প্রজন্ম ডেস্ক:
গত বছরের এই দিনে (৫ আগস্ট) গণঅভ্যুত্থানের মুখে দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে পালানোর আগে দেশজুড়ে রেখে যান আন্দোলন দমনের নামে ভয়াবহ নির্মমতার ক্ষতচিহ্ন, যার বর্ণনা উঠে এসেছে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের একটি মামলার সাক্ষীদের বয়ানে। হাসপাতালে আহতদের দেখতে গিয়ে চিকিৎসা না দেওয়া ও হাসপাতাল থেকে আহতদের রিলিজ না দিতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। এমন অভিযোগ এনে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন শিক্ষার্থী আবদুল্লাহ আল ইমরান। আর পুলিশের গুলিতে চোখ হারানো পারভিন দিয়েছেন সেই বিভীষিকাময় দিনে চোখে গুলি লাগার ঘটনার বর্ণনা।
শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার এক বছর পূর্ণ হলো আজ। গত বছরের জুলাই ও আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে যে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছিল, তার এক বছরের মাথায় এক মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণের মাধ্যমে সেই অপরাধের আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু হয়েছে রোববার। এদিন দুপুরে বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ বিচার কার্যক্রম শুরু হয়। বিচারকাজ ট্রাইব্যুনালের ফেসবুক পেজ থেকে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের একটি মামলায় আসামি ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের বিরুদ্ধে রোববার প্রথম দিনে ট্রাইব্যুনালে নিজের ওপর ঘটে যাওয়া নৃশংস আচরণসহ যাত্রাবাড়ী থানার সামনে মানুষ হত্যার বিবরণ দেন খোকন চন্দ্র বর্মণ নামের এক মাইক্রোবাসচালক। একই মামলায় সোমবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ মামলার দ্বিতীয় সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি দিয়েছেন আবদুল্লাহ আল ইমরান ও ১৮ জুলাই যাত্রাবাড়ীতে পুলিশের গুলিতে এক চোখ অন্ধ হয়ে যাওয়া পারভিন।
জবানবন্দিতে শিক্ষার্থী আবদুল্লাহ আল ইমরান বলেন, গত বছরের ১৯ জুলাই রাজধানীর বিজয়নগর পানির ট্যাঙ্ক এলাকায় গুলিবিদ্ধ হন তিনি। তার বাঁ হাঁটুর নিচে গুলি লাগে। পরে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (পঙ্গু হাসপাতাল) তার চিকিৎসা চলছিল। গত বছরের ২৬ অথবা ২৭ জুলাই সকাল ৯টা-১০টার দিকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওই হাসপাতাল পরিদর্শনে যান। এক পর্যায়ে শেখ হাসিনা তার কাছে যান। শেখ হাসিনাকে তিনি ‘ম্যাডাম’ বলে সম্বোধন করেন। শেখ হাসিনা তাকে ‘আপা’ বলে ডাকতে বলেন।
