প্রজন্ম ডেস্ক:
‘এত দামে ইলিশ কিনে খাওয়া যায়? লাখ টাকার বেশি বেতন পাই, তবু ইলিশের বাজারে যেতে ভয় পাই। একটু বড় সাইজের হলেই আড়াই থেকে ৩ হাজার টাকা ইলিশের কেজি! এটা কি কোনো স্বাভাবিক ব্যাপার? মৌসুম চলে যাচ্ছে, অথচ এ বছরে ইলিশই খাওয়া হয়নি।’
কথাগুলো বলছিলেন ঢাকার একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরিরত এক কর্মকর্তা। বৃহস্পতিবার (২৬ সেপ্টেম্বর) মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটে বাজার করার সময় এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে এমন ক্ষোভ ঝাড়লেন তিনি। তিনি জানান, লাখ টাকার বেশি বেতন হলেও বাড়ি ভাড়া, ছেলেমেয়ের স্কুলের বেতনসহ পড়ার খরচ জোগান দেওয়ার পর আর যে টাকা হাতে থাকে তাতে অন্য অনেক খরচ কোনোমতে চললেও ইলিশ কেনা যায় না। কারণ এক কেজি ইলিশের টাকা দিয়ে অন্য যেকোনো ধরনের মাছ তিন থেকে চার কেজি কেনা সম্ভব। ফলে তিনি বছরের বেশির ভাগ সময় সেই পথেই হাঁটেন।
কৃষি মার্কেটে বেসরকারি কোম্পানির ওই কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপকালেই সেখানে ভিড় করেন আরও দু-একজন ক্রেতা। শাহেদ আবেদীন নামে এদের একজন জানালেন, তার স্ত্রী বাজার থেকে দুটি ইলিশ কিনে দেওয়ার আবদার করেছেন। কিন্তু দাম যেন স্ত্রীকে বলা না হয়। কারণ দাম শুনলে নাকি তিনি ইলিশ খেতে পারবেন না!
কেবল শাহেদ আবেদীন বা তার পরিবার নয়, এবার ইলিশের অস্বাভাবিক দাম নিয়ে ক্ষোভ-আক্ষেপ প্রায় সবারই। বিশেষ করে নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের অনেকটা নাগালের বাইরে চলে গেছে দেশের এই জাতীয় মাছ। অল্প কিছুদিন আগেও যেখানে ধনী-গরিব নির্বিশেষে প্রায় সবাই মৌসুমে পর্যাপ্ত ইলিশ খেতে পেরেছেন, সেখানে এ বছর অনেকেই একটি ইলিশ কিনে পরিবার নিয়ে খেতে পারেননি। কেউ কেউ জাটকা কিনে খেয়েই ইলিশের স্বাদ নেওয়ার চেষ্টা করেছেন।
ইলিশের অস্বাভাবিক দাম নিয়ে তথ্য অনুসন্ধান চালাতে গিয়ে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পর্যায়ে কথা হয়। এতে পাওয়া গেছে আক্ষেপ-অভিযোগসহ নানা রকম তথ্য।
উচ্চমূল্যের কারণে বাজারে গিয়ে ঘুরপাক খাচ্ছেন ক্রেতারা
রাজধানীর কারওয়ান বাজার, মোহাম্মদপুর, পরীবাগসহ বিভিন্ন বাজার ঘুরে গতকালও দেখা গেছে, এক কেজি বা তার কিছু বেশি ওজনের ইলিশ কমবেশি আড়াই হাজার টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। অন্যদিকে এক কেজির নিচে এবং ৫০০ গ্রামের ওপরের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৬০০ থেকে ২ হাজার টাকায়।
