প্রজন্ম ডেস্ক:
সরকার তার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় ঘোষণা করেছে। কিন্তু নির্বাচনের পথে এখনো বাধা দেখছেন বিশ্লেষকরা। কারণ অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের এক বছর পার হলেও প্রশাসনে এখনো এলোমেলা অবস্থা রয়ে গেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এখনো ট্রমা কাটেনি। উদ্ধার হয়নি লুট হওয়া অনেক অস্ত্র। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ এখনো সরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপক তৎপরতা চালাচ্ছে। তারা চাচ্ছে না নির্বাচন হোক। এ ছাড়া দলটি আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে কি না, সে বিষয়টির নিষ্পত্তি এখনো হয়নি। আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশ না নিলে ভোটের হার কমে যাবে বলে অনেক বিশ্লেষক মনে করেন। অন্যদিকে জাতীয় পার্টিও নির্বাচনে অংশ নেবে কি না, তা নিয়েও রয়েছে অনিশ্চয়তা।
এর আগে বিএনপি-জামায়াত ও অন্যান্য দল নির্বাচনে অংশ না নেওয়ায় একতরফা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এদিকে জুলাই সনদ নিয়ে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির মধ্যে এখনো ঐকমত্য হয়নি। এমন পরিস্থিতিতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ গত শুক্রবার প্রেসক্লাবে এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘নির্বাচনের আগে কিন্তু দেশে অনেক গণ্ডগোল হবে। ভারতে আশ্রয় নিয়ে মাফিয়া নেত্রী শেখ হাসিনা এই দেশকে লণ্ডভণ্ড করার জন্য, নির্বাচন বানচাল করার জন্য অনেক সহিংস ঘটনার অবতারণা করবেন বলেও তিনি জানান।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. মাহবুব উল্লাহ বলেন, ‘জুলাই ঘোষণাপত্র ও জুলাই সনদের সঙ্গে নির্বাচনের কোনো সম্পর্ক নেই। তবে জুলাই ঘোষণা ও জুলাই সনদ স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়া উচিত। এ দুটি নিয়ে কারও কোনো আপত্তি থাকবে না এবং সেটা করা সম্ভব বলে আমি মনে করি। কিন্তু অনির্দিষ্টকালের জন্য নির্বাচন স্থগিত রাখলে দেশের জন্য সঠিক হবে না। এটা সবাইকে বুঝতে হবে। সবাই এটা দিনকে দিন উপলব্ধি করবে।’
তিনি বলেন, ‘পুলিশ প্রশাসন এখনো দুর্বল। আমি আশা করি, আগামী কয়েক মাসে প্রশাসনে নতুন করে নিয়োগ দিয়ে এবং অন্যান্য প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সক্রিয় করা হবে।’
রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. দিলারা চৌধুরী বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টার নির্বাচনের সময় ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েছে দেশের সব রাজনৈতিক দল এবং জনগণ। নির্বাচনের আগে কতগুলো বিষয় দৃশ্যমান হওয়া দরকার। বিশেষ করে পুলিশ প্রশাসনকে সক্রিয় করতে হবে। নির্বাচন কমিশনকে যথেষ্ট লোকবল নিয়োগ দিতে হবে। যাতে তারা সুষ্ঠু নির্বাচন করতে পারে। রাজনৈতিক দলগুলোকেও দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে।’
পুলিশ ও প্রশাসন এলোমেলো
অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের এক বছর পার হলেও পুলিশ ও প্রশাসন পুরোপুরি গতিশীল হয়নি। বিগত সরকারের সময় বিরোধী দল দমনে পুলিশের ব্যবহারের কারণে অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে তাদের প্রতি ব্যাপক ক্ষোভ ছিল জনমনে। সরকারের পতনের পর অনেক জায়গায় পুলিশের ওপর হামলা হয়। ফলে তাদের মনোবল ভেঙে পড়ে। সরকার মনোবল ফেরাতে কাজ করলেও এখনো পুরো স্বাভাবিক হয়নি। অনেককে প্রত্যাহার করা হয়েছে। বদলি করা হয়েছে। বিভিন্ন মামলায় গ্রেপ্তারও হয়েছেন পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা।
