প্রজন্ম ডেস্ক:
দেশের জনগণের পাশাপাশি রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সব মহলের দৃষ্টি এখন ৫ ও ৮ আগস্টের দিকে। কারণ এই দুটি দিনে আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন তথা বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাষ্ট্র পরিচালনার রূপরেখা নির্ধারণ হবে বলে মনে করা হচ্ছে। সরকারি ঘোষণা অনুযায়ী, এ বছর ৫ আগস্ট রাষ্ট্রীয়ভাবে পালিত হবে ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থান দিবস’। আর প্রতি বছর এই দিনটি বাংলাদেশের জাতীয় দিবস হিসেবে পালিত হবে এবং সরকারি ছুটি থাকবে। রাষ্ট্রীয়ভাবে দিনটি পালনের জন্য সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সব মহলে চলছে প্রয়োজনীয় সব ধরনের প্রস্তুতি। দিনটি উদযাপনে রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানসহ নানা কর্মসূচি পালন নির্বিঘ্ন করতে তৎপর রয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাসহ রাজনৈতিক মহল। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটেছিল।
হাসিনা সরকারের পতনের পর ৮ আগস্ট নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত হয় অন্তর্বর্তী সরকার। ফলে এই দিনটি এ বছর রাষ্ট্রের জন্য খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। রাজনৈতিক অঙ্গনের পাশাপাশি রাষ্ট্রের বিভিন্ন মহলে আলোচনা হচ্ছে, এই দুই দিনের যেকোনো এক দিন টেলিভিশনে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন। ওই ভাষণে আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের একটি সম্ভাব্য সময় বেরিয়ে আসতে পারে। বিশেষ করে কোন মাসে নির্বাচন হবে সেটি স্পষ্ট হতে পারে জনগণের কাছে। তবে সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনের দিনক্ষণ বা তারিখ ঘোষণা করবে নির্বাচন কমিশন।
এদিকে প্রতি বছর ৮ আগস্টকে ‘নতুন বাংলাদেশ দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করলেও পরে সে সিদ্ধান্ত থেকে সরকার সরে আসে। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের এই দিনকে বেশি গুরুত্ব দিতে আগ্রহী নন প্রধান উপদেষ্টা। সে হিসেবে ৫ আগস্ট নির্বাচনের সময়সীমা ঘোষণার সম্ভাবনা আছে। কিন্তু একই দিনে জুলাই ঘোষণাপত্র দেওয়ার কথা রয়েছে। ফলে নির্বাচনের সময়সীমার ঘোষণা ৮ আগস্টও আসতে পারে।
সরকারি একাধিক সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, আগামীকাল ৫ আগস্ট মঙ্গলবার টেলিভিশনে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এই ভাষণে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্ট হওয়ার পাশাপাশি গণ-অভ্যুত্থানের বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরবেন ড. ইউনূস। নির্বাচনের সময়কাল নিয়ে নানা গুঞ্জনেরও অবসান হবে বলে পর্যবেক্ষক মহল মনে করছে। এ ছাড়া দেশব্যাপী চলমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি- সব মিলিয়ে জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে দেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে আগামী ৫ ও ৮ আগস্ট দেশের প্রেক্ষাপট কোন দিকে মোড় নেয় তার দিকে নজর থাকবে দেশের জনগণের পাশাপাশি সচেতন জনগোষ্ঠীর। আগামী ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছর পূর্ণ হবে। এক বছর পরে ড. ইউনূস কী বলেন বা দিকনির্দেশনা দেন, তার ওপরে দেশের আগামী দিনের রাজনীতির গতিপথ নির্ভর করছে।
