প্রজন্ম ডেস্ক:
আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর তৎপরতায় দেশের পার্বত্য অঞ্চল ফের উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। নানা অজুহাতে বিভিন্ন ‘ইস্যু’ তৈরি করে পরিকল্পিতভাবে পাহাড়কে অশান্ত করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এর অংশ হিসেবে গত ২৩ সেপ্টেম্বর মারমা সম্প্রদায়ের এক স্কুলছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগ তুলে খাগড়াছড়ি শহরসহ বিভিন্ন এলাকায় টানা কয়েক দিন ধরে তাণ্ডব চালাচ্ছে আঞ্চলিক সংগঠনগুলো।
গতকাল রবিবারও প্রশাসনের জারি করা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে খাগড়াছড়ির গুইমারা এলাকায় ব্যাপক সংঘাত হয়। এতে ৩ জন পাহাড়ি বাসিন্দা নিহত এবং ১৩ জন সেনা ও ৩ জন পুলিশ সদস্যসহ আরও অনেকে আহত হয়েছেন বলে বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
বিশ্লেষকরা বলছেন, যে ইস্যুতে এমন ভয়ানক সংঘাত হয়েছে তা হওয়ার কথা নয়। কেননা অভিযোগ ওঠার পর পরই আইনগত ব্যবস্থা নিয়েছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সঠিক পদ্ধতিতেই এগোচ্ছিল সবকিছু। অথচ সেগুলোকে পাত্তা না দিয়ে পার্বত্য আঞ্চলিক সংগঠন ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ-প্রসীত) এবং তাদের ছাত্রসংগঠন মিলে ভয়ানক পরিস্থিতির দিকে নিয়ে গেছে। এমনকি এলাকার নিরাপত্তাব্যবস্থা ও সার্বিক পরিস্থিতি শান্ত-স্বাভাবিক করতে গিয়ে বারবার হেনস্তা ও হামলার শিকার হয়েছে পার্বত্য অঞ্চলের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। ফলে এই ঘটনার সূত্র ধরে যে ধরনের তৎপরতা বা ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড চালানো হচ্ছে তার নেপথ্যে দেশি-বিদেশি কোনো ষড়যন্ত্র থাকতে পারে বলেও মনে করছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি, চলমান দুর্গাপূজার আয়োজন এবং জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশন- এই তিনটি বিষয়কে ঘিরে কোনো ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে পার্বত্য অঞ্চলে এমন সংঘাতময় পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছে। এই ঘটনার পর পরিস্থিতির ভয়ানক রূপ দিতে পাহাড়ি বাসিন্দাদের একটি অংশ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও নানা রকম মিথ্যাচার ও বানোয়াট তথ্য-চিত্র ছড়িয়ে দিচ্ছে, যা ভিন্নকিছুকে ইঙ্গিত দিচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে ওসমানী সেন্টার ফর পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের চেয়ারম্যান লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘এটা বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়, বরং বড় পরিকল্পনার অংশ। পার্বত্য চট্টগ্রাম অশান্ত করতে দীর্ঘদিন ধরেই ষড়যন্ত্র হয়ে আসছে। সীমান্তের পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন পক্ষ এখানে তৎপর। ইউপিডিএফ বা জেএসএসসহ অন্য যারা আছে তারা পার্বত্য অঞ্চলে বসবাস করে মাত্র, তাদের সবকিছুই সীমান্তের বাইরে থেকে পরিচালিত হয়।
সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের সাবেক এই পিএসও লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসকারী সবাই আমাদের লোক, তারা সবাই বাংলাদেশি। কেউ আমাদের শত্রু নয়। কিন্তু কিছু মানুষ (ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর) আছে, যারা উসকানি ও গুজবে নাচতে থাকেন। এখানে ছোট কিছু গ্রুপ আছে, যারা পরিকল্পিতভাবে পাহাড়কে অশান্ত করতে সার্বক্ষণিক প্রচেষ্টায় লিপ্ত। ফলে ধর্ষণের মতো ঘটনা বা অভিযোগ পেলে সেটি সহজেই তারা বড় ধরনের সহিসংতায় রূপ দিতে পারে। তাই এই ধরনের ‘ট্র্যাপে’ যাতে আমরা পা না দিই। নিরাপত্তা বাহিনী যাতে মনে না করে এটা পাহাড়ি-বাঙালির সংঘাত। এই বিষয়ে গোয়েন্দাদের গভীরভাবে কাজ করতে হবে। ধৈর্য ধরে কাজ করতে হবে। যারা সম্প্রীতি ও শৃঙ্খলা বিনষ্টের জন্য দায়ী তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। এ ছাড়া সরকারের দায়িত্বশীল উপদেষ্টাদের ঘটনাস্থলে গিয়ে সবাইকে নিয়ে বসে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা করা জরুরি।
এদিকে স্থানীয় সূত্রগুলো জানিয়েছে, ইউপিডিএফ-প্রসীতের উসকানিতে বর্তমানে খাগড়াছড়িতে ভয়ানক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। তারা পার্বত্য অঞ্চলের অন্য সংগঠন জেএসএসসহ (সন্তু লারমা) আরও অনেককে একতাবদ্ধ হয়ে সেনাবাহিনী বা সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন-কর্মসূচি পালনের আহ্বান জানিয়েছে। বিভিন্ন এলাকা থেকে তারা দেশি-বিদেশি অস্ত্র সরঞ্জামের মজুত বাড়াচ্ছে।
গতকাল বিকেলে কাপ্তাই বিজিবির (৪১ ব্যাটালিয়ন) সদস্যরা কুকিমারাপাড়া চেকপোস্টে বান্দরবান থেকে খাগড়াছড়িগামী যাত্রীবাহী বাসে তল্লাশি চালিয়ে প্রায় ১০০টি লোহার তৈরি ধারালো রামদা উদ্ধার করেন। সংশ্লিষ্টরা জানান, পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে করার জন্য ইউপিডিএফ এসব রামদা খাগড়াছড়ির দিকে নিয়ে যাচ্ছিল। স্থানীয় পুলিশ এ বিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা নিচ্ছে।
স্থানীয় বাসিন্দা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা জানান, গত সপ্তাহে মারমা সম্প্রদায়ের ওই শিক্ষার্থী ধর্ষণের অভিযোগ ওঠার পর ইউপিডিএফ গ্রুপের উসকানিতে উখ্যানু মারমার নেতৃত্বে ‘জুম্ম ছাত্র জনতা’র ব্যানারে তিন পার্বত্য জেলায় বিক্ষোভ, সড়ক অবরোধ ও মহাসমাবেশের ডাক দেওয়া হয়। উখ্যানু মারমা ইউপিডিএফের হয়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট ও পাহাড়ের পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছেন। অন্যদিকে রাঙামাটি চাকমা সার্কেলের প্রধান ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায়ের দ্বিতীয় স্ত্রী ইয়ান ইয়ান রাখাইন তার ফেসবুক আইডি থেকে উসকানিমূলক পোস্ট প্রচার করে বিভ্রান্তি সৃষ্টির চেষ্টা করেন। একইভাবে কানাডাপ্রবাসী প্রজ্ঞা তাপস চাকমা (ফেসবুক আইডি: PT Chakma) সেনাবাহিনীর ক্যাম্প ঘেরাও করার মতো উসকানিমূলক পোস্ট দিয়ে জনগণকে উত্তেজিত করেন। এসব উসকানির পর দুই-তিন দিন ধরে খাগড়াছড়ি এলাকায় ভয়ানক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যায়ন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. সাবের আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘পার্বত্য ইস্যুগুলোকে সরলভাবে দেখার সুযোগ নেই। সম্প্রতি যে ঘটনা ঘটেছে (স্কুলছাত্রী ধর্ষণের অভিযোগ), তা খুবই নিন্দনীয় এবং এর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হতে হবে। কিন্তু এটাকে কেন্দ্র করে এখন যেসব ঘটছে তা কেবল পাহাড় বলেই সম্ভব। এখানে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সংশ্লিষ্টতা ও চক্রান্ত কাজ করে, যা মাঝেমধ্যেই দৃশ্যমান হয়। বিভিন্ন ‘পেইড এজেন্টরাও’ এখানে নানা ভূমিকায় কাজ করে থাকেন। অনেক সময় মনে হয়, বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চল যেন আলাদা কোনো রাজ্য, অন্য কোনো দেশ!’