এর আগে গত শুক্রবার (১৯ সেপ্টেম্বর) সকাল ৮টায় দেখা যায়, কারওয়ান বাজারে রেলগেটের বেশ কিছুটা পশ্চিমে ফুটপাত ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে ‘পার্ল কালারের’ নিশান ব্র্যান্ডের এক্স-ট্রায়াল মডেলের একটি দামি গাড়ি, যার রেজিস্ট্রেশন নম্বর ঢাকা মেট্রো ঘ-১৭-০৬৭৩। গাড়ি থেকে নেমে এক ব্যক্তি সরাসরি চলে যান ফুটপাতে বসা ইলিশের দোকানগুলোর সামনে। ওই ব্যক্তির পেছনে পেছনে ব্যাগ হাতে নিয়ে ঘুরছিলেন গাড়িটির চালক। দুই-তিনটি দোকান ঘুরে এক জায়গার দামাদামি চলছিল। সেখানে দেড় কেজি বা কিছু কমবেশি আকারের ইলিশ ছিল। ব্যবসায়ী ৩ হাজার টাকা কেজি দাম হাঁকিয়ে পরে ২ হাজার ৮০০ টাকা কেজি হিসেবে একদাম বলে দেন। পরে ওই গাড়িতে আসা ব্যক্তি আরও বড় সাইজের ইলিশ যা আছে বের করতে বলেন।
প্রায় একই সময়ে বাজারে দেখা যায় মধ্যবিত্ত ক্রেতাদেরও। এমনই একজন ক্রেতা রফিকুল ইসলাম। আলাপকালে জানান, তিনি বনানীর একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের এক্সিকিউটিভ (নির্বাহী)। বাজার ঘুরে কেনেন জাটকার চেয়ে একটু বড় আকারের (গড়ে চারটি মাছে এক কেজি) ইলিশ।
এ সময় রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘এবারের মৌসুমজুড়ে ইলিশের এত বেশি দাম যে একবারের জন্যও কেনা হয়নি। বাসায় বাচ্চাদের বায়নার কারণে ইলিশ কিনতে আসা। কিন্তু বড় একটি ইলিশ কিনতে গেলে ৩ থেকে ৫ হাজার টাকা লাগবে, যা বেতনে কুলাবে না।’
ওই বাজারে ইলিশ কেনার উদ্দেশ্যে এসেছিলেন পশ্চিম রাজাবাজারের একটি আবাসিক ভবনের তত্ত্বাবধায়ক (কেয়ারটেকার) ইউনুস আলী। আলাপকালে ইউনুস আলী বলেন, ‘গত বছরও বিভিন্ন সময়ে অনেকবার ইলিশ খেয়েছি। বাসায় মেয়েরা ইলিশ বলতেই পাগল, খুব পছন্দ করে। কিন্তু এ বছর এত দাম, বউ-বাচ্চাদের একবারের জন্য ইলিশ কিনে খাওয়াতে পারিনি। মোটামুটি আকারের একটি ইলিশ কেনার জন্য বড় আশা করে কারওয়ান বাজারে এসেছিলাম। কিন্তু যে দাম, তাতে আমার কেনার সাধ্য নেই। দেখি, জাটকা নিয়েই হয়তো বাসায় ফিরব।’
কারওয়ান বাজারের একাধিক ইলিশ ব্যবসায়ী জানিয়েছেন, মাঝারি থেকে বড় সাইজের ইলিশ এখন বিত্তশালী লোকজন ছাড়া তেমন কেউ কিনতে পারছেন না। ছোট বা জাটকাজাতীয় ইলিশ কিনে খাচ্ছেন সাধারণ বা নিম্ন-মধ্যম আয়ের ক্রেতারা। এ ছাড়া বড় বড় ব্যবসায়ী, শিল্পপতি বা সরকারি ঊর্ধ্বতন অনেক কর্মকর্তা আছেন, যারা নির্দিষ্ট মাছ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে সরাসরি ইলিশ কিনে থাকেন। কেউ কেউ আবার অনলাইনেও ইলিশ কেনেন।’
সুপারশপে ইলিশের দাম
গত এক সপ্তাহে কয়েকটি সুপারশপ ঘুরে দেখা যায়, সেখানে ইলিশের দাম বাজারের তুলনায় আরও কিছুটা বেশি। গত মঙ্গলবার বেলা ৩টায় পান্থপথে স্কয়ার হাসপাতালসংলগ্ন ভবনে ‘স্বপ্ন’ সুপারশপে গিয়ে দেখা যায়, আকারভেদে ইলিশের দাম উল্লেখ করে কেজি ও পিস হিসেবে বিক্রির জন্য রাখা । এর মধ্যে ১ কেজি ২০০ গ্রাম থেকে দেড় কেজি ওজনের ইলিশের (নদীর বলে উল্লেখ ছিল) কেজি মূল্য ৩ হাজার ৫০ টাকা লিখে রাখা। সেই হিসাবে দেড় কেজি ওজনের একটি ইলিশের দাম সাড়ে ৪ হাজার টাকারও বেশি। তবে এই সুপারশপে ১ কেজি থেকে ১ কেজি ১৯৯ গ্রামের মধ্যে ওজনের ইলিশের কেজি ২ হাজার ৪৯০ টাকা লেখা। এ ছাড়া আধা কেজির বেশি এবং এক কেজির নিচের ইলিশ কয়েকটি শ্রেণিতে ৮৫০ থেকে ১ হাজার ৬৯০ টাকা কেজি মূল্যে দাম লিখে রাখতে দেখা যায়।