দেশের আগামী রাজনীতি কেমন হবে তা নিয়ে দেশের জনগণের মধ্যে এখনো নানা আলোচনা ও গুঞ্জন চলছে। এর কারণ হলো; সংস্কারসহ বিভিন্ন ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে থাকা মতবিরোধ এখনো দূর করা যায়নি। বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপির মধ্যে চলমান মতবিরোধের কারণেই রাজনীতিতে এক ধরনের ‘ষড়যন্ত্র’ তত্ত্ব চালু আছে। রাজনৈতিক সংকট থেকে উদ্ভূত কোনো সহিংসতার ফলে আওয়ামী লীগের উত্থানের সম্ভাবনার কথাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না অনেক বিশ্লেষক।
প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে গতকাল জানানো হয়েছে, আগামীকাল মঙ্গলবার রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে আয়োজন করা হয়েছে দিনব্যাপী বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানমালা। বেলা ১১টা থেকে বিভিন্ন শিল্পীগোষ্ঠীর গান; ২টা ২৫ মিনিটে ‘ফ্যাসিস্টের পলায়ন উদযাপন’ ও গান পরিবেশন। বিকেল ৫টায় গণ-অভ্যুত্থানের সব পক্ষের উপস্থিতিতে ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ জাতির সামনে উপস্থাপন করবেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এরপর সন্ধ্যা ৭টা ৩০ মিনিট থেকে ‘স্পেশাল ড্রোন ড্রামা’ এবং ৮টায় কনসার্ট অনুষ্ঠিত হবে।
গত বছরের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর থেকে রাজনৈতিক অঙ্গনে অন্যতম আলোচিত বিষয় এই জুলাই ঘোষণাপত্র। অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি সামনে রেখে সম্প্রতি জুলাই ঘোষণাপত্রের চূড়ান্ত খসড়া বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ (এনসিপি) বিভিন্ন দলকে পাঠিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের ফলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ এবং তার সরকারের দীর্ঘ ১৬ বছরে শাসনামলের অবসান ঘটে। পরে এই দিনটি ‘৩৬ জুলাই’ নামে পরিচিতি পায়।
অন্যদিকে রাষ্ট্র সংস্কারের গুরুত্বপূর্ণ নীতিনির্ধারণে রাজনৈতিক দলগুলোর মতামতের ভিত্তিতে ‘জুলাই জাতীয় সনদ’-এর খসড়া চূড়ান্ত করেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। দুই দফা বৈঠকে দলগুলোকে নিয়ে দীর্ঘ আলোচনায় মতপার্থক্য ও বিতর্কের পর গত ৩১ জুলাই রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ নীতিনির্ধারণী এই অধিবেশন শেষ হয়। এ বিষয়ে কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, দুই দফায় ঐকমত্য কমিশনের ৬৮টি বৈঠকে ৮১টি ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে কমিশন। এর মধ্যে প্রথম দফায় ৪৫টি অধিবেশনে ৬২টি ও দ্বিতীয় দফায় ২৩টি বৈঠকে ১৯টি মৌলিক ইস্যুতে রাজনৈতিক ঐকমত্য হয়েছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি ড. আলী রীয়াজ জানিয়েছেন, বার বার আলোচনার পরও কিছু বিষয় অমীমাংসিত রয়েছে এবং বিভিন্ন দলের পক্ষ থেকে ১০টি ইস্যুতে ভিন্নমত (নোট অব ডিসেন্ট) তারা পেয়েছেন; যা পরে আলোচনার মাধ্যমে নিষ্পত্তির চেষ্টা করা হবে।
অন্তর্বর্তী সরকারের জুলাই জাতীয় সনদের মধ্যে থাকবে দুটি অংশ- একটি অংশে থাকবে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য হওয়া বিষয়গুলো, অপর অংশে থাকবে দলগুলোর প্রতিশ্রুতির তালিকা। রাজনৈতিক ঐকমত্য হওয়া এবং নোট অব ডিসেন্টসহ সব ইস্যু নিয়েই জুলাই জাতীয় সনদের খসড়া প্রস্তুত করা হয়েছে। খসড়া সনদে ঐকমত্য হওয়া উল্লিখিত প্রস্তাবগুলো নির্বাচনের পর ২ বছরের মধ্যে বাস্তবায়নে রাজনৈতিক দলগুলোর অঙ্গীকার নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। তবে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন ইস্যুতেও দলগুলোর মধ্যে মতভিন্নতা দেখা দিয়েছে। ফলে জুলাই সনদ বাস্তবায়নে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গতকাল রবিবার পর্যালোচনা সভা করেছে। তাতে জুলাই সনদের প্রস্তাবগুলো নিয়ে পর্যায়ক্রমে বিশেষজ্ঞ, রাজনৈতিক দল ও জোটের সঙ্গে আরও মতামত নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন।
