প্রজন্ম ডেস্ক:
বৃষ্টির পর পুকুর-খাল-ডোবার পানিতে গোসল করা জনস্বাস্থ্যের জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। শুধু তা-ই নয়; থালা-বাটি, গ্লাস, হাঁড়ি-পাতিল, ফল এবং সবজি ধোয়ার ক্ষেত্রেও বিপদের আশঙ্কা থাকে। কারণ এই সময়ে পুকুরের পানিতে ই-কোলাই ব্যাকটেরিয়ার মাত্রা বৃদ্ধি পায়, যা পানিবাহিত রোগ এবং বিশেষত পেটের পীড়ার জন্য দায়ী। শুধু পুকুরের পানিতেই নয়, এই আবহাওয়ায় ঘরে সংরক্ষিত পানীয় জলে এবং খাবারেও ই-কোলাই ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা বেড়ে যায়। ঠিক একই চিত্র দেখা যায় তাপমাত্রা বৃদ্ধিতেও। এই দুই ধরনের আবহাওয়ায় অর্থাৎ ভারী বৃষ্টি কিংবা তাপমাত্রা বৃদ্ধির পর ডায়রিয়ার প্রাদুর্ভাবসহ পেটের পীড়ার রোগীর সংখ্যা বেড়ে যায়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব বিষয় সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করতে হবে। ভারী বৃষ্টির পর অন্তত দুই দিন না ফুটিয়ে পুকুর, নালা, খাল-বিলের পানি ব্যবহারে বিরত থাকা উচিত। এ ছাড়া সংরক্ষিত খাবার অবশ্যই গরম করে খেতে হবে। তাপমাত্রা বাড়লেও একই ধরনের সচেতনতা অবলম্বন করতে হবে। তাহলে ডায়রিয়াসহ পেটের বিভিন্ন পীড়া থেকে নিরাপদ থাকা যাবে। ডায়রিয়ায় আক্রান্তের সংখ্যা অনেক কমে যাবে।
সম্প্রতি চিকিৎসাবিষয়ক সাময়িকী ল্যানসেটে প্রকাশিত আইসিডিডিআরবির এক গবেষণার ফলে দেখা গেছে, ভারী বৃষ্টির কারণে সংরক্ষিত খাবার, পানীয় জল এবং পুকুরে ই-কোলাই ব্যাকটেরিয়ার মাত্রা বৃদ্ধি পায়। তবে নলকূপের পানি এবং উঠানের মাটিতে ই-কোলাই ব্যাকটেরিয়ার দূষণ কমে যায়। গবেষণাটিতে তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রভাবও বিশ্লেষণ করা হয়েছে এবং তাতে দেখা গেছে, তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে সংরক্ষিত খাবার এবং পানীয় জলে উল্লেখযোগ্য হারে ই-কোলাই ব্যাকটেরিয়ার পরিমাণ বৃদ্ধি পায়।
বাংলাদেশ বিশ্বের সপ্তম সর্বাধিক জলবায়ু-ঝুঁকিপূর্ণ দেশ। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে লবণাক্ত পানির অনুপ্রবেশ ও বন্যার ফলে পানি ও খাদ্যে নিরাপত্তাহীনতা দেখা দেওয়ার পাশাপাশি সংক্রামক রোগের ধরনেও পরিবর্তন ঘটছে। এ ছাড়া বর্ষা এবং বৃষ্টিপাত নিউমোনিয়া, ডায়রিয়া, আন্ত্রিক সংক্রমণসহ অন্যান্য সংক্রামক রোগের বৃদ্ধির সঙ্গে সম্পর্কিত। সে জন্য গ্রামীণ পরিবারগুলোতে রোগজীবাণু সংক্রমণের ক্ষেত্রে আবহাওয়া এবং মল দ্বারা সৃষ্ট দূষণের সম্পর্ক দেখতে আইসিডিডিআরবি এই গবেষণা পরিচালনা করেছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ অনুযায়ী, ঘরের তাপমাত্রায় ২ ঘণ্টা এবং পরিবেশের তাপমাত্রা ৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি হলে ১ ঘণ্টার বেশি সময় খাবার সংরক্ষণ করা উচিত নয়। এই গবেষণায় দেখা গেছে, ৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের তুলনায় ১ ঘণ্টা বা তার বেশি সময় ধরে সংরক্ষিত খাবারে ই-কোলাইয়ের মাত্রা ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সংরক্ষিত খাবারের তুলনায় দ্বিগুণ হয়ে যায়। প্রস্তুত করার পর ৪ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে সংরক্ষিত খাবারে ই-কোলাইয়ের উপস্থিতি উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়।
