প্রকাশনার ১৬ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

৭ই ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
২২শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
১৬ই জমাদিউস সানি, ১৪৪৭ হিজরি

‘অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান’

editor
প্রকাশিত জুলাই ৯, ২০২৫, ০৬:২৮ পূর্বাহ্ণ
‘অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান’

Manual2 Ad Code

সম্পাদকীয় :
প্রতিটি সমাজ এক একটি বৃক্ষের মতো। শিকড়ের গভীরতম স্তরে, মাটির ছায়ায়, যাহা লুকাইয়া থাকে তাহা হইল-মানব-মর্যাদার বোধ। সেই মর্যাদাবোধের জায়গায় যখন অপমান ও পালটা অপমানের জিঘাংসা চলিতে থাকে, তখন সেই সমাজ-বৃক্ষটির শেকড় শুকাইয়া যাইতে থাকে। ইহা অপরিমেয় ক্ষতি। এই জন্য প্রায় সোয়া শত বৎসর পূর্বে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাহার গীতাঞ্জলি কাব্যে বলিয়াছে গিয়াছেন: ‘যাদের করেছ অপমান,/অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান!’ দুঃখজনকভাবে, আমাদের চারিপাশে আমরা দেখিতে পাই-প্রাচীন কাহিনির পুতুলনাট্যের মতোই পুনরাবৃত্ত ইতিহাস! কেবল মুখোশগুলি পালটায়, কিন্তু গভীরে কোনো পরিবর্তন নাই।

বহু শত বৎসর পূর্বে চীনা দার্শনিক কংফুসিয়াস বলিয়াছিলেন-‘অন্যের সম্মান বিনাশে সুখ খোঁজা আত্মবিনাশের নামান্তর।’ কিন্তু এক শ্রেণির মানুষ অন্যের সম্মান বিনাশের মধ্যেই আত্মসুখ খুঁজিয়া পায়। ইহা যে আত্মবিনাশের নামান্তর-তাহা ভুলিয়া যায়। ইহা যেন সেই রূপকথার রাজাদের গল্পের মতো-যাহারা একদিন ছিলেন রণবন্দি, কিন্তু সিংহাসনে আসীন হইবার পর তাহারাই রাজ্য জুড়িয়া অন্যদের অপদস্থ করিতে কেবল বন্দিশালা গড়িতে লাগিলেন। যাহারা জানিতেন-বন্দিত্ব যন্ত্রণাদায়ক, সেই তাহারাই আবার অন্যকে বন্দি করিতে লাগিলেন উল্লাসের সহিত। এইভাবে দেখা যায় এক বীভৎস ঘূর্ণিপাক। মহাভারতে দুর্যোধন যখন আত্মীয়দের অপমান করিয়া হটাইয়া অখণ্ড রাজ্য অর্জন করিলেন, তখন তাহার পিতা ধৃতরাষ্ট্র জিগ্যেস করিলেন- ‘এখন হইয়াছ সুখী?’ দুর্যোধন তখন দম্ভ ভরিয়া বলিয়াছেন- ‘সুখ চাহি নাই মহারাজ! জয়, জয় চেয়েছিনু, জয়ী আমি আজ।’

Manual5 Ad Code

এই যে অপমানের মধ্যে জয়ের আনন্দ, যাহা কখনো সুখ আনিতে পারে না। এই জন্য দেখা যায়, যুগে যুগে এই ধরনের শাসক যখন আসেন, তাহারা লইয়া আসেন ক্ষমতার অনিবার্য বিভ্রম, আর তাহার সহিত রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করাইতেছেন অপমানের বীজ। তাহার ফলে সেই সমাজে যেই গাছ জন্মায়, তাহা হইতেছে-বিভাজন, অহংকার, অপমান, হিংস্রতার এক ভয়ানক বিষবৃক্ষ। বস্তুতপক্ষে, মানুষে মানুষে সম্মানবোধই হইল সভ্যতার প্রকৃত সূচক। যে জাতি এই শিক্ষাকে হৃদয়ে ধারণ করে, সেই জাতিই প্রকৃত উন্নতির পথে যাত্রা করে। এই বিষয়টি চমৎকারভাবে উৎসারিত হইয়াছে বুখারি শরিফে। ইহার প্রথম খণ্ডে আত্মিক উন্নতি সম্পর্কে রসুলুল্লাহ (স.) বলিয়াছেন যে, ‘জানিয়া রাখিয়ো, শরীরের মধ্যে এমন একটি অংশ রহিয়াছে, তাহা যখন ঠিক হইয়া যায়, গোটা শরীর তখন ঠিক হইয়া যায়। আর তাহা যখন খারাপ হইয়া যায়, গোটা শরীর তখন খারাপ হইয়া যায়। জানিয়া রাখিয়ো-সেই অঙ্গটি হইল কলব।’ আরবি শব্দ ‘কলব’-এর আক্ষরিক অর্থ হইল-হৃদয় বা মন। ইহার দ্বারাই পরিচালিত হয় বিবেক। বিবেকের কর্তব্য হইল সদাচার, সততা, সত্যতা দ্বারা পরিচালিত হওয়া। বিবেকের উন্নয়ন হইল ‘উন্নত চিন্তা’- যেইখানে সংকীর্ণতার সকল সীমা অতিক্রম করিয়া সামনে আগুয়ান হইতে হইবে। থাকিবে বুদ্ধির মুক্তি। কারণ, সংকীর্ণতার মধ্যে কখনো উন্নত জীবনের জ্ঞানবৃক্ষ জন্মায় না।

আত্মিক এই সকল উন্নতির সহিত সরাসরি সম্পর্কিত বিষয়গুলির মধ্যে রহিয়াছে একটি ভূখণ্ডের সুশাসন, ন্যায়বিচার, মানবাধিকার, শিষ্টের পালন, দুষ্টের দমন, শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষা ইত্যাদি। এখন তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির এই সকল বিষয়ে কী অবস্থা বর্তমানে বিরাজ করিতেছে-তাহা নূতন করিয়া বলিবার অপেক্ষা রাখে না। আমরা পুনরায় রবীন্দ্রনাথের কবিতাংশ স্মরণ করিতে পারি। তিনি উপরিউক্ত কবিতার মাঝামাঝি অংশে বলিয়াছেন- ‘যারে তুমি নীচে ফেল সে তোমারে বাঁধিবে যে নীচে/পশ্চাতে রেখেছ যারে সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে।’

Manual7 Ad Code

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাহার সোয়া শত বৎসর পূর্বের কবিতার মর্মবার্তা দ্বারা তৃতীয় বিশ্বের মানুষদের যাহা বুঝাইয়া দিয়াছেন- আমরা এখনো সেইখানেই স্থির হইয়া রহিয়াছি। তবে, ইহাই শেষ কথা নহে। এইখানে আসিয়া মাইকেল মধুসূদনের মতো মৃদুকণ্ঠে দ্ব্যর্থহীন স্পর্ধায় আমরা বলিতে চাই, ‘দাঁড়াও পথিকবর, তিষ্ঠ ক্ষণকাল’- এইভাবে চলিবে না, এইভাবে চলিতে পারে না। সোয়া শত বৎসর পার হইয়া, হয়তো আরো কয়েক শত বৎসর পার হইবে সত্যিকারের ইতিবাচক পরিবর্তনের জন্য। কিন্তু পরিবর্তন একদিন আসিবেই।

Manual8 Ad Code

Sharing is caring!

Manual1 Ad Code
Manual3 Ad Code