এদিকে ৫ ও ৮ আগস্টের নানা অনুষ্ঠান ঘিরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে জনমনে কিছুটা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা রয়েছে। দেশজুড়ে ডাকাতি, ছিনতাই, লুটপাট, রাহাজানি, চাঁদাবাজি, মব-সন্ত্রাস, খুন, ধর্ষণসহ নানাবিধ অপরাধের ঘটনায় এই উদ্বেগ আরও বাড়ছে। পাশাপাশি চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়েও দেশের মানুষের মধ্যে রয়েছে হতাশা।
সম্প্রতি খোদ প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, গণ-অভ্যুত্থানের কর্মসূচি ও নির্বাচন বানচাল করতে একটি মহল অরাজকতা চালাতে পারে। পুলিশের গোয়েন্দা সংস্থাও শঙ্কা প্রকাশ করেছে, এই সময়ে নাশকতা হতে পারে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্রগুলো বলছে, ৫ আগস্টকে সামনে রেখে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করতে পতিত আওয়ামী লীগ নানাভাবে তৎপর। গত মাসে রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় একটি কনভেনশন সেন্টারে কার্যক্রম নিষিদ্ধ হওয়া এই দলটির কয়েক শ নেতা-কর্মী নিয়ে প্রশিক্ষণ, কর্মশালাসহ ঢাকায় একাধিক গোপন বৈঠকের খবর রয়েছে পুলিশের কাছে। ইতোমধ্যে ২২ জনকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। মেজর পদমর্যাদার একজন সেনা কর্মকর্তার সম্পৃক্ততার কথাও জানা গেছে। তাকে সেনা হেফাজতে নেওয়া হয়েছে। তার জন্য তদন্ত আদালতও গঠন করেছে সেনাবাহিনী।
পুলিশ সদর দপ্তরের আরেকটি সূত্র বলছে, ৫ আগস্টকে কেন্দ্র করে সুনির্দিষ্ট হুমকি নেই। তবে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা সভা-মিছিল করার চেষ্টা করছেন। কয়েকটি জেলায় দেয়ালে দেয়ালে পোস্টার সাঁটানো হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানা গুজব ছড়াচ্ছেন। বিশেষ করে আওয়ামী লীগের যেসব স্থানীয় জনপ্রতিনিধি গ্রেপ্তার হননি, তারা নেতা-কর্মীদের সংগঠিত করার চেষ্টা করছেন বলে তথ্য রয়েছে।
সরকার ও পুলিশের বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, ইতোমধ্যে রাজধানী ঢাকা ও আশপাশের এলাকাসহ বিভিন্ন স্থানে ‘ব্লক রেইড’ বা বিশেষ অভিযান শুরু হয়েছে। রাজধানীর ১১টি প্রবেশমুখসহ নগরীর ভেতরে দুই শতাধিক তল্লাশি চৌকি বসানো হয়েছে। এ ছাড়া আবাসিক হোটেল ও মেসে অভিযান এবং গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সংস্থাগুলো। পরিস্থিতি মোকাবিলায় এরই মধ্যে সরকারের বিশেষ শাখা থেকে চিঠি দিয়ে দেশের সব পুলিশ ইউনিটকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। ফলে পরিস্থিতি মোকাবিলায় সতর্কতা বাড়িয়ে নড়েচড়ে বসেছে সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থাসহ রাজনৈতিক মহল।
২০২৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে শুরু হওয়া ছাত্রদের আন্দোলন শেষমেশ সরকার উৎখাতের ইতিহাস গড়ে। ৩৬ দিনের সেই আন্দোলনে ক্ষমতা ছেড়ে ভারতে পালাতে বাধ্য হন সাড়ে ১৫ বছর দোর্দণ্ড প্রতাপে দেশ চালানো শেখ হাসিনা। শুরুতে এই আন্দোলনের কেন্দ্র ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পরে তা দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। সরকারের তরফে জবাব ছিল- গুলি, টিয়ারশেল আর লাঠি; এক কথায় কেবলই বলপ্রয়োগ। প্রথমে ফেসবুক ও পরে ইন্টারনেট বন্ধ করে পরিস্থিতি সামাল দিতে চায় সরকার। তাতে হিতে বিপরীত হয়। আন্দোলনে রক্তপাত শুরু হওয়ার ২০ দিনের মধ্যেই লাশ আর রক্তের বোঝা মাথায় নিয়ে পতন হয় রাষ্ট্র পরিচালনায় দেড় দশকের আওয়ামী লীগ সরকারের।
Sharing is caring!