প্রজন্ম ডেস্ক:
তহিদুল আলম প্রথম যৌবনেই জীবিকার তাগিদে ভারতে পাড়ি জমিয়েছিলেন। সঙ্গে ছিলেন নববিবাহিতা স্ত্রী। থাকতেন মুম্বাইয়ে। সেখানেই তাদের এক ছেলে ও এক মেয়ের জন্ম। একে একে ৪৬টি বছর তিনি মুম্বাইয়ে কাটিয়েছেন। স্থানীয়দের সঙ্গে মিশে গেছেন। পরিবারের সবাই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন সেখানকার জীবনধারায়।
কিন্তু কাশ্মীরের পেহেলগামে পর্যটকদের ওপর হামলা, মে মাসে ভারত-পাকিস্তান সংঘাত এবং তার আগ থেকে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ‘অবনতিতে’ বাঁধে বিপত্তি।
একদিন মুম্বাই পুলিশ এসে তহিদুলের পরিবারের সবাইকে আটক করে থানায় নিয়ে যায়। তিনি আর ঘরে ফেরার সুযোগ পাননি।
মুম্বাইয়ে অনেক দিন আটকে রাখার পর তহিদুলের পরিবারের চারজনকে নিয়ে আসা হয় ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলায়। সেখানে বিএসএফের কাছে তাদের হস্তান্তর করা হয়।
২৬ জুন ভোরে ফেনী সদর উপজেলার জোয়ারকাছার সীমান্ত দিয়ে চারজনকে বাংলাদেশে ঠেলে দেয় বিএসএফ। এপাড়ে আসার পর বিজিবি তাদের আটক করে।
পরে বিজিবি তাদের ফেনী সদর মডেল থানায় হস্তান্তর করে। থানা পুলিশ চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার চাড়ালিয়া হাঁটি ইউনিয়নের পূর্ব মাইজভাণ্ডার গ্রামের স্বজনদের কাছে খবর পাঠায়। পরে তহিদুল, তার স্ত্রী হাজেরা খাতুন, ছেলে মো. শোয়েব ও মেয়ে মোছাম্মৎ শবনমকে তুলে দেওয়া হয় স্বজনদের কাছে।
ভারতীয় আইনে কাউকে আটক করলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তাকে আদালতে হাজির করার বিধান থাকলেও তহিদুলের ক্ষেত্রে তা করা হয়নি। ভারতীয় পুলিশ তাদের কোনো আদালতে হাজির করেনি; তহিদুল কোনো আইনি সুবিধা পাওয়ার সুযোগ পাননি।
শুধু তহিদুলের পরিবার নয়; মে মাস থেকে বাংলাদেশের বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে ব্যাপকহারে লোকজনকে ঠেলে দেওয়া শুরু করে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষা বাহিনী-বিএসএফ; যা আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন বলেছেন মানবাধিকার কর্মীরা। তবে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে নির্বিকার।
মহারাষ্ট্র, গুজরাট, রাজস্থান, হরিয়ানা, কেরালা, পশ্চিমবঙ্গ বিভিন্ন স্থান থেকে লোকজনকে ধরে ধরে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। রাজ্যগুলোতে ‘ডিটেনশন ক্যাম্প’ করে ‘অবৈধ অভিবাসীদের’ রাখার খবরও দেশটির গণমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে।
ঠিক কতজনকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া হয়েছে তার সঠিক সংখ্যা পাওয়া কঠিন। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে কিছু বলছে না।
বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবি বলছে, ৭ মে থেকে ৩ জুলাই পর্যন্ত দেশের ২২ জেলার সীমান্ত দিয়ে মোট এক হাজার ৮৮০ জনকে ঠেলে দিয়েছে ভারত। মৌলভীবাজার ও সিলেট সীমান্ত দিয়ে সবচেয়ে বেশি লোক এসেছে। আর নওগাঁ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া আর কুষ্টিয়া সীমান্ত দিয়ে এসেছে তুলনামূলক কম।
কয়েক যুগের সংসার, এক মুহূর্তে তছনছ
দেখা গেছে, অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হিসেবে শুধু বাংলাদেশি নয়, ভারতীয় বাঙলা ভাষাভাষিদেরও আটক করা হচ্ছে, বাংলাদে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের অভিযোগ, বিজিপি শাসিত রাজ্যগুলোতে এটা হচ্ছে। যাদের ঠেলে দেওয়া হচ্ছে, তাদের প্রায় সবাই মুসলমান। বিষয়টি সেদেশের আদালত পর্যন্ত গাড়িয়েছে।
এ ধরনের পরিস্থিতির মধ্যে অনেক অবৈধ বাংলাদেশি আবার স্বেচ্ছায় গিয়ে থানায় আত্মসমর্পণ করেছন। পরে তাদের বিএসএফের মাধ্যমে আইনি প্রক্রিয়াতেই বিজিবির কাছে হস্তান্তর করা হচ্ছে।
এই সময়ে কিছু রোহিঙ্গাকেও বাংলাদেশে ঠেলে দিয়েছে বিএসএফ; যারা মূলত মিয়ানমারের নাগরিক। সেই সংখ্যা দুইশর কাছাকাছি।
‘পুশ ইন’ বা ঠেলে দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে ঢাকা এরই মধ্যে উদ্বেগ জানিয়ে দিল্লিকে চিঠি দিয়েছে। কিন্তু তাতে অবস্থার পরিবর্তন হয়নি। বরং আরো অনেক মানুষকে ধরে এনে বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়ার জন্য সীমান্তবর্তী ভারতীয় রাজ্যগুলোতে জড়ো করার খবর পাওয়া যাচ্ছে।
এদিকে শূন্য হাতে বাড়ি ফিরে মানবেতর জীবনযাপন করছেন এই মানুষগুলো। তাদের কাছে ন্যূনতম যে কাগজপত্র, টাকা-পয়সা বা অন্যান্য জিনিসপত্র ছিল, সেগুলোও রেখে দেওয়া হয়েছে। নিজ দেশে এলেও কর্মহীন হয়ে পড়েছেন তারা। হঠাৎ করে মিলছে না কাজ। হাতে নেই অর্থকড়ি, তাই পরিবার নিয়ে সংসার চালাবেন কীভাবে–সেই ভাবনা কুড়েকুড়ে খাচ্ছে।
তহিদুলের মতই ২৩ মে কুড়িগ্রাম জেলার ভূরুঙ্গামারী উপজেলার সোনাহাট সীমান্ত দিয়ে ‘পুশইন’ করা হয়েছিল জিয়াউর ও আব্দুল জলিলের পরিবারের নয় সদস্যকে। দাসিয়ারছড়া সমন্বয়পাড়া গ্রামে তাদের বাড়ি। এই দাসিয়ারছড়া একসময় ছিল বাংলাদেশের ভেতরে অবস্থিত সর্ববৃহৎ ভারতীয় ছিটমহল।
জিয়াউরের স্ত্রী লিলি খাতুন ও আব্দুল জলিলের স্ত্রী বিলকিছ খাতুন জানান, তারা প্রায় ২২ বছর আগে পরিবারের সঙ্গে ভারতে গিয়েছিলেন। রাজস্থানের নিমকা থানার শ্রীরামের ভাটায় শ্রমিক হিসাবে কাজ করতেন। সেখানেই তাদের বিয়ে হয় এবং সন্তানও জন্ম নেয়।
এতদিন তাদের কোনো সমস্যা হয়নি। ৩ মে পুলিশ তাদের দুই পরিবারসহ ১২টি পরিবারের ৭০-৭৫ জন বাংলা ভাষাভাষীকে ধরে নিয়ে যায়।