সরকার পতনের পর সচিবালয়েও ছিল অস্থিরতা। বিগত সরকারের সুবিধাভোগীদের বিরুদ্ধে প্রশাসন নিয়ন্ত্রণের অভিযোগও ওঠে। আন্দোলনের মুখে শিক্ষা সচিবকে সরিয়ে দেওয়া হয়। সরকার নির্বাচন সামনে রেখে মাঠ প্রশাসনে ইতোমধ্যে বদলি করছে। তবে পুরোপুরি শৃঙ্খলা ফেরেনি।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিন গত শনিবার বলেন, ‘নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা বড় চ্যালেঞ্জ। বিশেষ করে যে বিশেষ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে দেশে। তার পরও আমি বলব, গত বছরের জুলাই-আগস্টের পর আইনশৃঙ্খলার অনেক উন্নতি হয়েছে। ইলেকশন আসতে আসতে আরও ভালো হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সবাইকে নিয়ে আমরা এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি করতে চাই, মানুষ যাতে নির্ভয়ে পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারেন।’
বিএনপির সঙ্গে দ্বিমত এনসিপি ও জামায়াত, ঘোষণাপত্র নিয়ে অসন্তোষ
জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়ে বিএনপি সন্তুষ্ট হলেও জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) অসন্তুষ্ট। জুলাই সনদ নিয়েও দল তিনটির মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে মতভেদ রয়েছে। সংস্কার ও জুলাই গণহত্যার বিচার নিয়েও নানা মত। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন, সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব নির্বাচনের পদ্ধতি, প্রধান বিচারপতির নিয়োগ, প্রধানমন্ত্রীর একাধিক পদে থাকা, উচ্চকক্ষে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন, জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠন, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও দায়িত্ব এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার নিয়োগে নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে বিএনপি। এ নিয়ে বিএনপির বিপক্ষে সরব জামায়াত, এনসিপি, ইসলামী আন্দোলন, এবি পার্টিসহ অন্যরা। বিশ্লেষকরা বলছেন, এই ৯টি বিষয় সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত না হলে আবারও ফ্যাসিস্ট শাসক তৈরি হওয়ার সুযোগ আসবে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী দিলারা চৌধুরী বলেন, “জুলাই সনদ অন্তর্বর্তী সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলো কীভাবে তৈরি করবে, কীভাবে বাস্তবায়ন করবে সেই বিষয়ও খোলাসা করা প্রয়োজন। সনদের আইনি ভিত্তি কী হবে? কারণ জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে বিএনপি ৯টি বিষয়ে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়েছে। ফলে জুলাই সনদে সব দল স্বাক্ষর করবে কি না- এটাও বড় প্রশ্ন। এটা নিয়েও জনমনে ধোঁয়াশা রয়েছে। নিজেদের মধ্যে মতপার্থক্য থাকলেও ঐক্যবদ্ধ হয়ে সনদে স্বাক্ষর করতে হবে। তাহলে সংকট কেটে যাবে।”
উদ্ধার হয়নি লুট হওয়া অস্ত্র-গোলাবারুদ
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সময় বিভিন্ন থানা থেকে অস্ত্র লুট হয়ে যায়। গত ৩১ জুলাই সেনাবাহিনী প্রেস ব্রিফিংয়ে জানায়, আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত ১২ হাজার ১১৯টি হারানো অস্ত্রের মধ্যে সর্বমোট ৯ হাজার ৭২৯টি অস্ত্র উদ্ধার হয়েছে। ৩ লাখ ৯০ হাজার ৯৭৫ রাউন্ড হারানো গোলাবারুদের মধ্যে ২ লাখ ৮৭ হাজার ৩৩ রাউন্ড গোলাবারুদ উদ্ধার হয়েছে। লুট হওয়া সব অস্ত্র উদ্ধার না হলে আসন্ন নির্বাচনে এসব অস্ত্র ব্যবহারের আশঙ্কা রয়েছে বলে নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী বলেন, ‘থানা থেকে যেসব অস্ত্র লুট হয়েছে তা উদ্ধার করতে হবে। এ ছাড়া ৫ আগস্টের পরও দেশে নতুন অস্ত্র প্রবেশ করেছে বলে আমরা জানতে পেরেছি। তা নিয়ে জনমনে আতঙ্ক রয়েছে। জনগণ মনে করে, এখনো ৭০ শতাংশ অস্ত্র উদ্ধার হয়নি। এসব অস্ত্র উদ্ধার না হলে কীভাবে নির্বাচনের লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি হবে?’