গত মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ধানমন্ডির ৫ নম্বর সড়কের স্বপ্ন সুপারশপে বাজার করতে যান ওই এলাকার একজন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নারী কর্মকর্তা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই ক্রেতা বলেন, ‘ইলিশ কেনার ইচ্ছা থেকে সেখানে গিয়েছিলাম। কিন্তু দাম এত বেশি যে আর কেনা হলো না। এক কেজি ওজনের ইলিশ ২ হাজার ৩০০ টাকার বেশি ছিল। এ ছাড়া ছোট আকারের ইলিশ দেখলাম, যেগুলো মাথা ও লেজ মিলে পাঁচ টুকরার বেশি হবে না, সেটার দামও ৮০০ টাকার বেশি। মনে হলো জাটকারও বাচ্চা! জাটকার বাচ্চা যদি ৮০০ টাকা কেজি কিনতে হয়, তাহলে কি ইলিশ খাওয়া যায়?’
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কেবল ‘স্বপ্নে’ নয়, অন্য সব সুপারশপেও ইলিশের মূল্য প্রায় একই রকম।
যা বলছেন উপকূলীয় জেলে ও ব্যবসায়ীরা
বরগুনা জেলা ফিশিং ট্রলার শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক দুলাল মাস্টার বলেন, “ সাগরে নিম্নচাপ শুরু হওয়ায় আবারও ইলিশ কমতে শুরু করেছে। কিন্তু এর আগে মৌসুমজুড়েই প্রচুর পরিমাণে মাঝারি ও ছোট আকারের ইলিশ পাওয়া গেছে। সেই তুলনায় বড় ইলিশের সরবরাহ কম ছিল। কিন্তু যেভাবে ঢাকায় ইলিশ সংকটের কথা আমরা শুনছি, এখানে সে রকম অবস্থা হয়নি। উপকূল ও নদীতে চিংড়ি ধরার নামে বিপুল পরিমাণে ইলিশের বাচ্চা বা জাটকা ধ্বংস করা হচ্ছে। প্রশাসন চাইলেই এগুলো বন্ধ করতে পারে বা পারত। কিন্তু ‘মানি ইজ সেকেন্ড গড’। আর কিছু বলতে চাই না।”
বরগুনা জেলা ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি ও মৎস্য আড়তদার মোস্তফা চৌধুরী বলেন, গত বছরের তুলনায় বড় ইলিশ এবার অনেক কম। কিন্তু ছোট বা মাঝারি ইলিশের সরবরাহ ছিল প্রচুর পরিমাণে। এবারে সবচেয়ে খারাপ লাগার বিষয় হচ্ছে- নির্বিঘ্নে-নির্বিচারে জাটকা বা বাচ্চা ইলিশ ধ্বংস করা হয়েছে, যার ফলে ইলিশের সংকট বেড়েছে। আগামীতেও এভাবে চলতে থাকলে সংকট আরও বাড়বে।
ইলিশ উৎপাদন নিয়ে যা বলছেন বিশেষজ্ঞরা
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএফআরআই) বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আবু কাওসার দিদার বলেন, ‘সাগর-নদীতে তুলনামূলক কম ইলিশ পাওয়ার জন্য এবারে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বৃদ্ধিও অন্যতম একটা কারণ। তবে ইলিশ মাছ উৎপাদনই হয়নি বা একেবারে পাওয়া যাচ্ছে না- এমনটা সত্য নয়। এটা একধরনের কারসাজি হতে পারে। এটা ঠিক যে আগের দুই-তিন বছরের তুলনায় ইলিশের উৎপাদন সামান্য কিছু কমেছে। কিন্তু সেটা অনেক বেশি নয়।’
