প্রজন্ম ডেস্ক:
দেশের চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা ভাবিয়ে তুলেছে রাজনৈতিক দলগুলোকে। বিশেষ করে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি (জাতীয় নাগরিক পার্টি) ও ইসলামী আন্দোলনের কিছু নেতার বাগযুদ্ধের কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে একধরনের উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, উদ্বেগ স্পর্শ করেছে আওয়ামীবিরোধী তথা ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে জড়িত সুধী সমাজের প্রতিনিধিদেরও।
নির্ভরযোগ্য সূত্রের দাবি, বিদ্যমান এই পরিস্থিতিতে বাগ্যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া চার দলের মধ্যে সমঝোতার কথা ভাবছেন সুধী সমাজের একাংশ। পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের মধ্যেও উপলব্ধি হয়েছে, সমঝোতা না হলে যে পরিস্থিতি সৃষ্ট হবে তাতে ফ্যাসিবাদী শক্তিই লাভবান হবে।
সূত্র জানায়, পরিস্থিতি বিবেচনায় সুধী সমাজের দু-একজন প্রতিনিধির পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট দলগুলোর কয়েকজন নেতাও ইতোমধ্যে চার পক্ষের মধ্যে সমঝোতার জন্য তৎপরতা শুরু করেছেন। দু-এক দিনের মধ্যেই তাদের তৎপরতা স্পষ্ট হতে পারে।
সম্প্রতি ঢাকায় মিটফোর্ডে ব্যবসায়ী সোহাগ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় এনসিপি, জামায়াতে ইসলামী এবং ইসলামী আন্দোলন বিএনপিকে দায়ী করে দলটির বিরুদ্ধে নানা বক্তব্য দিতে শুরু করে। এরপর বিএনপির প্রতিবাদের সূত্র ধরে দলগুলোর মধ্যে রেষারেষি তৈরি হয়। তিন দল মিলে বিএনপিকে রাজনৈতিকভাবে ঘায়েল করার চেষ্টা করে। এতে রাজনীতিতে একধরনের অস্থিরতা তৈরি হয়। বক্তব্য-পাল্টা বক্তব্যে বিএনপির সঙ্গে ওই তিন দলের একধরনের স্নায়ুযুদ্ধ চলে। গতকাল বুধবার এ বিষয়ে একটি পত্রিকার প্রভাবশালী সম্পাদক প্রথম পাতায় একটি কলাম লেখেন। সেই কলামে তিনি নেতাদের লাগাম টেনে ধরার কথা বলেন।
অন্যদিকে সুধী সমাজের প্রতিনিধিরাও বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ে যোগাযোগ শুরু করেছেন। তারা চারটি দলের নেতাদের সঙ্গেও কথা বলেন। সুধী সমাজের ওই প্রতিনিধিরা রাজনৈতিক দলগুলোকে বোঝানোর চেষ্টা করেন, অস্থির পরিস্থিতি চলতে থাকলে অভ্যুত্থানবিরোধী আওয়ামী লীগ এবং তার সহায়ক শক্তিরা সুযোগ নেবে। তাতে কারোরই মঙ্গল হবে না।
এদিকে দলগুলোর মধ্যে চলমান এই স্নায়ুযুদ্ধ চলার পরিস্থিতিতেই বুধবার গোপালগঞ্জে এনসিপির সমাবেশে কয়েক দফা হামলা চালানো হয়। এনসিপির দাবি, নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগ এই হামলা চালিয়েছে। এই ঘটনায় চারজন নিহত ও আহত হয়েছেন প্রায় ১০০ জন। এ ঘটনায় দেশব্যাপী আরও উত্তাপ ছড়ানোর পাশাপাশি বাগ্যুদ্ধে লিপ্ত চার দলের নেতাদের মধ্যে আলোচনা শুরু হয়, আওয়ামী লীগ শক্তি সঞ্চয় করলে কারোরই রক্ষা হবে না। ঘটনার পর পরই বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এবং জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমানসহ গণ-অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী বেশ কয়েকটি দল উদ্বেগ ও নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দেন।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘গণতন্ত্র ও মানুষের ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠাসহ দেশে যাতে আবারও ফ্যাসিবাদের উত্থান হতে না পারে, সে জন্য দেশের মানুষের জানমাল রক্ষায় দলমত নির্বিশেষে সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। এর ব্যত্যয় হলে দেশে স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব আবারও হুমকির মুখে পড়বে।’
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. দিলারা চৌধুরী বলেন, ‘সমঝোতা হচ্ছে কি না জানি না। তবে সমঝোতার প্রয়োজনীতা অত্যন্ত অনুভব করছি। সমঝোতা না হলে দেশে অরাজকতা দেখা দেবে এবং গণ-অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে থাকা একটি শক্তি সুযোগ নেবে। রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা যত আগে সমস্যাটা বুঝবেন, তত আগেই দেশের মঙ্গল হবে।’
