প্রজন্ম ডেস্ক:
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর জাতীয় সংসদ ভবনের ভেতরে ঢুকে পড়েন হাজারো মানুষ। এ সময় তারা অধিবেশন কক্ষ, শপথ কক্ষ এবং স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার, চিফ হুইপ ও হুইপদের কক্ষসহ নয় তলা ভবনের প্রায় সব কক্ষ তছনছ করেন। অধিবেশন কক্ষের সাউন্ড সিস্টেমসহ এমপিদের বসার বেশ কিছু আসন ও টেবিল ভেঙে ফেলা হয়। কিন্তু সরকারের কোনো সিদ্ধান্ত না পাওয়ায় গত সাড়ে ৭ মাসেও এগুলো মেরামত করা হয়নি।
তবে আগামী ডিসেম্বর মাসে নির্বাচন হলে জানুয়ারি মাসে বসবে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশন। এ কারণে ডিসেম্বরের মধ্যে অধিবেশনসহ সংসদের সব কার্যক্রম যাতে নিরবচ্ছিন্নভাবে করা যায় সে লক্ষ্যে মেরামত ও ক্রয় কার্যক্রম জরুরি ভিত্তিতে শেষ করতে গণপূর্ত বিভাগকে নির্দেশনা দিয়েছে সংসদ সচিবালয়।
গত ১২ মার্চ সংসদ সচিব মো. মিজানুর রহমান মেরামতের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার তালিকা প্রস্তুত করে সে অনুযায়ী কাজ করার নির্দেশ দেন বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
সংসদ সচিবালয় সূত্র জানায়, আগামী ডিসেম্বরে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু ৫ আগস্ট তছনছ হওয়া সংসদ অধিবেশন কক্ষসহ সংসদ ভবনের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন কক্ষ এখনও মেরামত করা হয়নি। একাধিক কর্মকর্তা জানান, সংসদ ভবন ও সংসদের আবাসিক স্থাপনায় মোট ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১৫০ কোটি টাকা। এর মধ্যে সংসদ সচিবালয়ের নিজস্ব খাতের ক্ষতি হয়েছে ৫০ কোটি টাকার। অন্যদিকে সংসদ সচিবালয়ের দায়িত্বে থাকা গণপূর্ত বিভাগের ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১০০ কোটি টাকা। সংসদ সচিবালয়ের আইটি খাত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাদের নিজস্ব বাজেট থেকে কিছু জরুরি কম্পিউটার কিনে স্বল্পপরিসরে কাজ শুরু করা হয়েছে। কিছু কম্পিউটার, ইন্টারনেট সংযোগ ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি ঠিক করা হয়েছে। সরকারের সিদ্ধান্ত পেলে বাকি কাজ করবে গণপূর্ত বিভাগ। সংসদ ভবন এলাকায় অবস্থিত মন্ত্রী, সংসদ সদস্যদের কার্যালয় এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বাসভবনও ভাঙচুর করা হয়। এ সময় বিক্ষুব্ধ লোকজন কম্পিউটার, আসবাবপত্রসহ গুরুত্বপূর্ণ ও দামি জিনিসপত্র লুট করে নিয়ে যায়।
গণপূর্ত অধিদফতরের কর্মকর্তারা জানান, সংসদ অধিবেশন কক্ষে এমপিদের বসার ২৭টি চেয়ার পুরোপুরি নষ্ট হয়েছে। এগুলো নতুন করে বানাতে হবে। কার্পেটের কিছু অংশে আগুন দেওয়া হয়েছিল বিধায় কার্পেটও নতুন করে বসাতে হবে। সামনের সারির বেশিরভাগ টেবিলই ভেঙে গেছে। অধিবেশন কক্ষের সাউন্ড সিস্টেম নষ্ট করা হয়েছে। টেবিলের ওপর থাকা মাইক্রোফোনগুলো ভেঙে ফেলা হয়েছে। সাউন্ড সিস্টেম মেরামত করা সম্ভব না হলে এটা নতুন কিনতে হবে। এ জন্য কমপক্ষে ২ কোটি টাকা প্রয়োজন হবে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, মেরামতের জন্য সংসদের দায়িত্বে থাকা গণপূর্ত অধিদফতরের কাঠের কারখানা বিভাগ ৪৯ কোটি