুনাফার বিষয়টি প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি কোম্পানি পানির দাম কিছুটা কমালেও সরকারের নমনীয়তায় কেউ কেউ আবার বাড়িয়ে দিয়েছে।

 

ক্রেতার ওপর বোঝা বাড়ছে

সেগুনবাগিচা বাজারে বোতলের পানি কেনার সময় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তার সঙ্গে এ প্রতিবেদকের কথা হয়। নাম না প্রকাশের অনুরোধ করে তিনি বলেন, ‘বোতলের পানির দাম বেশির ভাগ সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি বাজারের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণহীনতারই প্রমাণ।’

পূর্ব রায়েরবাজার এলাকার বাসিন্দা একটি তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের কর্মী আকিব সিদ্দিকী বলেন, তাঁদের যৌথ পরিবারের শিশুরা সরবরাহের পানি পান করতে চায় না। ফিল্টার নিয়ে ঝামেলা হওয়ায় পরিবারটি এখন শুধু বোতলের পানি পান করে। স্বাস্থ্যগত দিকের কথা ভেবে তাঁরা পানির পেছনে এই বাড়তি ব্যয় করেন। এর দাম বেড়ে যাওয়ায় খুব চাপে আছেন।

 

উৎপাদন খরচ আর বিক্রির দাম

প্রতিবেদন অনুযায়ী জীবন ব্র্যান্ডের আধা লিটারের (৫০০ এমএল) এক বোতল পানির উৎপাদন খরচ ৬ দশমিক ৫৯ টাকা, কিনলের ৬ দশমিক ৯২ টাকা, অ্যাকুয়াফিনার প্রায় ৬ টাকা, সুপার ফ্রেশের ৫ দশমিক ৯২ টাকা, স্পার ৬ দশমিক ৩০ টাকা এবং ওয়াসার শান্তির ৬ দশমিক ২৯ টাকা। এগুলোর মধ্যে ব্যতিক্রম পারটেক্সের মাম। কোম্পানিটির তথ্য অনুসারে তাদের ৫০০ এমএল বোতল পানির উৎপাদন খরচ ৯ দশমিক ৫৩ টাকা। গত বুধবার রাজধানীর কয়েকটি বাজার ঘুরে প্রাণ, শান্তি ও জীবন ছাড়া বাকি সব ব্র্যান্ডের পানির খুচরা মূল্য ২০ টাকা দেখা গেছে। এদিকে বাজারের বড় দোকানগুলোর কর্মীরা বলছেন, শীর্ষ ব্র্যান্ডগুলোর পানি পুরো এক কেস (২৪ বোতল) কিনলে তাঁরা ৩৫০-৩৬০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করতে পারেন। সে অনুযায়ী প্রতি ৫০০ এমএল বোতল ১৪ দশমিক ৬০ থেকে ১৫ টাকায় বিক্রি করলেও খুচরা বিক্রেতাদের কিছু মুনাফা থাকে।

Manual7 Ad Code

বাজারে কোন ব্র্যান্ডের কী অবস্থা

সরকারি প্রতিষ্ঠান বিএসটিআই বলছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরের হিসাবে দেশে বোতলের পানি উৎপাদন ও বাজারজাতকারী নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ২৩২। এগুলোর মধ্যে শীর্ষ ৭ কোম্পানির দখলেই বাজারের ৯৭ শতাংশ। ২০২২-২৩ অর্থবছরের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত হিসাব অনুযায়ী শীর্ষ ৭ ব্র্যান্ড ছিল ফ্রেশ (২৪ দশমিক ১৭ শতাংশ), প্রাণ (১৭ দশমিক ৭৬ শতাংশ) অ্যাকুয়াফিনা (১৬ দশমিক ৮৮ শতাংশ) মাম (১৬ দশমিক ৪৪ শতাংশ), স্পা (১৩ দশমিক ৮১ শতাংশ), কিনলে (৪ দশমিক ১৬ শতাংশ) ও জীবন (৪ শতাংশ)। ১ শতাংশের কিছু কম করে ব্যবসার ভাগ রয়েছে মুক্তা, সেনা, মুসকান ও শান্তি—এই চারটির।

Manual4 Ad Code

বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, মূলত আধিপত্য ধরে রাখতেই খুচরা বিক্রেতাদের মুনাফা অস্বাভাবিক হারে বাড়িয়েছে শীর্ষ কোম্পানিগুলো। দাম বাড়ার আগে আকিজের আধা লিটার পানি বিক্রি করেই খুচরা বিক্রেতা লাভ পেতেন ৫ দশমিক ৬২ টাকা। দাম বাড়ার পর তা হয়েছে ৯ টাকা। কিনলের সমান পরিমাণ পানির বোতল ১৫ টাকায় বিক্রি করে খুচরা বিক্রেতা আগে ৬ দশমিক ৬৭ টাকা মুনাফা করতেন, দাম বাড়ানোর পর তা থেকে মুনাফা করছেন ৮ দশমিক ৪৭ টাকা।

Manual3 Ad Code

 

কোম্পানিগুলো যা বলছে

পারটেক্স গ্রুপের সহকারী মহাব্যবস্থাপক মো. নাহিদ ইউসুফ বলেন, ‘আমাদের আগে আরও দু-একটি কোম্পানি দাম বাড়িয়েছে। তাই বাজারকে ফলো করে আমরাও মাম পানির দাম বাড়িয়েছি।’

প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের জনসংযোগ বিভাগের উপব্যবস্থাপক তৌহিদুজ্জামান বলেন, ‘সবাই দাম যখন বাড়িয়েছিল, আমরাও বাড়িয়েছিলাম। কিন্তু সাধারণ মানুষের কথা চিন্তা করে এবং সরকারের নির্দেশনা মেনে আবার কমিয়েছি। এখন আমরা আগের দাম আধা লিটার ১৫ টাকা ও ১ লিটার ২৫ টাকায় বিক্রি করছি। যদিও এ কারণে বাজারে প্রতিযোগিতার মধ্যে পড়েছি। কারণ, খুচরা বিক্রেতা যেটা বিক্রি করে লাভ বেশি পাবে, সেটাই দোকানে রাখবে।’

মেঘনা গ্রুপের সহকারী মহাব্যবস্থাপক মুনতাসীর মামুন বলেন, ‘দাম তো সবাই বাড়িয়েছে। সবাই বাড়ালে আমাদেরও বাড়াতে হয়।’

 

প্রতিযোগিতা কমিশন পুনর্গঠনের তাগিদ

ভোক্তাস্বার্থ নিয়ে কাজ করা সংগঠন কনসাস কনজ্যুমারস সোসাইটির নির্বাহী পরিচালক পলাশ মাহমুদ বলেন, ‘এসব বিষয় দেখার সম্পূর্ণ দায়িত্ব প্রতিযোগিতা কমিশনের। এ কমিশনের নিষ্ক্রিয়তা ও ব্যর্থতার কারণে কোম্পানিগুলো এভাবে অযৌক্তিকভাবে দাম বাড়ানোর সাহস পায়। তাই কমিশনকে শক্তিশালী করা প্রয়োজন। এ জন্য দক্ষ লোকদের দিয়ে কমিশন পুনর্গঠন করা দরকার।’

Sharing is caring!

Manual1 Ad Code
Manual2 Ad Code