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘সমঝোতা হওয়া অত্যন্ত জরুরি। অনৈক্য কোনোভাবেই ভালো লক্ষণ নয়। সবাই ঐক্যবদ্ধ না থাকলে অন্যরা সুযোগ নেবে। গোপালগঞ্জের মতো ঘটনা ঘটতে থাকবে।’ তিনি বলেন, ‘জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করতে আমরা ইস্যুভিত্তিক উদ্যোগ নিয়েছি।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, ‘আমরা সবাইকে ছাড় দিয়েছি এবং দিচ্ছি। বর্তমানে দেশের চলমান উসকানির পেছনে দেশি-বিদেশি শক্তির হাত রয়েছে। এনসিপির পেছনেও বিদেশি শক্তি আছে। তারা এখন চাইছে বিএনপি চলে যাক। আওয়ামী লীগ চলে গেছে, এবার বিএনপি চলে গেলে সব তাদের। সবাই আমাদের দুর্বল বলে মনে করতে চাইছে। হঠকারী কোনো কিছু করে লাভ নেই। বিএনপি অনেক বড় দল। এত সহজ নয়।’
তিনি বলেন, ‘আমরা মিটফোর্ডের ঘটনার প্রতিবাদ করেছি এবং বহিষ্কার করেছি। কিন্তু সব দায়-দায়িত্ব আমাদের ওপর চাপানোও দুঃখজনক।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান বুধবার জাতীয় প্রেসক্লাবের এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘যারা বাংলাদেশে বিভেদ-বিদ্বেষ সৃষ্টি করছেন তাদের কাছে আবেদন করব, আপনারা বাংলাদেশকে ভালোবাসতে শিখুন। আপনারা দেশের ১৮ কোটি মানুষকে ভালোবাসতে শিখুন। সেটি যদি হয়, আমি মনে করি বাংলাদেশে আর কোনো দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হবে না। আপনাদের ভিন্নমত থাকবে, আমাদের ভিন্নমত থাকবে। আমরা আলোচনার মাধ্যমে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ফাইনাল সিদ্ধান্ত নেব।’
জানা গেছে, গত ২০ মের দিকে নির্বাচনের দিনক্ষণ, ইশরাক হোসেনের শপথের দাবিতে কর্মসূচি পালন, সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের বক্তব্যসহ নানা ইস্যুতে তখন দেশের রাজনীতিতে গুমোট পরিস্থিতি তৈরি হয়। তখন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ, আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু ও গণঅধিকার পরিষদের নুরুল হক নুর সরকার ও সব দলের সঙ্গে সমঝোতার উদ্যোগ নিয়েছিলেন এবং সফল হয়েছিলেন। এরপর মিটফোর্ডের হত্যাকাণ্ড নিয়ে দলগুলোর মধ্যে আবার বিরোধ স্পষ্ট হয়। তবে এবার বিদ্যমান পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক দলের নেতাদের পাশাপাশি সুধী সমাজের লোকজনও সব দলের মধ্যে সমঝোতার উদ্যোগ নিয়েছেন।
এদিকে জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান এক বিবৃতিতে ফ্যাসিবাদবিরোধী জনগণকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
দলটির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আব্দুল হালিম বলেন, ‘সবার মধ্যে আত্মসমালোচনা থাকা দরকার। আমরা আমাদের আত্মসমালোচনা করি। প্রত্যেক দলকে তাদের আত্মসমালোচনা করা উচিত। আমাদের আদর্শ ও দল নিয়ে পথ চলি। আমি মনে করি, গণতন্ত্রে সবার সমালোচনা সহ্য করতে হবে। বিএনপিকেও সহ্য করতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘ফ্যাসিস্ট হাসিনা গেলেও তার দোসররা কিন্তু এখনো দেশে রয়ে গেছে। তারা দেশে অস্থিরতা সৃষ্টি করতে চাইছে। গোপালগঞ্জের ঘটনা তারই একটা সতর্কবার্তা। তাই ফ্যাসিবাদীদের বিরুদ্ধে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে।’
ইসলামী আন্দোলনের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা গাজী আতাউর রহমান বলেন, ‘বিগত ১৫ বছর ফ্যাসিবাদীদের কবলে জিম্মি ছিল বাংলাদেশের জনগণ। যারা লুটপাট ও চাঁদাবাজি করেছে, জুলাই-আগস্টের গণহত্যা করেছে তাদের এখনো বিচার হয়নি। এখন ফ্যাসিবাদমুক্ত বাংলাদেশে যদি সেই আগের মতো চাঁদাবাজি-দখলবাজি চলে, তাহলে তাদের সঙ্গে সমঝোতা হবে কীভাবে? আবারও ফ্যাসিবাদীদের চরিত্রে আবির্ভূত হলে কীভাবে সমঝোতা হবে? আমরা জনগণের পক্ষে কথা বলব।’
তিনি বলেন, ‘গোপালগঞ্জে এনসিপির ওপর হামলার ঘটনায় সরকার ও প্রশাসনের ব্যর্থতা রয়েছে। তারা কেন নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠনকে প্রকাশ্যে আসার সুযোগ দিল?’