আবদুল্লাহ আল ইমরান আরও বলেন, তিনি কোথায় পড়াশোনা করেন, হলে থাকেন কি না, কেন থাকেন না, সে সম্পর্কে শেখ হাসিনা জানতে চান। তিনি বলেন, ‘এক পর্যায়ে শেখ হাসিনা বুঝতে পারেন, আমি আন্দোলনকারী। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করেন, পুলিশ তোমাকে গুলি করেছে?’ আমি বলি, ‘পুলিশ আমাকে সরাসরি গুলি করে। পুলিশের পোশাকে কারা ছিল, সেটি আমি জানি না। আমার পর আরও চার থেকে পাঁচজনের সঙ্গে তিনি কথা বলেন। পরে শেখ হাসিনা যখন চলে যাচ্ছিলেন, তখন হেল্পডেস্কের কাছে গিয়ে “নো রিলিজ, নো ট্রিটমেন্ট” অর্ডার দিয়ে যান, যা আমি শুনতে পাই।’ তবে ‘নো রিলিজ, নো ট্রিটমেন্ট’ মানে কী, তখন বুঝতে পারেননি বলেও জবানবন্দিতে উল্লেখ করেন আবদুল্লাহ আল ইমরান। তিনি বলেন, এক পর্যায়ে তিনি দেখেন, যথাসময়ে তার অস্ত্রোপচার হচ্ছে না। বাইরে থেকে ওষুধ কিনতে পারছেন না। তার বাবা হাসপাতাল থেকে নিয়ে যেতে চাইলেও নিতে পারছিলেন না। তখন তিনি বুঝতে পারেন ‘নো রিলিজ, নো ট্রিটমেন্ট’-এর মানে। তার পা কেটে তাকে কারাগারে নিতে চেয়েছিল। এ ঘটনার জন্য শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে দায়ী করেন আবদুল্লাহ আল ইমরান।
২০২৪ সালের ১৮ জুলাই যাত্রাবাড়ীতে পুলিশের গুলিতে এক চোখের দৃষ্টি হারানো অন্য সাক্ষী আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা পারভিন ডায়াসে দাঁড়িয়ে তার জবানবন্দিতে বলেন, আমার নাম পারভিন। বয়স ২৭। আমি ঢাকার যাত্রাবাড়ীর কুতুবখালী এলাকায় থাকতাম। এখন বরিশালে স্বামীর বাড়িতে থাকি। ঢাকায় থাকা অবস্থায় আমি দিনমজুরের কাজ করতাম। ২০২৪ সালের ১৮ জুলাই প্রতিদিনের মতো জুরাইনে ৫টা পর্যন্ত কাজ করে লেগুনা স্ট্যান্ডে আসি। তবে এখানে কোনো গাড়ি না পেয়ে হেঁটে রওনা হই। যাত্রাবাড়ী এসে দেখি অনেক মানুষ আহত হয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় রাস্তায় পড়ে আছে। যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভারের নিচে ১৮-১৯ বছরের একটা ছেলেকে পড়ে থাকতে দেখি। ছেলেটি চিৎকার করছিল আর তার সারা শরীর রক্তাক্ত ছিল। এ ছাড়া তার দুই চোখ দিয়ে রক্ত বের হচ্ছিল। ছেলেটির গলায় একটা আইডি কার্ড ছিল। ছেলেটি শুধু বলে আমাকে বাঁচান। এক পর্যায়ে ছেলেটি দাঁড়িয়ে আমাকে ধরে আমার ঘাড়ে মাথা দেয়। আমি রিকশা খুঁজতে থাকি ওকে নিয়ে হাসপাতালে যাওয়ার জন্য।
তো এ সময় ১৪-১৫ জন পুলিশ মারমুখী হয়ে ওই ছেলেটাকে লক্ষ্য করে গুলি করে, যা ছেলেটার পিঠে লাগে। আমি বাম হাত তুলে গুলি না করতে অনুরোধ করি। তখন একজন পুলিশ আমার বাম চোখে গুলি করে। এরপর তিনজন পুলিশ আমার তলপেটসহ কয়েক জায়গায় গুলি করে। এ সময় আমার চোখ দিয়ে ফিল্কি দিয়ে রক্ত বের হচ্ছিল। রক্তে রাস্তা ভেসে যাচ্ছিল। এক পর্যায়ে ছেলেটাকে নিয়ে আমি রাস্তায় পড়ে যাই। এ সময় ছেলেটা একটা নিশ্বাস নিয়ে ছাঁট দেয়। মনে হচ্ছিল ওইসময় ছেলেটি মারা যায়। পরে লোকজন এসে বলে ছেলেটি তো মারা গেছে, মেয়েটি জীবিত আছে। এমন সময় একটি সিএনজিতে (অটোরিকশা) আমাকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু হাসপাতালে আনার পর গড়িমসি করা হয় এবং বলা হয় এটি তো পুলিশ কেস। তখন লোকজন বলে তা হলে কি উনি মারা যাবেন?