২২ দিন আটক থাকার পর দীর্ঘ ৯-১০ ঘণ্টা বাসে পাড়ি দিয়ে ও একটি বিমানে তুলে আসামের গোয়াহাটি বিমান ঘাঁটিতে নিয়ে যাওয়া হয় তাদের। পরে তাদের বাংলাদেশে ঠেলে দেয় বিএসএফ।
এই দুই নারী বলেন, যে বিমানে তাদের নিয়ে আসা হয় তাতে প্রায় ২০০ বাংলা ভাষাভাষী নারী-পুরুষ ও শিশু ছিল। চারটি বাসে তাদেরকে সীমান্তে নিয়ে আসা হয়েছিল। অন্যদের ভারতীয় পুলিশ কোথায় নিয়ে গেছে তারা কিছুই জানেন না।
ফুলবাড়ি উপজেলার বালাটারি গ্রামের নবীর হোসেন ও তার পরিবারও ভারতে ২০ বছর কাটিয়েছেন। তিনি কিছুদিন ডিটেনশন ক্যাম্পেও ছিলেন। ২৭ মে তাদের সিলেট সীমান্ত দিয়ে তাদের ঠেলে দেওয়া হয়।
স্বেচ্ছায়ও ধরা দিচ্ছেন অনেকে
এসব এলাকার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, দাসিয়ারছড়া ও আশেপাশের এলাকা থেকে গত দুই দশকে কয়েকশ পরিবার দালালের মাধ্যমে ভারতের দিল্লি, পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও হরিয়ানার ইটভাটাসহ বিভিন্ন কাজ করতে গিয়েছিল।
তবে সীমান্তে কড়াকড়িসহ নানা কারণে অনেকেই বাড়ি ফিরতে পারেননি দীর্ঘদিন। গত অগাস্টে বাংলাদেশে সরকার পরিবর্তনের পর থেকেই অবৈধ শ্রমিকদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে ভারতীয় পুলিশ।
ব্যাপক ধরপাকড়ে আটক হওয়াদের থানা ও ডিটেনশন ক্যাম্পে কয়েকদিন রাখার পর সীমান্ত দিয়ে তাদের ঠেলে দেওয়া হচ্ছে দেশে। যাদের ক্যাম্পে থাকতে হয়েছে, সেখানে তাদের মানেবেতর জীবন কেটেছে। সে কারণে ভারতে বসবাসকারী শ্রমিকদের অনেকে ধরপাকড়ের হেনস্তা এড়াতে স্বেচ্ছায় ধরা দিচ্ছেন দেশে ফেরার জন্য।
তেমনি একজন হাসেন আলী। ২০ বছর আগে ভারতের হরিয়ানা প্রদেশের বাওয়ারী জেলার রামপুরা এলাকায় কাজের সন্ধানে গিয়েছিলেন তিনি। পরিবার নিয়ে সেখানে দেওয়ানের ইটভাটায় শ্রমিকের কাজ করতেন।
তিনি বলেন, মাসখানেক আগে হঠাৎ ভারতীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ভাটায় অভিযান চালিয়ে অনেক বাংলা ভাষাভাষীকে ধরে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যায়। পরে তাদের খোঁজ মেলেনি।
“তাই অজানা ভয়ে পরিবারের পাঁচ সদস্য নিয়ে কৌশলে পালিয়ে প্রায় তিন দিন ট্রেনে চেপে বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্ত এসে সরাসরি বিএসএফ ক্যাম্পে ধরা দিই। সেখানে আরো অনেককে দেখতে পাই।”
পরে তাদের পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার জন্য বিজিবির সঙ্গে যোগাযোগ করে বিএসএফ। গত ২৪ মে পরিচয় নিশ্চিত হয়ে ২৪ জন নারী-পুরুষ ও শিশুকে ফুলবাড়ির বালাটারী সীমান্ত দিয়ে বিজিবির নিকট হস্তান্তর করে।
২৭ মে চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলার বিভীষণ সীমান্ত দিয়ে ১৭ জনকে ঠেলে দিয়েছিল বিএসএফ। ১০-১২ বছর থেকে ভারতের হরিয়ানা রাজ্যে বসবাস করা এই মানুষদের সবার বাড়ি কুড়িগ্রাম জেলার ফুলবাড়ী থানায়।
