প্রজন্ম ডেস্ক:
রাজধানীর ভাসানটেকের বাসিন্দা মো. নূর আলম। ব্যবসার সুবাদে ভাষানটেক থেকে মতিঝিলে যাতায়াত করেন নিয়মিত। এর বাইরে মাঝেমধ্যে গ্রামের বাড়ি সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরের জয়রামপুরে যান। সম্প্রতি গ্রামের বাড়িতে গিয়ে পুলিশ তার ভাইকে জানায়, তিনি (নূর আলম) জুলাইয়ের একটি হত্যাচেষ্টা মামলার আসামি। খবর শুনে একদিকে আক্ষেপ আরেক দিকে আতঙ্কে পড়ে যান তিনি। কোন মামলায় কীভাবে আসামি হলেন—সেটি জানতে ছুটে যান যাত্রাবাড়ী থানায়। গিয়ে দেখেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে গুলিবিদ্ধ হওয়া মো. রাহাত হোসেন নামে এক ভিক্টিম ঘটনার এক বছর পর গত ২০ জুলাই একটি মামলা (নম্বর-৭২) করেছেন। সেই মামলার ২৩ নম্বর এজাহারনামীয় আসামি তিনি। এরপর থেকে দুশ্চিন্তায় সময় পার করছেন তিনি। কেননা প্রতিবেশীদের অনেকেই মনে করছে—আওয়ামী লীগের পক্ষ নিয়ে ছাত্র-জনতার ওপর হামলা চালিয়েছেন তিনি।
নূর আলম দাবি করেন, গত ১৫ বছরেও তিনি যাত্রাবাড়ী এলাকায় যাননি। ব্যক্তিগতভাবে কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত নন। পূর্বশত্রুতাও নেই কারও সঙ্গে। এরপরও কে বা কারা কী উদ্দেশ্যে মামলায় তার নাম দিয়েছে বুঝতে পারছেন না।
শঙ্কা প্রকাশ করে তিনি বলেন, যে বা যারা আমাকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে আসামি বানিয়েছে—তারা চাইলে একই প্রক্রিয়ায় আমাকে গ্রেফতারও করাতে পারে। কিন্তু আমি তো এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত নই। এ জন্য সরকার ও পুলিশের ঊর্ধ্বতন মহলের নির্দেশনা থাকার পরও চিন্তামুক্ত থাকতে পারছি না। সবসময় অজানা ভয় কাজ করছে। আমি এর স্থায়ী সমাধান চাই। কেননা মামলার চার্জশিট হতে কয়েক বছরও লেগে যেতে পারে। অপরাধ না করে এত সময় আমাদের এক অজানা ভয় নিয়েই থাকতে হবে। শুধু নূর আলমই নন, একই ধরনের বিড়ম্বনায় পড়েছেন অনেক মানুষ। যারা নিজেকে মামলার আসামি হিসেবে আবিষ্কারের পর ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। এমনও ঘটেছে—জুলাই যোদ্ধা বা আন্দোলনে নিহত স্বজনদের বিরুদ্ধেও মামলা দায়ের করা হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে বাদী চেনেন না ভিক্টিমকে, ভিক্টিম চেনেন না সাক্ষীদের, একজন নিহতের ঘটনায় ৩ থানায় মামলা দায়েরের মতো ঘটনাও ঘটেছে। আবার পূর্বশত্রুতা, ব্যক্তিগত বিরোধ, জমিসংক্রান্ত দ্বন্দ্বের মতো ঘটনাতেও ঢালাও আসামি করার ঘটনা দেখা গেছে। আর মামলাবাণিজ্যের অহরহ ঘটনা ঘটার অভিযোগ তো রয়েছেই।
যদিও যাত্রাবাড়ীর মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তা আল ইমরান বলেছেন, সংশ্লিষ্টতা না পাওয়া পর্যন্ত কারও বিরুদ্ধেই কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে না। তবে প্রমাণ মিললে কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না।
