প্রজন্ম ডেস্ক:
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের ঘটনায় প্রায় এক বছর পরও শহিদের সংখ্যা নিয়ে ধোঁয়াশা কাটেনি। জুলাই-আগস্টে নারকীয় হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় কত মানুষ নিহত হয়েছেন এখনও তা স্পষ্ট নয়। জাতিসংঘ, মানবাধিকার সংগঠন, জুলাই শহিদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন এবং মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের প্রকাশিত গেজেটে নিহতের সংখ্যার মধ্যে রয়েছে বিস্তর ফারাক। ঘটনার এক বছর পরও পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রণয়ন করতে না পারাকে অন্তর্বর্তী সরকারের ব্যর্থতা বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
সরকারি গেজেট অনুযায়ী, জুলাই আন্দোলনে গেজেটভুক্ত শহিদের সংখ্যা ৮৪৪ জন। তবে এর বিপরীতে হত্যা মামলার সংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি (প্রায় ১ হাজার ৭৯৯)। জুলাই মাসের ১৯ তারিখে ‘জুলাই শহিদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন’-এর ওয়েবসাইটে জুলাই অভ্যুত্থানে শহিদের সংখ্যা ৮২০+ জনের উল্লেখ করা হয়েছে। যা গেজেটভুক্ত শহিদের সংখ্যার চেয়েও কম।
আবার চলতি বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি জুলাই অভ্যুত্থান নিয়ন্ত্রণে তৎকালীন সরকারের দমন-পীড়ন নিয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনারের কার্যালয় (ওএইচসিএইচআর) একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনে অনুমান করা হয়েছে, ১ জুলাই থেকে ১৫ আগস্টের মধ্যে ১ হাজার ৪০০ জনেরও বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়ে থাকতে পারে এবং আহত হয়েছেন হাজার হাজার মানুষ। এই সংখ্যাকে সমর্থন করে গত ৩০ এপ্রিল ঢাকার মিরপুরে এক রাজনৈতিক কর্মসূচিতে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ বলেছেন, গণঅভ্যুত্থানে ১ হাজার ৪০০ জনের বেশি শহিদ এবং ৩০ হাজারের কাছাকাছি মানুষ আহত হয়েছেন।
গত বছরের সেপ্টেম্বরে ফেসবুকে এক ভিডিও বার্তায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক তরিকুল ইসলাম জানান, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে কেন্দ্র করে জুলাই বিপ্লবে অন্তত ১ হাজার ৪২৩ জন ছাত্র-জনতা শহিদ হয়েছেন।
এদিকে রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালের মর্গে এখনও অশনাক্ত অবস্থায় হিমাগারে পড়ে আছে বেশ কিছু মরদেহ। আবার পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) কাছেও অশনাক্ত অবস্থায় রয়ে গেছে বেশ কিছু মরদেহের ডিএনএর নমুনা। এরমধ্যে শহিদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের মর্গে তিনটি এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে রয়েছে ৬টি মরদেহ। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) কাছেও আছে জুলাই শহিদদের বেশ কিছু ডিএনএ নমুনা।
চলতি বছরের ৯ মার্চ এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে সিআইডি জানিয়েছে, এসব শহিদের ডিএনএ নমুনা ফরেনসিক ল্যাবে সংরক্ষিত রয়েছে। শহিদদের নিকটতম আত্মীয়, বিশেষ করে বাবা, মা, সন্তান বা সহোদররা ডিএনএ নমুনা দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়। নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষার মাধ্যমে পরিচয় নিশ্চিত করা হলে পরিবারের সদস্যদের আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হবে বলে সিআইডির তরফ থেকে বলা হয়। তবে এ পর্যন্ত কতজন ডিএনএ নমুনা জমা দিয়েছে গত বৃহস্পতিবার সিআইডির সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তাৎক্ষণিকভাবে তারা তা জানাতে পারেননি।
অন্যদিকে পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা যায় গণঅভ্যুত্থানে নিহত হয়েছেন ৪৪ জন পুলিশ সদস্য। কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকেও ১৪৪ জন নেতাকর্মী নিহত হয়েছেন বলে তালিকা দেওয়া হয়েছিল জাতিসংঘের তদন্তকারী কর্মকর্তাদের কাছে।
জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের ঘটনায় দলের শহিদের কোনো তালিকা প্রকাশ করা হয়নি কিংবা সংখ্যাও জানানো হয়নি। গত বছরের সেপ্টেম্বরের ২৮ তারিখে পাবনায় সরকারি অ্যাডওয়ার্ড কলেজ মাঠে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শহিদ পরিবার ও আহতদের সঙ্গে সাক্ষাৎ এবং সুধী সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘অনেক সাংবাদিক ভাইয়েরা আমাকে জিজ্ঞেস করেন, (ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে) আপনার দলের শহিদের সংখ্যা কত? কিন্তু আমরা তাদের বলেছি আমরা সংখ্যা বলব না, কারণ শহিদরা কোনো দলের হতে পারে না। তারা জাতির সম্পদ, তারা জাতির বীর। এই জন্য আমরা আমাদের দলের শহিদের সংখ্যা বলব না, কারণ এই শহিদরা সমস্ত জাতির।’