ড. সাবের আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘এখানে কিছু আঞ্চলিক সংগঠন বা কেউ কেউ সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে কুৎসা রটাচ্ছে বা সেনাবাহিনী প্রত্যাহারেরও দাবি জানাচ্ছে। কিন্তু এটা কোনোভাবেই যৌক্তিক দাবি নয়। দেশপ্রেমিক হিসেবে সেনাবাহিনী এখনো প্রতিষ্ঠিত। সেনাবাহিনী আমাদের গর্বের জায়গায় রয়েছে। তা ছাড়া পার্বত্য অঞ্চলের দুর্গম চিত্র, ভৌগোলিক অবস্থান ও সার্বিক নিরাপত্তার স্বার্থে সেখানে সেনাবাহিনীর বিকল্প নেই।’
গত ২৬ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়ি জেলায় ‘জুম্ম ছাত্র জনতা’র ব্যানারে মহাসমাবেশের সময় গুজব ছড়িয়ে সেনাবাহিনীর টহল দলের ওপর হামলা ও ভাঙচুর করা হয়। এতে তিনজন সেনাসদস্য আহত হন। পরদিন ২৭ সেপ্টেম্বর সকাল ৯টায় খাগড়াছড়িতে সড়ক অবরোধের সময় ইউপিডিএফের গুলিতে একটি টমটম গাড়ির চালক আহত হন। এ ছাড়া আলুটিলা পুনর্বাসন এলাকায় একটি রোগীবাহী অ্যাম্বুলেন্স ভাঙচুর করা হয়। জেলার বিভিন্ন উপজেলার সড়কে গাছের গুঁড়ি ফেলে নৈরাজ্য সৃষ্টির চেষ্টা করা হয়। গতকাল গুইমারায় আরও ভয়ানক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।
অন্যদিকে গতকাল খাগড়াছড়িতে স্কুলছাত্রী ধর্ষণ ও অবরোধ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিশেষ আইনশৃঙ্খলা সভা অনুষ্ঠিত হয়। এ সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সুপ্রদীপ চাকমা পাহাড়ি-বাঙালি সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠায় কাজ করার আহ্বান জানান।
উপদেষ্টা সুপ্রদীপ চাকমা বলেন, পাহাড়ে শুধু সরকারি বাহিনীর কাছেই অস্ত্র থাকবে। এর বাইরে কারও কাছে অস্ত্র থাকতে পারবে না। চাঁদাবাজির কারণেই এ এলাকায় উন্নয়নে ব্যাঘাত সৃষ্টি হচ্ছে। প্রশাসনকে এ বিষয়ে আরও কঠোর অবস্থান নিতে হবে।
সম্পাদক মন্ডলীর সভাপতিঃ মোহাম্মদ আফছার খান সাদেক
সম্পাদক ও প্রকাশকঃ মিলাদ মোঃ জয়নুল ইসলাম
প্রকাশনালয়ঃ রিপোর্টার লজ, কসবা, বিয়ানীবাজার, সিলেট ।
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ উত্তর বাজার কেন্দ্রিয় মসজিদ মার্কেট (২য় তলা), বিয়ানীবাজার, সিলেট ।
মোবাঃ ০১৮১৯-৬৫৬০৭৭, ০১৭৩৮-১১ ৬৫ ১২
ইমেইলঃ agamiprojonma@gmail.com, milad.jaynul@gmail.com