মামলায় ঢালাও আসামি করার বিষয়ে পুলিশ সদর দফতরের অতিরিক্ত আইজিপি (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) খন্দকার রফিকুল ইসলাম বলেন, জুলাই আন্দোলনের ঘটনায় অনেকেই সাজানো মামলা করেছেন, আবার অনেকে নিরপরাধ মানুষদের আসামি করেছেন। এ বিষয়ে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) স্পষ্ট নির্দেশনা দিয়েছেন—নিরপরাধ মানুষদের হয়রানি করা যাবে না। আর চার্জশিটে তাদের নাম বাদ দিয়ে দিতে হবে। এগুলো মনিটরিংয়ের জন্য আমাদের একাধিক সেল কাজ করছে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যেকোনো মামলায় এজাহারনামীয় আসামি হলে তার স্থায়ী ঠিকানায় ইনকোয়ারিতে যায় পুলিশ। এতে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। যেহেতু একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে মামলাগুলো দায়ের হয়েছে সে ক্ষেত্রে বাস্তবতা মেনে নিয়ে এতটুকু মেনে নিতেই হবে। তবে কোনো নিরপরাধ ব্যক্তি যাতে হয়রানির শিকার না হন—সেদিকে আমরা সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে রয়েছি। আমাদের বার্তা স্পষ্ট—ঘটনার সঙ্গে জড়িত নন, এমন কাউকে হয়রানি ও গ্রেফতার করা যাবে না।
অন্যদিকে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সারা দেশে মামলা দায়ের শুরুর কিছু দিন পর থেকেই আলোচনায় আসে মামলাবাণিজ্যের প্রসঙ্গ। নিরপরাধ কাউকে যাতে হয়রানি করা না হয় সে জন্য কঠোর নির্দেশনা দিতে থাকে সরকার, আইন মন্ত্রণালয় ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংশ্লিষ্ট ইউনিটের প্রধানরা। মামলা নেওয়ার ক্ষেত্রে নিরপরাধ কারও নাম যাতে কোনো মামলাবাজ সিন্ডিকেট ঢুকাতে না পারে সে জন্য বেশ কিছু বিষয়ে সতর্ক থাকতে বলা হয়।
এমনকি সম্প্রতি আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেছেন, নিরপরাধ ব্যক্তিকে ভুয়া ও মামলাবাণিজ্য থেকে পরিত্রাণ দিতে সিআরপিসির বিদ্যমান ১৭৩এ আইনে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এনেছে সরকার। নতুন বিধানে বলা হয়েছে পুলিশ কমিশনার, এসপি বা পদমর্যাদার কোনো পুলিশ কর্মকর্তা ওনার নিয়ন্ত্রণাধীন কোনো মামলার বিষয়ে ওনার যদি মনে হয় যে এটা করা যৌক্তিক তাহলে তদন্তকারী যে কর্মকর্তা আছেন, তাকে তিনি বলতে পারেন, একটা প্রাথমিক রিপোর্ট দাও। সেই প্রাথমিক রিপোর্ট ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে জমা দেওয়ার জন্য এসপি বলবেন। ম্যাজিস্ট্রেট যদি মনে করেন এ মামলার মধ্যে ১০০ জন লোককে আসামি করা হয়েছে, ৯০ জনের ব্যাপারে কোনো অভিযোগ নেই। ৯০ জনের বিষয়ে কোনো সাক্ষী নেই। তাহলে তিনি সঙ্গে সঙ্গে ওই মামলা থেকে যাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই, তাদের মুক্ত করে দিতে পারবেন।
ঢালাও আসামির বিষয়ে আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক বলেন, মামলাগুলো এত বেশি ত্রুটিপূর্ণ হয়েছে যে দোষী ব্যক্তির শাস্তি নিশ্চিত করাই দুরূহ হয়ে উঠবে। একেকটি খুনে ২০০ জনকে আসামি করা হয়েছে। এসব মামলার সঠিক তদন্ত করতে গেলে পাঁচ বছরেও অন্য মামলার তদন্ত করতে পারবে না। আর এজাহারগুলো যেভাবে হয়েছে, তাতে করে আইন অনুযায়ী বিচার করে শাস্তি দিতে অনেক বছর লেগে যাবে। এখন সবাইকে চিন্তাভাবনা করে সমাধান বের করতে হবে।
অন্যদিকে শুধুই যে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত আসামিরাই ক্ষোভ প্রকাশ করছেন বিষয়টি তেমনও নয়। অনেক ক্ষেত্রে মামলার বাদীরাও আসামিদের চিনতে না পেরে ক্ষোভ ও বিচার নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। তেমনই একজন মোরশেদ আলম। গত বছরের ৫ আগস্ট স্বৈরাচার শেখ হাসিনার পতনের পর সোনাইমুড়ীতে আনন্দ মিছিলে অংশ নিয়ে পুলিশের গুলিতে আহত হন ছাত্রদল কর্মী মো. আসিফ। এর ১০ দিন পর চিকিৎসাধীন অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে তিনি মারা যান। এ ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলার এজাহারে আসামিদের নাম দেখে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন মামলার বাদী মোরশেদ আলম। কারণ কীভাবে মামলা হয়েছে তিনি জানেন না এবং যাদের আসামি করা হয়েছে এসব ব্যক্তিকে তিনি চেনেন না।