টাকা ও সিভিল কাজের জন্য ২৮ কোটি টাকা বরাদ্দ চেয়েছে। এ ছাড়া ই/এম বিভাগ প্রায় ২৩ কোটি টাকা বরাদ্দ চেয়েছে। সংসদ ভবন, ভিআইপি ও কর্মকর্তাদের বাসভবন এবং এমপি হোস্টেল মেরামতের জন্য এই বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। গত ৯ মার্চ সংসদ সচিবালয়ের সচিব মো. মিজানুর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত গণপূর্ত সিভিল, ই/এম ও কাঠের কারখানা বিভাগের কাজের অগ্রগতিবিষয়ক সভায় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষিতে জাতীয় সংসদ ভবন ও এর অধীন বিভিন্ন স্থাপনার ক্ষয়ক্ষতি ও মেরামত সম্পর্কিত তথ্য তুলে ধরেন।
গণপূর্ত বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, সাইমুলটেনিয়াস ইন্টারপ্রিটিশন সিস্টেম (এসআইএস) এবং অধিবেশন কক্ষের সাউন্ড সিস্টেম মেরামত অথবা নতুন সিস্টেম স্থাপন এবং ক্ষতিগ্রস্ত এক্সেস কন্ট্রোল সিস্টেম, আর্চওয়ে ও ব্যাগেজ স্ক্যানার জরুরি ভিত্তিতে ক্রয়ের উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। এ সময় সচিব অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সব মেরামত, সংস্কার ও ক্রয় কার্যের তালিকা প্রস্তুত করে দ্রুত তার কাছে দিতে বলেন এবং সব কাজ আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ করার নির্দেশ দেন।
মঙ্গলবার সরেজমিন সংসদ সচিবালয়ের ভেতরে গিয়ে দেখা যায় প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা, সংসদ উপনেতা, চিফ হুইপ ও হুইপদের কার্যালয়গুলো এখনও ধ্বংসস্তূপের মতো রয়েছে। এ ছাড়া সংসদীয় কমিটির সভাপতিদের কক্ষগুলোর ভেতরেও ভাঙচুর করা অবস্থায় রয়েছে আসবাবপত্র। তবে সংসদ সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের অফিস কক্ষগুলো পরিষ্কার করে তারা নিয়মিত অফিস করছেন।
সংসদ সচিবালয়ের কর্মকর্তারা জানান, আগামী ডিসেম্বরে নির্বাচন হলে জানুয়ারিতে নতুন সংসদের প্রথম অধিবেশন বসবে এমনটা ধরেই তারা সংসদ ভবন মেরামতের উদ্যোগ নিয়েছেন। সংসদ ভবনের দায়িত্বে থাকা শেরেবাংলা নগর গণপূর্ত বিভাগ-১-এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. লতিফুল ইসলাম বলেন, সংসদ ভবনে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এবং স্পিকারসহ সব ভিআইপির কার্যালয় ভাঙচুর হয়েছে। অধিবেশন কক্ষও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ছাড়া সংসদ এলাকায় কর্মকর্তা ও ভিআইপিদের বাসভবন ও অফিসগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে তারা এখনও বড় ধরনের কোনো সংস্কার শুরু করেননি। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বাসা, অফিস মেরামতসহ শুধু অতিজরুরি ছোটখাটো মেরামত কাজ করেছেন চলতি অর্থবছরের বরাদ্দ থেকে। যেমন স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার ও ভিআইপিদের বাসার চারটি ওয়াশরুম ক্ষতিগ্রস্ত হলেও প্রত্যেক বাসায় একটি করে চালুর ব্যবস্থা করা হয়েছে। পানি ও গ্যাসের লাইন ঠিক করা হয়েছে। বাকি কোনো কাজ করা হয়নি। আগামী ডিসেম্বরে নির্বাচন হবে এমনটা ধরেই মেরামত কাজের পরিকল্পনা সাজানো হয়েছে। এ জন্য আগামী অর্থবছরের বাজেটে সংস্কারের জন্য বরাদ্দ চাওয়া হবে। আগামী জুলাই থেকে পুরোদমে মেরামত কাজ করা হবে।