গণসংহতি আন্দোলনের সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, ‘গণহত্যার খুনিদের শাস্তি নিশ্চিত না করা পর্যন্ত সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। জাতীয় ঐক্য ধরে রাখা দরকার। রাজনৈতিক ঐক্যের মধ্য দিয়ে পতিত ফ্যাসিস্টদের রুখে দিতে হবে।’
গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর বলেন, ‘আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, দেশ যখন সংকটে পড়েছে, তখন দলমত নির্বিশেষে সবাই ভূমিকা রেখেছে। গোপালগঞ্জে এনসিপির ওপর হামলার ঘটনার মধ্য দিয়ে আবারও প্রমাণ হলো গত ১১ মাসেও ফ্যাসিবাদ আওয়ামী লীগের মধ্যে কোনো অনুশোচনা নেই। বরং তারা আগের মতো হিংস্র মনোভাব রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে ফ্যাসিবাদ নির্মূলের বিকল্প নেই। আশা করি, আগামী দিনে ফ্যাসিবাদ নির্মূলে সব দলই ইতিবাচক ভূমিকা পালন করবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘ফ্যাসিবাদ নির্মূল এবং দেশের উন্নয়নের জন্য আগামী পাঁচ বছর জাতীয় ঐকমত্যের সরকার গঠন করা প্রয়োজন। নির্বাচনে হলে যাদের ক্ষমতায় যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে তাদের সংসদে সব দল নিয়ে সরকার গঠন করতে হবে।’
এনসিপির ওপর হামলার ঘটনায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক মুখপাত্র উমামা ফাতেমা ফেসবুকে এক স্ট্যাটাসে বলেন, ‘আপনাদের অপদস্থ হতে দেখাটা আমাদের জন্য কষ্টের। আশা করি এই হামলা থেকে শিক্ষা নিয়ে রাজনৈতিকভাবে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করার বিষয়ে মনোযোগ দেবেন। জুলাই থেকে জুলাই-এ আসতেই রাজনৈতিক ঐক্যবদ্ধতা নাই হয়ে গেছে। নিজেদের রাজনৈতিক এজেন্ডায় বিভক্ত না হয়ে জুলাইয়ের সব শক্তিকে মিনিমাম জায়গায় ঐক্যবদ্ধ রাখার চেষ্টা করলে গোপালগঞ্জে যাওয়ার জন্য পুলিশ প্রটেকশনের প্রয়োজন হতো না।’
সম্পাদক মন্ডলীর সভাপতিঃ মোহাম্মদ আফছার খান সাদেক
সম্পাদক ও প্রকাশকঃ মিলাদ মোঃ জয়নুল ইসলাম
প্রকাশনালয়ঃ রিপোর্টার লজ, কসবা, বিয়ানীবাজার, সিলেট ।
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ উত্তর বাজার কেন্দ্রিয় মসজিদ মার্কেট (২য় তলা), বিয়ানীবাজার, সিলেট ।
মোবাঃ ০১৮১৯-৬৫৬০৭৭, ০১৭৩৮-১১ ৬৫ ১২
ইমেইলঃ agamiprojonma@gmail.com, milad.jaynul@gmail.com