তাদের একজন বুলু চন্দ্র সেন বলেন, “মোদী সরকার বাংলাদেশিদের সেখানে থাকতে দিচ্ছে না। আমাদের নির্যাতন করছে। তাই দিল্লি পুলিশের কাছে আমরা সারেন্ডার (আত্মসমর্পণ) করি। পরে দিল্লি পুলিশ হাওড়ার কুচবার স্টেশন থেকে বাসে করে নিয়ে এসে আমাদের বিএসএফ ক্যাম্পে রাখে।
“সেখানে এক দিন রেখে ২৭ মে রাত সাড়ে ১১টার দিকে বর্ডার পার করে ছেড়ে দেয়। তারপর রাতের অন্ধকারে কিছু চিনতে না পেরে একটা জায়গায় সবাই মিলে বসে ছিলাম। পরদিন সকালে স্থানীয় জেলেদের মাধ্যমে নদী পার হয়ে বিজিবির কাছে আত্মসমর্পণ করি।”
অবৈধভাবেও ফিরেছেন কেউ কেউ
দাসিয়ারছড়ার বাসিন্দা সিরাজুল ইসলাম তার পরিবার নিয়ে দেশে ফিরেছেন বিএসএফের চোখ ফাঁকি দিয়ে।
তিনি বলেন, “১০ বছর আগত ভারত গেছি। তখন থাকি কাজ করি, সমস্যা হয় নাই। হঠাৎ করি ভারতের প্রশাসন কড়াকড়ি কচ্চে। ভারতোত হামাক থাকপ্যার দেয় না। তাই পালে আচচি। ধরা পড়লে জেলোত থাকা লাগিল হয়।”
একইভাবে ফুলবাড়ী সীমান্ত দিয়ে পালিয়ে ফিরেছেন ওই এলাকার তাজুল ইসলাম, মানব আলী ও আব্দুল কাদের। সবার গল্প প্রায় একই রকম।
৩১ মে শেরপুরের নালিতাবাড়ী সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে ভারত থেকে দেশে ফেরার সময় নারী ও শিশুসহ ১১ জনকে গ্রেপ্তার করে বিজিবি।
পরে নালিতাবাড়ী থানায় দায়ের করা লিখিত এজাহারে বিজিবি ৩৯/সি কোম্পানির রামচন্দ্রকুড়া সীমান্ত ফাঁড়ির হাবিলদার মো. নাজমুল হুদা বলেন, ৩১ মে রাতের টহল দেওয়ার সময় পানিহাতা সীমান্ত এলাকায় পানিহাতা মিশনের পূর্ব পাশের সীমান্ত পিলারের আনুমানিক ৫০০ গজ বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পাহাড়ের মধ্যে সন্দেহজনকভাবে ঘোরাফেরা করতে দেখতে পান ওই ১১ জনকে।
ভোরবেলা ঘোরাঘুরির কারণ জিজ্ঞাসা করলে তারা পাহাড় দেখার জন্য এ স্থানে এসেছে বলে জানায় এবং একেক সময় একেক কথাবার্তা বলে। এ অবস্থায় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে তাদেরকে গ্রেপ্তার করে নালিতাবাড়ী থানায় নিয়ে আসেন।
পরে তারা জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেন, তারা সবাই নড়াইল ও খুলনা জেলার বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দা। ভারতে অবৈধভাবে অনুপ্রবেশ করে বাংলাদেশে ফেরত আসার সময় বিজিবির হাতে আটক হয়েছে।
তাদের কাছ থেকে ভারতীয় রুপি, দুটি মোবাইল ফোন ও সিমকার্ড জব্দ করা হয়েছে বলে এজাহারে জানান তিনি।
এখনো বন্দি শত শত বাংলাদেশি
নিরাপদে দেশে ফিরতে পারা অনেক পরিবারে স্বস্তি বোধ করছে। তারা বলছেন, এখনো ভারতের থানা ও ডিটেনশন ক্যাম্পে বন্দি আছেন শত শত বাংলাদেশি।
