প্রজন্ম ডেস্ক:
মাঠে কমবেশি সক্রিয় আছে এমন রাজনৈতিক দলগুলো জাতীয় নির্বাচন ও নির্বাচন-পূর্ব সংস্কার বাস্তবায়নকে সামনে রেখে এখন মোটামুটি চারটি পৃথক স্রোতে এগোচ্ছে। দলগুলোর এ বিভক্তি দৃশ্যত জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের কৌশল নিয়ে। তবে কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া প্রায় সবার মূল লক্ষ্য নির্বাচনের আগেই প্রভাব বিস্তারের জন্য জোট গড়ে ভোটে ভালো ফল করা।
এর মধ্যে তিন প্রধান দল বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী দুটি আলাদা জোট নিয়ে কাজ করছে। জামায়াত নিজের জোটে জাতীয় নাগরিক পার্টিকে (এনসিপি) টানার চেষ্টা করছে। তবে এনসিপি এখন পর্যন্ত বিএনপি ও জামায়াতের বাইরে আলাদা রাজনৈতিক পরিচিতি ও অবস্থান তৈরি করে এগোনোর চেষ্টা করছে। এনসিপি নেতাদের একটি অংশ বিএনপি ও জামায়াতের জোটের বাইরের কয়েকটি দল নিয়ে নতুন মোর্চা দাঁড় করানোর উদ্যোগ নিয়েছে।
প্রধানত জুলাই জাতীয় সনদের আইনি ভিত্তি কীভাবে দেওয়া হবে এবং ভবিষ্যতে আইনসভার সদস্য নির্বাচনের ক্ষেত্রে সরাসরি নির্বাচন অথবা ভোটের আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের (পিআর) মধ্যে কোন পন্থা অবলম্বন করা হবে, সে বিষয়ে মতভেদ থেকে দলগুলোর মধ্যে এমন বিভক্তি দেখা দিয়েছে।
বিএনপি চায় এখনই জুলাই সনদকে আইনি ভিত্তি না দিয়ে নির্বাচিত সংসদের জন্য রেখে দেওয়া। দলের নেতারা বলছেন, গণঅভ্যুত্থানের বছরপূর্তিতে অন্তর্র্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে যে জুলাই ঘোষণাপত্র দেওয়া হয়েছে, তাতেও বলা হয়েছে নির্বাচিত সংসদ সংস্কারের সনদ বাস্তবায়ন করবে। তবে জামায়াতে ইসলামীসহ ধর্মভিত্তিক বিভিন্ন দল এবং গণঅভ্যুত্থানের পর তৈরি হওয়া তরুণদের দল এনসিপি নির্বাচনের আগেই আইনি ভিত্তি দিয়ে সনদ বাস্তবায়নের দাবিতে অনড় অবস্থান নিয়েছে। এমন পরিস্থিতির মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ফেব্রুয়ারিতে ভোটের সম্ভাবনা বিবেচনায় রেখে বিএনপি নেতাকর্মী ও সমর্থকদের নির্বাচনমুখী করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন ও জুলাই সনদ বাস্তবায়নের বিষয়ে ঐকমত্য কমিশনে আলোচনা চলছে। সেখানেই আলোচনার মাধ্যমে সমাধান হতে পারে।’
সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, উন্মুক্ত আলোচনা চলছে, এমন অবস্থায় জামায়াতে ইসলামীসহ ইসলামি দলগুলোর রাজপথে নামার প্রয়োজন ছিল না। তিনি আশা প্রকাশ করেন, আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান হবে।
জামায়াতসহ ইসলামিপন্থি দলগুলো জুলাই সনদকে আইনি ভিত্তি দিয়ে পিআর পদ্ধতিতে আগামী ফেব্রুয়ারির মধ্যে জাতীয় নির্বাচন, ভোটে সবার সুযোগ নিশ্চিত করা, আওয়ামী লীগের বিচার এবং জাতীয় পার্টিকে নিষিদ্ধ করার দাবিতে দেশব্যাপী তিন দিনের কর্মসূচি পালন করছে।
ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক দলের ভিন্ন ভিন্ন মত থাকবে, এটাই স্বাভাবিক এমনটা উল্লেখ করে জামায়াত সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, ‘সংসদের উভয় কক্ষে পিআর ও জুলাই সনদের ভিত্তিতে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন চলছে। এ আন্দোলন অব্যাহত থাকবে।’ তিনি বলেন, এখন সরকারের দায়িত্ব সবাইকে নিয়ে আলাপ-আলোচনা করে চলমান সংকটের একটা সমাধান বের করা। এনসিপির ভেতরকার তথ্য অনুযায়ী, দলটি গণ অধিকার পরিষদসহ কয়েকটি দলের সঙ্গে রাজনৈতিক জোট গঠনের সম্ভাব্যতা যাচাই করছে। এনসিপির এক নেতা এ বিষয়ে দেশ রূপান্তরকে বলেন, জোট গঠনের বিষয়ে আলোচনা আছে। তবে এটি চূড়ান্ত কিছু নয়। পিআর ও জুলাই সনদ বাস্তবায়নের বিষয়টি সমাধানের পর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
জামায়াতসহ ইসলামি দলগুলো সনদ বাস্তবায়ন ও পিআর বিষয়ে সরকার ও বিএনপির ওপর চাপ বাড়াতে রাজপথের কর্মসূচিতে থাকলেও এনসিপি কৌশলগত কারণে আপাতত মাঠে নামছে না। এনসিপি নেতারা বলছেন, চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ইসলামি দলগুলো যেসব দাবিতে আন্দোলন করছে, সেসব দাবির সবগুলোর সঙ্গে তারা একমত নয়।