জুলাই শহিদের তালিকা প্রকাশ না করায় জামায়াতের সমালোচনা করেছেন ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দিন। গত ১৬ জুলাই বুধবার বিকালে চট্টগ্রাম নগরের ২ নম্বর গেট এলাকায় গণ-অভ্যুত্থানে শহিদদের স্মরণে আয়োজিত এক সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘এক বছর হলেও জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্রশিবিরের সভাপতিসহ নেতারা জুলাই-আগস্টের কোনো ছবি দেখাতে পারেননি। অথচ ছাত্রদলের ১৪২ নেতাকর্মী শহিদ হয়েছেন। গুপ্ত এই সংগঠনের জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে অংশ নেওয়ার ছবি দেখাতে পারলে, তারা যা বলবেন, তা মেনে নেব।’
জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে ৮৪৮ জন শহিদের তালিকা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জমা দিয়েছে বিএনপি। গত ১৩ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর স্বাক্ষরিত চিঠির মাধ্যমে এ তালিকা জমা দেওয়া হয়। ওই তালিকায় ৮৪৮ জন শহিদের মধ্যে ৫২৪ জন সরাসরি বিএনপি এবং এর অঙ্গ সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী। বাকি ৩২৪ জন বিএনপি সমর্থক বলে জানানো হয়েছে। এ ছাড়াও এ আন্দোলনে ৫ হাজারের বেশি নেতাকর্মী ও সমর্থক আহত হয়েছেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। নেতাকর্মী নিহতের ঘটনায় সারা দেশে করা ৮৪টি মামলার নথিপত্রও ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশনে জমা দেওয়া হয়েছে।
এদিকে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহিদদের নিয়ে ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে রাজনৈতিক দলগুলোর কাদা ছোড়াছুড়ি। গত শুক্রবার বিএনপি দলীয় কার্যালয়ের সামনে আয়োজিত দলীয় এক কর্মসূচিতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস অভিযোগ করেছেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহিদদের নিয়ে বিশেষ কয়েকটি দল রাজনীতি করছে এবং তাদের বিক্রি করে রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার চেষ্টা করছে। জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ও ইসলামী আন্দোলনের প্রতি ইঙ্গিত করে এমন মন্তব্যের পাশাপাশি তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে পক্ষপাতমূলক আচরণের অভিযোগও আনেন।
শহিদ ও আহতদের সঠিক ও পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রণয়নের গুরুত্বরোপ করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, ইতিহাসকে সংরক্ষণের স্বার্থে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য জুলাই অভ্যুত্থানের ঘটনায় আহত-নিহতদের পূর্ণাঙ্গ ও সঠিক তালিকা প্রণয়ন করাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারীদের প্রতি যথাযথ সম্মান জানাতে তালিকা প্রণয়নে দল-মতের ঊর্ধ্বে উঠে সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।
দীর্ঘ সময়েও জুলাই অভ্যুত্থানের ঘটনায় নিহত-আহতদের তালিকা তৈরির কাজ শেষ না হওয়ায় অন্তর্বর্তী সরকারের সমালোচনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সমাজ ও অপরাধ বিজ্ঞানী ড. তৌহিদুল হক। তিনি বলেন, তালিকা তৈরির কাজটি কঠিন হলেও জুলাই গণঅভ্যুত্থানের শহিদদের প্রতি সম্মান জানিয়ে পূর্ণাঙ্গ তালিকা এত দিনে সম্পন্ন করা প্রয়োজন ছিল। এ ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকারের এক ধরনের উদাসীনতা লক্ষ করা যাচ্ছে। যা কখনোই কাম্য নয়। যেকোনো ধরনের বিলম্বিত পদক্ষেপ শহিদ পরিবার এবং আহতদের মধ্যে আক্ষেপ তৈরি হবে। এ ছাড়া সঠিক সংখ্যা নির্ধারণটা সঠিক ইতিহাসের জন্যও খুব প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের চেয়ারপারসন অধ্যাপক ড. শাহারিয়া আফরিন বলেন, ন্যায়বিচার, ইতিহাস, গবেষণাসহ অনেক কিছুর প্রয়োজনেই জুলাই অভ্যুত্থানে নিহতদের নির্ভুল তালিকা প্রণয়ন করা উচিত। এখনও তা না করতে পারাটা দুঃখজনক। অন্তর্বর্তী সরকার এই কাজটা সম্পন্ন করতে পারলে তার প্রশংসার দাবিদার হতে পারে। মানবিকতা ও নৈতিকতার বিবেচনাতেও এই তালিকা সম্পন্ন করাটা জরুরি।
জুলাই অভ্যুত্থানে শহিদের সংখ্যা প্রসঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার সিনিয়র সহকারী প্রেস সচিব ফয়েজ আহম্মদ বলেন, সরকারিভাবে শহিদের সংখ্যা হিসেবে ৮৪৪ জনের কথা বলা হয়েছে, এখন পর্যন্ত সেটাই সঠিক। তবে এই সংখ্যা হালনাগাদ করা হবে এবং এই বিষয়টি সরকারি ওয়েবসাইটেও উল্লেখ করা হয়েছে। জুলাই শহিদের সংখ্যা নিয়ে ভবিষ্যতে যেন কোনো বিতর্কের জন্ম না নেয় এ জন্য বিতর্কহীন ও বিতর্কমুক্ত একটি তালিকা তৈরির জন্য সরকার কাজ করে যাচ্ছে বলেও এ সময় উল্লেখ করেন তিনি।
সম্পাদক মন্ডলীর সভাপতিঃ মোহাম্মদ আফছার খান সাদেক
সম্পাদক ও প্রকাশকঃ মিলাদ মোঃ জয়নুল ইসলাম
প্রকাশনালয়ঃ রিপোর্টার লজ, কসবা, বিয়ানীবাজার, সিলেট ।
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ উত্তর বাজার কেন্দ্রিয় মসজিদ মার্কেট (২য় তলা), বিয়ানীবাজার, সিলেট ।
মোবাঃ ০১৮১৯-৬৫৬০৭৭, ০১৭৩৮-১১ ৬৫ ১২
ইমেইলঃ agamiprojonma@gmail.com, milad.jaynul@gmail.com