আবু কাওসার দিদার আরও বলেন, প্রাকৃতিক বা জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটেছে। অসময়ে বৃষ্টিপাতসহ এ বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগ অনেক ছিল। শরৎকালেও বৃষ্টি-বাদল হচ্ছে, ফলে নদীতে স্রোত বেড়েছে। অন্যদিকে গত কয়েক বছরের তুলনায় এবারে অনেক বেশি পরিমাণে জাটকা নিধন বা অবৈধ মাছ শিকার হয়েছে।’
একই প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. হাসান ফারুক বলেন, জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত মূলত ইলিশের প্রধান মৌসুম। এই সময়ে বড় সাইজের ইলিশগুলো ধরা পড়ে। কিন্তু এখন জেলেরা সেভাবে ইলিশ পাচ্ছেন না। এটা অনেকটা জলবায়ুগত প্রভাব থেকেও হতে পারে। তবে এখন পাওয়া যাচ্ছে না বলে আগামীতে পাওয়া যাবে না- সেটা বলা যাবে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষক আরও বলেন, ‘বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত ইলিশ সমুদ্রের কতখানি গভীর পর্যন্ত অবস্থান বা চলাচল করে এবং তীরবর্তী অবস্থান থেকে কতটুকু গভীরে থাকছে, সেটি নিয়ে এখন পর্যন্ত আমাদের পর্যাপ্ত গবেষণা নেই। ডিপ-সি (গভীর সমুদ্র) বা সেই জায়গাগুলোতে এখন পর্যন্ত আমাদের মাছ ধরার সক্ষমতা নেই। এই বিষয়গুলো গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে।’
ইলিশ উৎপাদনের পরিসংখ্যান কী বলছে
মৎস্য অধিদপ্তরের ২০২৩-২৪ সালের ‘ইয়ারবুক অব ফিশারিজ স্ট্যাটিস্টিকস অব বাংলাদেশ’-এর পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, দেশে যত মাছ উৎপাদন হয় তার প্রায় ১০ দশমিক ৫৫ শতাংশ হচ্ছে ইলিশ। তবে ইলিশ উৎপাদনের হার ২০২২-২৩ অর্থবছরের তুলনায় পরের বছর ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৭ দশমিক ৩৩ শতাংশ কমেছে।
ওই পরিসংখ্যানে বিগত ২২ বছরের ইলিশ উৎপাদনের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। সেখানে দেখা যায়, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ইলিশ উৎপাদন হয়েছে ৫ লাখ ২৯ হাজার মেট্রিক টন। তার আগের বছরে ইলিশ উৎপাদন হয় ৫ লাখ ৭১ হাজার মেট্রিক টন, যা দীর্ঘ ২২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ উৎপাদন। তবে ২০০২-০৩ অর্থবছরে উৎপাদন ছিল মাত্র ১ লাখ ৯৯ হাজার মেট্রিক টন। এর পর থেকে পর্যায়ক্রমে বাড়তে থাকে।
সম্পাদক মন্ডলীর সভাপতিঃ মোহাম্মদ আফছার খান সাদেক
সম্পাদক ও প্রকাশকঃ মিলাদ মোঃ জয়নুল ইসলাম
প্রকাশনালয়ঃ রিপোর্টার লজ, কসবা, বিয়ানীবাজার, সিলেট ।
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ উত্তর বাজার কেন্দ্রিয় মসজিদ মার্কেট (২য় তলা), বিয়ানীবাজার, সিলেট ।
মোবাঃ ০১৮১৯-৬৫৬০৭৭, ০১৭৩৮-১১ ৬৫ ১২
ইমেইলঃ agamiprojonma@gmail.com, milad.jaynul@gmail.com