সেসব শ্রমিকদের পরিবারের সদস্যদের মধ্যে উদ্বেগ ও আতঙ্ক বিরাজ করছে। দ্রুততম সময়ে নিরাপদে তাদেরকে দেশে আনার ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সরকারের কাছে আকুতি জানিয়েছেন তারা।
ভারতে আটক থাকা আফজালের মেয়ে আলমিনা বলেন, ভারতীয় পুলিশ তার বাবাসহ তাদের পরিবারের সাতজনকে ঈদুল ফিতরের পরের দিন হরিয়ানা রাজ্যের রামপুরা থানার অন্তর্গত মুন্না ভগজি ভাটা থেকে ধরে নিয়ে যায়।
“আমরা আজও পর্যন্ত তাদের খোঁজখবর পাই নাই। জানি না তাদের ভাগ্যে কী ঘটেছে।”
রৌমারী উপজেলার বকবান্দা গ্রামের ছলিমুদ্দিনের ছেলে চাঁন মিয়ার বাড়িতে গেলে তার স্ত্রী মনোয়ারা বেগম কাঁদতে কাঁদতে বলেন, তার স্বামী একজন মৎস্যজীবী। ছয় সদস্যের পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী ব্যক্তি তিনি।
গত বছরের নভেম্বর মাসের প্রথম দিকে চাঁন মিয়া মাছ ধরার জন্য ভারতের আসাম রাজ্যে কালাপানি নদীতে ঢুকে পড়েন। কিন্তু কালয়েরচর নামক স্থানে চাঁন মিয়াকে আটক করে বিএসএফ।
পরে বিএসএফ চাঁন মিয়াকে ভারতের মহেন্দ্রগঞ্জ থানা পুলিশের হাতে সোপর্দ করলে আদালতের মাধ্যমে ধুবড়ী জেলার জেলহাজতে পাঠায়।
এপ্রিল মাসে জেল থেকে ছাড়া পেয়ে চাঁন মিয়া ফোনে এসব কথা বিস্তারিত জানিয়েছিলেন। একইসঙ্গে তাকে পুশইন করার জন্য সীমান্ত এলাকায় আটক রাখা হয়েছে বলেও জানিয়েছিলেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত তিনি না ফেরায় পরিবারের লোকজন দুশ্চিন্তায় আছে।
দাসিয়ারছড়ার বাসিন্দারা বলছেন, তাদের এলাকার শাহজাহান আলী, এরিনা বেগম, মোহাম্মদ আলী, স্বপ্না বেগমসহ শতাধিক মানুষ কাজ করতে গিয়ে পরিবার নিয়ে আটকা পড়েছেন ভারতে। স্বজনরা প্রতীক্ষা করছেন তাদের ফিরে আসার।
ছিটমহলের সাবেক ইউপি সদস্য আব্দুল মান্নান জানান, দাসিয়ারছড়া ছিটমহল বাংলাদেশে অর্ন্তভুক্ত হওয়ার পর বেশ কিছু পরিবার অবৈধভাবে ফিরে এলেও এখনও শতাধিক পরিবার আছে দিল্লি, হরিয়ানাসহ বিভিন্ন এলাকায়।
জীবিকার তাগিদে দালালদের সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে পরিবার পরিজনসহ অনেকেই ভারতে যেতে পারলেও কারো কারো বেলায় ঘটে বিপত্তি। ভারতে যাবার সময় ধরা পড়ে সোজা হাজতে যেতে হয়েছে অনেক পরিবারকে।
ভারতে পাড়ি জমানো অনেকে দু-একবছর আয় রোজগার করার পর টাকা-পয়সা নিয়ে দেশে ফেরার পথেও ধরা পড়ে সর্বস্ব হারানোর পাশাপাশি বন্দিজীবন কাটাচ্ছেন। স্ত্রী সন্তানসহ দুঃসহ জীবন কাটাচ্ছেন ভারতের জেলে।
তবে বেশিরভাগ দরিদ্র শ্রমিকই ভয় নিয়ে ভাটায় কাজ করে চলেছেন।
ফুলবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হারুন অর রশিদ বলেন, বিলুপ্ত ছিটমহল থেকে সহজেই ভারতে যাওয়ার সুযোগ তৈরি হওয়ায় ২০-২৫ বছর আগে অনেকেই ভারতে গিয়ে আর ফিরতে পারেননি। পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে অনেকেই স্বেচ্ছায় ধরা দিয়ে দেশে ফিরতে উদগ্রীব। যারা দেশে ফিরছেন তাদের পরিচয় যাচাই করে নিজ নিজ ঠিকানায় পাঠানো হচ্ছে।