এ সময় একজন নার্স এসে বলে, আপনার ড্রপ লাগবে? ২৫০ টাকা আছে? আমি বলি, আমার কাছে কোনো টাকা নেই। তখন অন্য একজন মহিলা ২৫০ টাকা দিয়ে একটি ড্রপ কিনে দেয়। পড়ে আর কোনো চিকিৎসা না করে ডাক্তাররা চলে যায়। আমার এই অবস্থার খবর পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে রওনা দিয়ে পরের দিন সকালে আমার স্বামী বরিশাল থেকে এসে পৌঁছায়। তখন ডাক্তাররা তাকে বলে আপনার স্ত্রীর অপারেশনের জন্য কিছু জিনিস কেনাকাটা লাগবে। তখন আমার স্বামী কিছু আসবাবপত্র ও আমার কানের দুল বিক্রি করে টাকা জোগাড় করে। পরে আমার অপারেশন হয় ও আমার চোখ থেকে তিনটি গুলি বের হয়। এ ছাড়া ডাক্তাররা দেখেন আরও গুলি রয়েছে ভেতরে। পরে আমাকে চক্ষু বিজ্ঞান হাসপাতালে যেতে বলা হয় এবং আমার স্বামী আমাকে চক্ষু বিজ্ঞান হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে ভর্তি হওয়ার পর আমার অপারেশন হয়নি। ৫ আগস্ট দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমার অপারেশন হয়। এখনও আমার তলপেটে অনেক গুলি আছে যা বের করা সম্ভব হয়নি। আমি এখন আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা। আমি ন্যায়বিচার পেতে আপনাদের কাছে এসেছি। আমার একটি চোখ (বাম) ড্যামেজ হয়ে গেছে চিকিৎসার অবহেলার কারণে। এ ছাড়া আমার ডান চোখেও কম দেখি। আমার দুই সন্তানের কাছে আমি এখন অন্ধ মা হয়ে গেছি। অন্ধ হওয়ার জন্য একমাত্র দোষী শেখ হাসিনা। আমার দুই সন্তানও চায় তার মায়ের অন্ধত্বের জন্য যারা দায়ী তাদের বিচার হোক। তাই আমি আমার অন্ধত্ব ও শহিদের এবং আহতদের জন্য বিচার চাই। এ ক্ষেত্রে শেখ হাসিনা পুলিশের মা-বাবা। তার নির্দেশে পুলিশ গুলি করেছে। তার নির্দেশ ব্যতীত পুলিশ এভাবে গুলি করতে পারে না।
ট্রাইব্যুনালে পারভিন সাক্ষী দেওয়ার সময় বারবার কান্নায় ভেঙে পড়েন। এক পর্যায়ে তার সাক্ষ্যগ্রহণের পর জেরা করা হয়। জেরা করেন শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের পক্ষে রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন। এরপর ট্রাইব্যুনাল পরবর্তী সাক্ষ্যের জন্য আগামী ৬ আগস্ট দিন ধার্য করেন।
সোমবার ট্রাইব্যুনাল প্রসিকিউশন পক্ষে চিফ প্রসিকিউটর ও প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম শুনানি করেন। এ সময় অন্য প্রসিকিউটররা উপস্থিত ছিলেন। অন্যদিকে শেখ হাসিনার পক্ষে ছিলেন রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন। আর এ মামলায় গ্রেফতার হয়ে ট্রাইব্যুনালে হাজির হওয়া আসামি সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী যায়েদ বিন আমজাদ।
মানবতাবিরোধী অপরাধের এ মামলায় শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের বিরুদ্ধে গত ১০ জুলাই অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। এ ছাড়া এ মামলায় দোষ স্বীকার করে ঘটনার সত্যতা উদঘাটনে (অ্যাপ্রোভার) রাজসাক্ষী হতে সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের আবেদন মঞ্জুর করেন ট্রাইব্যুনাল। সেই সঙ্গে এ মামলায় সূচনা বক্তব্য উপস্থাপনের জন্য ৩ আগস্ট ও সাক্ষ্যের জন্য ৪ আগস্ট দিন ধার্য করেন।
Sharing is caring!