এই গবেষণাটি ২০১৩-এর জুলাই থেকে ২০১৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত গাজীপুর, ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ ও টাঙ্গাইল জেলায় পরিচালিত হয়। সাড়ে তিন বছরের গবেষণায় ৯টি ধাপে ২৬ হাজার ৬৫৯টি নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষা করা হয়। নমুনার মধ্যে ছিল সংরক্ষিত খাওয়ার পানি, অন্তঃসত্ত্বা মা ও পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের হাত ধোয়ার পানি, উৎস জল (টিউবওয়েল থেকে ভূগর্ভস্থ জল), মাটি, পুকুর ও মাছি।
আইসিডিডিআরবির হেলথ সিস্টেম অ্যান্ড পপুলেশন স্টাডিজ ডিভিশনের এনভায়রনমেন্টাল হেলথ অ্যান্ড ওয়াশ ইউনিটের প্রজেক্ট কোর্ডিনেটর ও সহযোগী বিজ্ঞানী ডা. মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, সংরক্ষিত পানির ৬ হাজার ৩৫০টি, সংরক্ষিত খাবারের ২ হাজার ১৮১টি, মায়েদের হাত ধোয়ার পানির ৫ হাজার ৩৯৭টি, শিশুদের হাত ধোয়ার পানির ৭ হাজার ৯২টি, উৎস জলের (টিউবওয়েলের পানি) ১ হাজার ৬৬৯টি, মাটির ২ হাজার ৫৩৮টি, পুকুরের পানির ৮২২টি এবং মাছির ৬১০টি নমুনা সংগ্রহ করে আইসিডিডিআরবির ল্যাবে পরীক্ষা করা হয়।
তিনি জানান, নমুনা সংগ্রহের সময়কাল ছিল অতিবৃষ্টির পর ১৪ দিন পর্যন্ত। পরীক্ষায় দেখা গেছে, সংরক্ষিত পানীয় জলে ই-কোলাই ব্যাকটেরিয়ার গড় পরিমাণ ছিল প্রতি ১০০ মিলিলিটারে ৭ দশমিক ৮ এমপিএন। খাবারে ছিল ৫ এমপিএন, মায়েদের দুই হাতে ২৯ দশমিক ৫ এমপিএন, শিশুদের দুই হাতে ২০ দশমিক ৫ এমপিএন, উৎস জলে শূন্য দশমকি ৯ এমপিএন, মাটিতে ১২৫ দশমিক শূন্য ৪৭ এমপিএন, পুকুরে ১০০ মিলি পানিতে ৫ হাজার ৩৯৭ এমপিএন এবং মাছিতে ৭১২ এমপিএন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ অনুযায়ী, প্রতি ১০০ মিলিলিটার পানিতে একটি ই-কোলাই ব্যাকটেরিয়া থাকলেই তা দূষিত বলে বিবেচনা করা হয়।
ডা. মো. মাহবুবুর রহমান আরও জানান, তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রভাব দেখতে ১৪ দিন পর্যন্ত নমুনা সংগ্রহ করা হয়। সংরক্ষণ করা যেসব খাবার থেকে নমুনা নেওয়া হয়েছে, সেসব খাবারের গড় সংরক্ষণকাল ছিল সাড়ে ৩ ঘণ্টা। ৪ ঘণ্টার কম সময় ধরে সংরক্ষণ করা খাবারে ই-কোলাই ছিল ১৫৭ এমপিএন, ৪ থেকে ৮ ঘণ্টার মধ্যে সংরক্ষণ করা খাবারে ৩৪৬ এমপিএন, ৮ ঘণ্টা বা তার বেশি সময় ধরে সংরক্ষণ করা খাবারে ২ হাজার ৪৬৭ এমপিএন। খাদ্য নমুনা গ্রহণের দিনগুলোতে তাপমাত্রা ছিল ১৬ দশমিক ৭ থেকে ৩৩ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
তিনি জানান, ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তার বেশি তাপমাত্রায় সংগৃহীত ১ হাজার ৯১০টি খাদ্য নমুনার মধ্যে ৮৪ শতাংশ ২ ঘণ্টা বা তার বেশি সময় ধরে সংরক্ষণ করা হয়েছিল। এই নমুনায় গড় ই-কোলাইয়ের স্তর ছিল ৬৪৫ এমপিএন, যেখানে একই পরিস্থিতিতে ২ ঘণ্টার কম সময় ধরে সংরক্ষণ করা নমুনায় ছিল ৪৬ এমপিএন। ৩২ ডিগ্রি বা তার বেশি তাপমাত্রার দিনে সংগৃহীত ছয়টি খাদ্য নমুনার মধ্যে ছয়টি ১ ঘণ্টা বা তার বেশি সময় ধরে সংরক্ষণ করা হয়েছিল। এই নমুনায় গড় ই-কোলাইয়ের স্তর ছিল ১ হাজার ২৯৭ এমপিএন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ই-কোলাই ব্যাকটেরিয়া দ্বারা অনিরাপদ এই খাবার ও পানীয় জল গ্রহণের কারণেই গরমের সময় ডায়রিয়ার প্রাদুর্ভাব বেড়ে যায়।
আইসিডিডিআরবির গবেষণাপত্রে দূষণ এড়াতে, ভারী বৃষ্টি বা তাপমাত্রা বৃদ্ধির পর প্রথম দুই দিন খাদ্য সংরক্ষণের সময়কাল কমানো, পানি পরিশোধন, পানীয় জল এবং প্রস্তুত খাবারের নিরাপদ সংরক্ষণ, সংরক্ষণ করা খাবার পর্যাপ্ত পরিমাণে পুনরায় গরম করার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।