ফুলবাড়ীর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রেহনুমা তারান্মুম জানান, যারা ভারত থেকে আসছেন, তাদের ঘরবাড়ি আছে। তারপরেও কেউ কর্মহীন বা অসহায় হলে খোঁজ নিয়ে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে তাদেরকে অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
‘এক কাপড়ে ঠেলে দিয়েছে বিএসএফ’
ভারত থেকে বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া রোহিঙ্গা জাহেদ আলমের অভিযোগ, গুলি করার হুমকির পাশাপাশি তাদের কাছে থাকা টাকা-পয়সা, কাগজপত্র সব কেড়ে নিয়েছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষা বাহিনী-বিএসএফ।
কক্সবাজারের কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আশ্রিত জাহেদ আলম বলেন, “আমাদের কাছে কিছু টাকা-পয়সা ছিল, কাপড় ছিল, ভারতের কারাগারের ডকুমেন্ট ছিল। কিন্তু বিএসএফ সবকিছু রেখে শুধু এক কাপড়ে আমাদেরকে এই প্রান্তে পাঠিয়েছে।”
তার ভাষ্য, নব্বইয়ের দশকের শুরুতে পরিবারের সঙ্গে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে এসে শরণার্থী হয়েছিলেন তিনি। তারপর নিবন্ধিত রোহিঙ্গা হিসেবে কুতুপালং ক্যাম্পে থাকতেন। সেখান থেকেই ভারতে গিয়েছিলেন নিজের গলার চিকিৎসা করানোর জন্য, কিন্তু সুস্থ হয়ে তিনি পরিবার নিয়ে সেখানেই থেকে যান।
জাহেদ সেখানে থাকার সময় ২০১৭ সালে ফের ‘রোহিঙ্গা ঢল’ নামে। তখন জাহেদ আলমসহ কিছু রোহিঙ্গা বাংলাদেশে চলে আসার উদ্যোগ নেন। জাহেদের পরিবারসহ ৩১ রোহিঙ্গা ভারত থেকে বাংলাদেশের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেন। কিন্তু আগরতলা আসার পর ভারতীয় পুলিশ তাদেরকে মিয়ানমারের নাগরিক বলে আটক করে। এরপর ‘মেহমান’ হিসাবে তারা সেখানাকার কারাগারে আটক ছিলেন।
জাহেদ বলেন, “ভারতীয় পুলিশ বলেছে, তোমাদেরকে মেহমান হিসাবে রেখেছি। তোমাদের দেশের পরিস্থিতি ভালো না, তাই ফেরত পাঠাতে পারছি না। দেশের পরিস্থিতি ভালো হলে তোমাদেরকে ফেরত পাঠানো হবে। এভাবে কয়েকদিনের কথা বলে ৬-৭ বছর আমাদেরকে আটকে রাখে হিন্দুস্তানি পুলিশ।”
প্রায় দেড় মাস অনশনের পর এক পর্যায়ে ভারতীয় সরকার তাদেরকে ফেরত পাঠানোর আশ্বাস দেয় জানিয়ে তিনি বলেন, “কারামুক্তির জন্য আমরা ভুখ-হরতাল করেছি। ভারতীয় পুলিশের কাছে মিনতি করেছি। এরপর তারা একটি পদ্ধতি বের করে আমাদেরকে পাঠানোর। তবে আমাদেরকে যে চোরাই পথে বাংলাদেশে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তা আমরা জানতাম না।”
এমনকি কোন সীমান্তে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তাও বলা হয়নি জানিয়ে জাহেদ বলেন, “কারাগার থেকে বের করে প্রথমে আমাদেরকে তাদের অফিস কক্ষে আটকে রাখে। এরপর সন্ধ্যা ৬টার দিকে গাড়ি ডেকে বর্ডারের উদ্দেশ্যে নিয়ে যায়।”