নিষ্পত্তি লাগবে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি অংশগ্রহণ ইস্যু
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও তার নেতাদের বিচারকাজ সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত দলটির যাবতীয় কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে অন্তর্বর্তী সরকার। নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিয়ে এখনো সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত হয়নি। দলটির নেতা-কর্মীরা নির্বাচন বানচাল বা প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়েছেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। জাতীয় পার্টি অতীতে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল। আবার বিরোধী দলের ভূমিকায়ও ছিল। এসব কারণে ফ্যাসিস্ট সরকারের সহযোগী আখ্যা দিয়ে জাতীয় পার্টি নিয়ে নানা সময় প্রশ্ন তোলা হয়েছে। বিভিন্ন স্থানে দলের কার্যালয় ভাঙচুর করা হয়েছে। সব দলের অংশগ্রহণ নিয়ে কূটনৈতিক তৎপরতা লক্ষ করা গেছে। ফলে আসন্ন নির্বাচন নিয়ে জটিলতা কাটাতে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির ইস্যুটিও সমাধান করতে হবে। আওয়ামী লীগ প্রসঙ্গে ড. মাহবুব উল্লাহর অভিমত, যারা ফ্যাসিবাদীর সঙ্গে যুক্ত তাদের কোনো গণতান্ত্রিক দেশে অনুমোদন দেয় না।
এ প্রসঙ্গে ড. দিলারা চৌধুরী বলেন, ‘নির্বাচনের আগে সংস্কার এবং বিচার দৃশ্যমান করা জরুরি। প্রথমত সংস্কার সেভাবে এখনো দৃশ্যমান হয়নি। নির্বাচনের আগে মৌলিক সংস্কার দৃশ্যমান করা অত্যন্ত প্রয়োজন। ৫ আগস্ট প্রধান উপদেষ্টার ভাষণ নিয়েও জনমনে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। তার ভাষণে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি নির্বাচন করতে পারবে কি না, এটাও খোলাসা করা হয়নি। আওয়ামী লীগের বিচারও এখনো দৃশ্যমান হয়নি। জনগণের সামনে তাদের ব্যাপারে পরিষ্কার চিত্র না থাকায় জাতি বিভ্রান্ত হচ্ছে।’
রাজনৈতিক দলের নেতারা যা বলছেন
বিএনপির স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘নির্বাচনের পথে আমরা কোনো বাধা দেখছি না। জনগণ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে উন্মুখ হয়ে আছে। জনগণ তার গণতন্ত্র ফিরে পেতে চায়, জনগণ তাদের হারানো ভোটাধিকার ফিরে পেতে চায়। বিগত ১৬ বছর বিএনপি দেশের গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার আদায়ের জন্য লড়াই-সংগ্রাম করেছে। জনগণের কাছে দায়বদ্ধ ও জবাবদিহি সরকারের বিকল্প অন্য কিছু হতে পারে না। এখন আমাদের প্রথম দায়িত্ব হচ্ছে নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া শুরু করা এবং জনগণের জন্য জবাবদিহি ও দায়বদ্ধ সরকার প্রতিষ্ঠা করা।’
জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, ‘নির্বাচনের পথে এখনো অনেক বাধা রয়েছে। বিদ্যমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, সাংবিধানিক পদ্ধতি এবং যে নির্বাচন প্রক্রিয়া রয়েছে, ঠিক এই অবস্থায় কোনো নির্বাচন হলে তা নিরপেক্ষ হবে না। এগুলো সব পরিবর্তন করতে হবে। জুলাই সনদ তৈরি হচ্ছে, এটাকে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিয়ে এই সরকারের অধীনে তার ভিত্তিতে নির্বাচন হলে তা নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য হবে। সে জন্য আমরা বলেছি, এগুলো সংস্কার না করলে নির্বাচন নিয়ে সংশয় থেকে যাবে।’
তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ বা জাতীয় পার্টি নির্বাচনের ব্যাপারে তারা সিদ্ধান্ত নেবে এবং সরকার বলতে পারবে তাদের অবস্থান কী হবে। আমরা কিছু জানি না।’
নাগরিক ঐক্যর সভাপতি মাহামুদুর রহমান মান্না বলেন, জুলাই সনদ কোনো কিছুতে আটকাবে না। শিগগিরই আলোচনা শুরু হবে এবং নিষ্পত্তিও হবে। নির্বাচন হতে এখনো ছয় মাস সময় আছে। পুলিশ প্রশাসনের মধ্যে যে দুর্বলতা রয়েছে, তা কাটানোর জন্য ছয় মাস সময়ই যথেষ্ট।
তিনি বলেন, ‘নির্বাচনের আগে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। কেউ বলেনি, আমরা নির্বাচনে যাব না, নির্বাচন করতে দেব না। নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণের পর কেউ এই ধরনের কথা বলেনি।’
সম্পাদক মন্ডলীর সভাপতিঃ মোহাম্মদ আফছার খান সাদেক
সম্পাদক ও প্রকাশকঃ মিলাদ মোঃ জয়নুল ইসলাম
প্রকাশনালয়ঃ রিপোর্টার লজ, কসবা, বিয়ানীবাজার, সিলেট ।
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ উত্তর বাজার কেন্দ্রিয় মসজিদ মার্কেট (২য় তলা), বিয়ানীবাজার, সিলেট ।
মোবাঃ ০১৮১৯-৬৫৬০৭৭, ০১৭৩৮-১১ ৬৫ ১২
ইমেইলঃ agamiprojonma@gmail.com, milad.jaynul@gmail.com