এ বিষয়ে এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক ও লিয়াজোঁ কমিটির প্রধান আরিফুল ইসলাম আদীব বলেছেন, ‘জামায়াত, ইসলামী আন্দোলন, খেলাফত মজলিসসহ কিছু দল উচ্চ ও নিম্ন উভয় কক্ষেই পিআর পদ্ধতি চায়। কিন্তু আমাদের দাবি শুধু উচ্চকক্ষে পিআর। যুগপৎ আন্দোলনে না যাওয়ার এটি অন্যতম একটি কারণ।’
আর ঢাকায় এনসিপির এক সমন্বয় সভায় আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘কোনো জোটভুক্ত আন্দোলনে নয়, নিজস্ব লক্ষ্য নিয়ে এনসিপি এগোবে।’
বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির মধ্যকার দূরত্ব বাড়তে থাকলে তা কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন মহল চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়ানোর জন্য তৎপর হতে পারে এমন আশঙ্কা দেখেন রাজনীতিকদের অনেকে। গণঅভ্যুত্থানের মুখে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ক্ষমতাচ্যুত হওয়া শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকলেও দলের নেতাকর্মীরা ছোট ছোট গ্রুপে বিক্ষোভে নামছেন। বাংলাদেশে সংস্কার ও নির্বাচন সামনে রেখে ভারতে আশ্রয় নেওয়া শেখ হাসিনা শেষ পর্যন্ত কী কৌশল নেবেন, তাও এখনো স্পষ্ট নয়।
এমন অবস্থায় বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির ইস্যুভিত্তিক দূরত্ব কমিয়ে ‘জুলাই ঐক্য’ অটুট রাখার ওপর জোর দিচ্ছেন অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান মুহাম্মদ ইউনূস ও রাজনীতিকদের একটি অংশ।
এ বিষয়ে গণতন্ত্র মঞ্চের শরিক বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, ‘জুলাই সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, এনসিপির মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে। এ দূরত্ব অব্যাহত থাকলে নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা তৈরি হতে পারে।’
সাইফুল হক বলেন, সাতটি ইসলামি দল এখনই আন্দোলন কর্মসূচি পালন করছে। এমন পরিস্থিতিতে দূরত্ব কমিয়ে আনতে গণতন্ত্র মঞ্চ কাজ করছে। পর্যায়ক্রমে বিএনপি, জামায়াত, ইসলামি দলগুলো ও এনসিপির সঙ্গে পৃথকভাবে বসে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের একটি পথ বের করে আনা যাবে এমন আশাবাদ তিনি প্রকাশ করেন।
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি বলেন, ‘বিএনপিসহ সবাইকে ছাড় দিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। না হলে যারা নির্বাচন বানচাল করতে চায়, তারা জয়ী হবে। এটা নিশ্চয়ই কেউ চাইবে না।’
জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সাবেক অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী মনে করেন, পিআর ও জুলাই সনদ বাস্তবায়নের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে ঐকমত্যে আসতে হবে। তিনি আশা প্রকাশ করেন, বড় রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি ছাড় দিয়ে এগিয়ে এলে রাজনীতিতে চলমান সংকট কেটে যাবে।
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টাম-লীর সদস্য অ্যাডভোকেট সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে অংশ নিতে তিনটি রাজনৈতিক দলের চারজন নেতাকে নিয়ে নিউ ইয়র্ক যাচ্ছেন। সেখান চলমান রাজনৈতিক সংকট নিয়ে আলোচনা হতে পারে।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা হুমায়ুন কবির, জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের ও এনসিপি সদস্য সচিব আখতার হোসেন নিউ ইয়র্ক সফরে প্রধান উপদেষ্টার সফরসঙ্গী হচ্ছেন। অক্টোবরের শুরুতে তারা দেশে ফিরবেন।
ড. ইউনূস ও তার সফরসঙ্গীরা যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফেরার পর দেশে নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি হবে, এমন আশাবাদ ব্যক্ত করে আলাল বলেন, ‘বাকিটা সময় বলে দেবে।’
সম্পাদক মন্ডলীর সভাপতিঃ মোহাম্মদ আফছার খান সাদেক
সম্পাদক ও প্রকাশকঃ মিলাদ মোঃ জয়নুল ইসলাম
প্রকাশনালয়ঃ রিপোর্টার লজ, কসবা, বিয়ানীবাজার, সিলেট ।
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ উত্তর বাজার কেন্দ্রিয় মসজিদ মার্কেট (২য় তলা), বিয়ানীবাজার, সিলেট ।
মোবাঃ ০১৮১৯-৬৫৬০৭৭, ০১৭৩৮-১১ ৬৫ ১২
ইমেইলঃ agamiprojonma@gmail.com, milad.jaynul@gmail.com