তিনি জানান, কাজ শুরু হলে তিন থেকে চার মাসের মধ্যে মেরামত শেষ করা সম্ভব হবে। সিভিল এর মেরামত কাজের জন্য ২৮ কোটি টাকা চাহিদা দেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি। এমপি হোস্টেল ক্ষতিগ্রস্ত হলেও শুধু সংস্কার কমিশনের অফিসের জন্য কয়েকটি ফ্ল্যাট ঠিক করা হয়েছে বলে জানান নির্বাহী প্রকৌশলী। অধিবেশন কক্ষের মেরামত আগামী অর্থবছরের বরাদ্দ থেকে করা হবে বলে জানান তিনি।
সংসদ এলাকার দায়িত্বে থাকা গণপূর্ত কাঠের কারখানা বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সাজেদুল ইসলাম বলেন, ডিসেম্বরের মধ্যে সংসদের মেরামত কাজ শেষ করার নির্দেশনা পেয়েছেন। তবে তাদের অগ্রাধিকারভিত্তিক কাজের তালিকা দিতে বলা হয়েছে। কোন কোন কাজকে অগ্রাধিকা দেওয়া হচ্ছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, শপথ কক্ষ, অধিবেশন কক্ষ আগে ঠিক করতে হবে। এর পরে সরকারি দলের সভাকক্ষ ও বিরোধী দলের সভাকক্ষ, স্পিকার, হুইপসহ ভিআইপিদের অফিস কক্ষ ও সংসদীয় কমিটির সভাপতিদের অফিস কক্ষ ঠিক করতে হবে।
ডিসেম্বরের মধ্যে অধিবেশনসহ সংসদের সব কার্যক্রম নিরবচ্ছিন্নভাবে করার লক্ষ্যে মেরামত ও ক্রয় কার্যক্রমের নির্দেশনা দেওয়া হলেও সংসদের উচ্চকক্ষের বিষয়ে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত নেই বলে জানিয়েছেন সংসদ সচিবালয় ও গণপূর্ত বিভাগের কর্মকর্তারা। তারা বলেন, সংবিধান সংস্কার কমিশন উচ্চকক্ষ ও নিম্নকক্ষের সমন্বয়ে নতুন ধারার একটি সংসদ গঠনের সুপারিশ করেছে। তবে এটি করতে হলে সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন হবে। তাই এ বিষয়ে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত না হওয়ায় বিদম্যান সংসদের বিষয়টি মাথায় রেখেই সংস্কার কাজ করা হচ্ছে। সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী নিম্নকক্ষের সদস্য সংখ্যা যদি ৪০০ জন হয় তা হলে স্পিকারের দুই পাশের যেকোনো একটি ভিআইপি গ্যালারিকে সংসদ কক্ষের অন্তর্ভুক্ত করা হবে স্পিকারের দুই পাশে অধিবেশন কক্ষে থাকা কূটনীতিক ও বিদেশি অতিথিদের জন্য দুটি গ্যালারি রয়েছে।
বতর্মানে সংসদের আসন সংখ্যা ৩৫০টি হলেও সংসদ কক্ষে বসার আসন রয়েছে ৩৫৪টি। সংসদে আসন সংখ্যা বাড়াতে হলে ভেতরের নকশা স্থপতিদের মাধ্যমে পরিবর্তন করতে হবে বলে কর্মকর্তারা জানান। গণপূর্ত কাঠের কারখানা বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সাজেদুল ইসলামের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, দুই কক্ষবিশিষ্ট সংসদের সুপারিশের বিষয়টি পত্রিকায় পড়েছেন। তবে সংস্কারের ক্ষেত্রে তাদের এ বিষয়ে এখনও কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয়নি।
সম্পাদক মন্ডলীর সভাপতিঃ মোহাম্মদ আফছার খান সাদেক
সম্পাদক ও প্রকাশকঃ মিলাদ মোঃ জয়নুল ইসলাম
প্রকাশনালয়ঃ রিপোর্টার লজ, কসবা, বিয়ানীবাজার, সিলেট ।
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ উত্তর বাজার কেন্দ্রিয় মসজিদ মার্কেট (২য় তলা), বিয়ানীবাজার, সিলেট ।
মোবাঃ ০১৮১৯-৬৫৬০৭৭, ০১৭৩৮-১১ ৬৫ ১২
ইমেইলঃ agamiprojonma@gmail.com, milad.jaynul@gmail.com