অন্যদিকে মামলার এজাহারের সঙ্গে কিছু হত্যাকাণ্ডের স্থান-কালের মিল নেই। মনগড়া সময় ও স্থান বসিয়ে দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। ঢাকার মিরপুর থানায় দায়ের হওয়া একটি মামলা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, শেরপুর জেলার ঝিনাইগাতী থানার আশরাফুল ইসলাম ঢাকায় গার্মেন্টসে চাকরি করতেন। জুলাই আন্দোলনের সময় মিরপুর মডেল থানার পাশে বুকে গুলি লেগে তিনি মারা যান। তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আসামিরা আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি চালালে ভিক্টিমের বুকে গুলি লাগে। এজাহারে উল্লিখিত ঘটনার সময় উল্লেখ করা হয়েছে—২০২৪ সালের ৪ আগস্ট সন্ধ্যা ৭টায়। কিন্তু তদন্তে পাওয়া যায়, ৪ আগস্ট নয়, পরদিন বেলা সাড়ে ৩টার দিকে এ হত্যাকাণ্ড ঘটেছে।
গত বছরের ৫ আগস্ট রাজধানীর বাড্ডায় ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের সড়কে ছাত্র-জনতার ওপর চালানো এলোপাতাড়ি গুলিতে নিহত হন শরীয়তপুরের তরুণ আল-আমিন। এ হত্যায় মামলা করেন তার চাচা রহমান মাল। মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে, রাত সাড়ে ৯টায় রাজধানীর ভাটারা থানার ১০০ ফিট রাস্তায় বিজয় উল্লাস ও আনন্দ মিছিল করার সময় গুলি করে আল-আমিনকে হত্যা করা হয়। তবে তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, এজাহারে নিহতের বাসা হাতিরঝিল এলাকায় উল্লেখ করা হলেও তার বাসা বাড্ডার দক্ষিণ আনন্দনগর এলাকায়। হত্যাকাণ্ডের স্থান ভাটারা এলাকায় উল্লেখ করা হলেও তিনি নিহত হন বাড্ডা থানার ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির সামনে। এরকম অসংখ্য ভুল একদিকে সুবিধা দিতে পারে প্রকৃত খুনিদের, অন্যদিকে ফেঁসে যেতে পারেন নিরপরাধ মানুষ, এমনটাই আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
পুলিশ সদর দফতরের তথ্য অনুযায়ী, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ঘটনায় ১ হাজার ৬০০-এরও বেশি মামলা হয়েছে। যার মধ্যে ৬৩৭টি হত্যা মামলা। এসব মামলা বিশেষভাবে তদারক করছে পুলিশ সদর দফতর। জানা যায়, জুলাই অভ্যুত্থানের ঘটনায় দায়েরকৃত মামলা তদন্তের জন্য পুলিশ হেডকোয়ার্টারে বিশেষ সেল গঠন করা হয়েছে। ৮টি বিভাগের জন্য ৮টি এবং ঢাকা মেট্রোপলিটন ও গাজীপুরের জন্য পৃথক দুটি সেল নিয়ে সারা দেশে ১০টি ‘মন্টেরিং অ্যান্ড মনিটরিং’ সেল গঠন করা হয়। আর ‘মানবাধিকার সাংস্কৃতিক ফাউন্ডেশন’ (এমএসএফ) থেকে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ঘটনায় আসামির সংখ্যা ৩ লাখেরও বেশি। প্রতিনিয়তই বাড়ছে মামলা আর আসামির সংখ্যা।
সম্পাদক মন্ডলীর সভাপতিঃ মোহাম্মদ আফছার খান সাদেক
সম্পাদক ও প্রকাশকঃ মিলাদ মোঃ জয়নুল ইসলাম
প্রকাশনালয়ঃ রিপোর্টার লজ, কসবা, বিয়ানীবাজার, সিলেট ।
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ উত্তর বাজার কেন্দ্রিয় মসজিদ মার্কেট (২য় তলা), বিয়ানীবাজার, সিলেট ।
মোবাঃ ০১৮১৯-৬৫৬০৭৭, ০১৭৩৮-১১ ৬৫ ১২
ইমেইলঃ agamiprojonma@gmail.com, milad.jaynul@gmail.com