জাহেদ বলেন, “আমরা পথ-ঘাট কিছুই চিনি না। বর্ডার বলে কোথায় নিয়ে যাচ্ছিল তাও জানতাম না। এক পর্যায়ে গাড়ি থামিয়ে আমাদেরকে নামানো হল।”
পরে রাত দেড়টায় বাংলাদেশের সীমান্তের গেইট খুলে দেয় বিএসএফ। তারপর তাদের সর্বস্ব নিয়ে নিঃস্ব করে এই প্রান্তে পাঠিয়ে হুঁশিয়ারির সুরে ভারতীয় এ বাহিনীর সদস্যরা বলে, আরেকবার বর্ডারের ওই প্রান্তে গেলে গুলি করা হবে।
বাংলাদেশ সীমান্তে ঢোকার পর বিনা বাধায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পৌঁছানোর কথা জানিয়ে জাহেদ বলেন, “এই প্রান্তে আসার পর তেমন কোনো বাঁধা পাইনি। পুলিশ-বিজিবি কাউকেই দেখিনি। জিজ্ঞেস করে করে গাড়ি পালটে পালটে সোজা ক্যাম্পে চলে এসেছি।”
জাহেদ জানান, বর্তমানে কুতুপালং ক্যাম্পে বোনের কাছে পরিবার নিয়ে বসবাস করছেন তিনি। কিন্তু নিবন্ধন না থাকায় দিনযাপন করতে কষ্ট হচ্ছে।
জাহেদ আলমের পরিবারসহ মোট ৩১ জনকে পাঠানো হয় উখিয়ার শরণার্থী শিবিরে।
শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের কার্যালয় থেকে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত দুই শতাধিক রোহিঙ্গাকে ঠেলে পাঠিয়েছে ভারত, যাদের অনেকেই জাতিসংঘ শরণার্থীবিষয়ক হাই কমিশনারের (ইউএনএইচসিআর) কার্ডধারী।
ভারত সামগ্রিকভাবে আইন ভাঙছে কি-না এবং এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ রয়েছে কি-না জানতে চাইলে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, “এটা ফরেন মিনিস্ট্রির ব্যপার, বিষয়টা ফরেন মিনিস্ট্রি ডিল করে।”
রোহিঙ্গাদের ঠেলে পাঠানোর বিষয়ে তিনি বলেন, “এটা কনটিনিউ হচ্ছে। রোহিঙ্গারা যেহেতু মিয়ানমারের নাগরিক। তাদেরকে মিয়ানমারে পুশইন করাটাই যৌক্তিক, বাংলাদেশে পুশইন করা অযৌক্তিক।”
চাইলে জাতিসংঘ এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে পারে মন্তব্য করে মিজানুর রহমান বলেন, “ইউএনএইচসিআর কার্ডধারীরা বাংলাদেশে আসছে, এটা তো তাদের দায়িত্ব এ বিষয়ে কাজ করা। আমি জানি না তারা কী ব্যবস্থা নিয়েছে।
“একটা রোহিঙ্গা ঢুকতে চাইলে, যখন বিজিবি তাকে পুশব্যাক করে মিয়ানমারে। তখন ইউএন আমাদেরকে চিঠি লেখে, তার মানে নিশ্চয় ইন্ডিয়া থেকে যারা আসছে তাদের ব্যাপারেও ইউএন কনসার্ন।”
‘বাংলাদেশ কখনও আন্তর্জাতিক আদালতে যায়নি’
ভারত ও বাংলাদেশের অবৈধ অভিবাসীদের নিয়ে কাজ করে ‘রাইটস যশোর’ নামে একটি বেসরকারি সংস্থা। তারা অনুপ্রবেশের দায়ে আটক এবং দণ্ডিতদের আইনি সহায়তা দিয়ে থাকে।
‘রাইটস যশোর’ এর নির্বাহী পরিচালক বিনয় কৃষ্ণ মল্লিক বলছিলেন, “পুশইন প্রতিরোধে বর্ডার কন্ট্রোল অ্যাক্ট রয়েছে। পুশইন করে বিএসএফ ওই আইন লংঘন করছে।”