ডা. মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘গরম করলে ব্যাকটেরিয়াগুলো মারা যাবে। কিন্তু গরম না করলে অনেক বেশি ঝুঁকি থাকে। যার ফলে ভারী বৃষ্টি ও তাপমাত্রা বৃদ্ধির সময় ডায়রিয়ার অনেক বেশি আউটব্রেক হয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘বৃষ্টিপাতের পর পরিবেশে থাকা ব্যাকটেরিয়াগুলো মাটিকে অনেক বেশি দূষিত করে তোলে। ভারী বৃষ্টিতে এই ব্যাকটেরিয়াগুলো ধুয়ে ভূপৃষ্ঠের জলাশয়ের মাধ্যমে চলে যায়। ফলে মাটিতে থাকা দূষণ বৃষ্টির পানির সঙ্গে প্রবাহিত হয়ে সেই স্থানে জমা হয়, যেখানে পানি জমতে পারে। তাই অতিবৃষ্টির পর গৃহস্থালির কাজের জন্য পুকুর এড়ানো, পুকুরে হাত-মুখ না ধোয়া, ভূপৃষ্ঠের কোনো জলাশয়ে গোসল বা সাঁতার কাটা এড়িয়ে চলা সংক্রমণ কমাতে সাহায্য করতে পারে। যেমন যুক্তরাষ্ট্রে বৃষ্টিপাতের তিন দিনের মধ্যে ভূপৃষ্ঠের জল ব্যবহার এড়াতে সুপারিশ করা হয়েছে।’
গোসল করলে সমস্যা কী জানতে চাইলে তিনি বলেন, পুকুরে গোসলে নামলে কোনো না কোনোভাবে পানি পেটে চলে যেতে পারে। পেটে যাওয়া পানিতে ব্যাকটেরিয়া থাকলে তা স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। এ ছাড়া থালা-বাসন, গ্লাস, ফল, সবজি যেগুলো রান্না করে খাওয়া হয় না, সেগুলো ধোয়া হলে তাতেও ই-কোলাই ব্যাকটেরিয়া লেগে থাকতে পারে। সে জন্য দুই-তিন দিন ওই পানি ব্যবহার না করার পরামর্শ দেন তিনি।
এ বিষয়ে মানুষকে সচেতন করতে বিভিন্নভাবে প্রচারের তাগিদ দিয়েছেন কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্টের সভাপতি ও স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশনের সদস্য ড. আবু মুহাম্মদ জাকির হোসেন।
তিনি বলেন, ‘পানি থেকে সরাসরি, আবার পানির মাধ্যমে খাবারে মিশে অনেক রোগ ছড়ায়। সে জন্য পানির ব্যবহার ঠিকমতো করতে হবে। পানি দিয়ে রান্না করা, হাত-মুখ ধোয়া, পান করা, গোসল করা, পুকুরে ডুব দেওয়া- সবই হচ্ছে পানি। যেকোনোভাবে মল পানিতে মিশলে সেই পানিই দূষিত হয়, তা পেটে যায়। মোদ্দা কথা, পানিতে যাতে মল ত্যাগ না হয় বা পানিতে যাতে মল না মেশে, সেই দিকে লক্ষ রাখতে হবে। কখন, কেন ডায়রিয়া হয় যদি মানুষ জানেন, তাহলে তারা সতর্ক থাকবেন। মসজিদে মাইকিং করে, রিকশার মাইকিংয়ের মাধ্যমে, কোনো ইভেন্ট হলে সেখানে জনগণকে অবহিত করে কিংবা সচেতনতার কর্মসূচি নিয়ে শুধু এই বিষয়ে নয়; রোগ প্রতিরোধের বিষয়ে সচেতন করা যেতে পারে।’
এদিকে গত মঙ্গলবার ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়েছে ইন্টারন্যাশনাল টয়লেট সম্মেলন ২০২৫। সেখানে জানানো হয়েছে, প্রতিদিন শুধু ঢাকাতেই আনুমানিক ২৩০ টন মানববর্জ্য উন্মুক্ত জলাশয়ে পড়ছে। এতে পরিবেশ দূষণ হচ্ছে এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, বিশেষ করে শিশুদের স্বাস্থ্য মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়ছে।
সম্পাদক মন্ডলীর সভাপতিঃ মোহাম্মদ আফছার খান সাদেক
সম্পাদক ও প্রকাশকঃ মিলাদ মোঃ জয়নুল ইসলাম
প্রকাশনালয়ঃ রিপোর্টার লজ, কসবা, বিয়ানীবাজার, সিলেট ।
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ উত্তর বাজার কেন্দ্রিয় মসজিদ মার্কেট (২য় তলা), বিয়ানীবাজার, সিলেট ।
মোবাঃ ০১৮১৯-৬৫৬০৭৭, ০১৭৩৮-১১ ৬৫ ১২
ইমেইলঃ agamiprojonma@gmail.com, milad.jaynul@gmail.com