তিনি বলেন, অবৈধ কাউকে বৈধভাবে পাঠানোর প্রক্রিয়া হল– প্রথমে হাই কমিশনের মাধ্যমে যাচাই করতে হবে, তারপর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এসবি রিপোর্টের মাধ্যমে নিশ্চিত হবে। তারপর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ট্র্যাভেল পাসের মাধ্যমে তাদের দেশে পাঠাতে হবে। এটা না হলে আইনের ব্যত্যয় হয়।
সুযোগ থাকলেও বাংলাদেশ কখনও এ নিয়ে আন্তর্জাতিক আদালতের দ্বারস্ত হয়নি জানিয়ে তিনি বলেন, “ভারত একসঙ্গে অনেক পুশইন করে না। কয়েক দিনের ব্যবধানে ৫-৬ অথবা ১০ জন করে পুশইন করে, আন্তর্জাতিক আদালতে যাওয়ার ক্ষেত্রে যা সিলি ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।”
বিনয় কৃষ্ণ মল্লিক বলেন, এখন পর্যন্ত কাউকে ‘পুশব্যাক’ করার কোনো ঘটনা তার জানা নেই।
আন্তর্জাতিক আইনে ‘পুশইন বা পুশব্যাকের’ কোনো নির্দিষ্ট সংজ্ঞা নেই। তবে এটি সাধারণত ‘নন-রিফাউলমেন্ট’ বা অ-প্রত্যর্পণ নীতির লঙ্ঘন হিসেবে বিবেচিত হয়।
১৯৫১ সালের শরণার্থী কনভেনশনের ৩৩ (১) ধারা অনুযায়ী ‘নন-রিফাউলমেন্ট’ নীতি প্রযোজ্য। এ নীতি অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তিকে এমন দেশে পাঠানো যাবে না যেখানে তার প্রাণ বা স্বাধীনতা হুমকির মুখে পড়বে। এই নীতি অন্যান্য আন্তর্জাতিক মানবাধিকার চুক্তিতে অন্তর্ভুক্ত।
‘পুশইন’ প্রক্রিয়ায় ব্যক্তিদের কোনো আইনি প্রক্রিয়া ছাড়াই ফেরত পাঠানো হয়, যা আন্তর্জাতিক আইনের এই মৌলিক নীতির পরিপন্থি।
বিশেষ করে, ইউরোপীয় মানবাধিকার কনভেনশনের প্রোটোকল ৪-এর ধারা ৪-অনুযায়ী শরণার্থীদের সমষ্টিগত বহিষ্কার নিষিদ্ধ।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এবং হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বহুবার দক্ষিণ এশিয়ার সীমান্তে ‘পুশইন’ প্রক্রিয়াকে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন হিসেবে বর্ণনা করেছে। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন এবং ব্যক্তিকে রাষ্ট্রবিহীন করে তোলার ঝুঁকি তৈরির কারণে তারা এই প্রক্রিয়ার সমালোচনা করে আসছে।
২০১৮ সালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছিল, “ভারতের পুশব্যাক নীতিতে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘিত হয় এবং এতে মানুষ রাষ্ট্রবিহীন হওয়ার ঝুঁকিতে পড়ে।”
সম্পাদক মন্ডলীর সভাপতিঃ মোহাম্মদ আফছার খান সাদেক
সম্পাদক ও প্রকাশকঃ মিলাদ মোঃ জয়নুল ইসলাম
প্রকাশনালয়ঃ রিপোর্টার লজ, কসবা, বিয়ানীবাজার, সিলেট ।
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ উত্তর বাজার কেন্দ্রিয় মসজিদ মার্কেট (২য় তলা), বিয়ানীবাজার, সিলেট ।
মোবাঃ ০১৮১৯-৬৫৬০৭৭, ০১৭৩৮-১১ ৬৫ ১২
ইমেইলঃ agamiprojonma@gmail.com, milad.jaynul@gmail.com