প্রজন্ম ডেস্ক:
রাজনীতির খেলা বা ‘পলিটিক্যাল গেম’ বলে একটি কথা প্রচলিত আছে। এই গেম সময়মতো খেলতে পারলে রাজনীতিতে লাভবান হওয়া যায়। তবে ট্রাম্প কার্ডের রাজনীতি বাংলাদেশে আলোচিত বিষয় হলেও সবসময় এটি সফল হয় না। এবারে এ ধরনের এক উদ্যোগ বা কৌশলে সফল হয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
তিনি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপির ছয় নেতাকে সফরসঙ্গী করে যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে গেছেন। এখন ওই ছয় নেতাই জাতিসংঘে প্রধান উপদেষ্টার দেওয়া ভাষণ এবং তার নেতৃত্বের ভূয়সী প্রশংসা করছেন। ভাষণে আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের ঘোষণাকেও তারা স্বাগত জানিয়ে বলেছেন, নির্বাচন নিয়ে আর কোনো সংশয় নেই। শুধু তাই নয়; গত কয়েক মাস বিভিন্ন ইস্যুতে বিপরীত মেরুতে অবস্থান করলেও এখন তিনটি দলই সুদৃঢ় ঐক্যের কথা বলছেন। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রে ড. ইউনূসের সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ-প্রতিবাদকেও তারা মোকাবিলা করছেন একসঙ্গে।
ড. ইউনূসের সফরসঙ্গী হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার আগে বিভিন্ন ইস্যুতে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির বিরোধ এতটাই তুঙ্গে ছিল যে, মতবিরোধের সূত্র ধরে তারা চরম বাহাসের পাশাপাশি পরস্পরের বিরুদ্ধে রাজপথে শোডাউন পর্যন্ত করেছে। পাশাপাশি সরকারকেও প্রচণ্ড চাপে রেখেছিল। এমন পরিস্থিতিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে কি না, তা নিয়ে জনমনে তৈরি হয় সংশয়। এমন পরিস্থিতিতে ভারতে আওয়ামী লীগের ব্যাপক তৎপরতার পাশাপাশি বাংলাদেশে দলটির ঝটিকা মিছিলের কারণে ফ্যাসিবাদীদের ফিরে আসার জল্পনা-কল্পনা তৈরি হয়। সবাই ঐক্যবদ্ধ না থাকলে গুপ্ত স্বৈরাচারের আবির্ভাব হতে পারে বলে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সবাইকে সতর্ক করে দেন।
গত ২১ সেপ্টেম্বর রাতে তিন দলের ছয়জন নেতাকে সফরসঙ্গী করে নিউইয়র্কে যান ড. ইউনূস। যাওয়ার আগে তিনি যে নেতাদের চাপের মুখে ছিলেন, তাদেরই প্রশংসায় এখন ভাসছেন।
নিউইয়র্কে এক বক্তৃতায় তার প্রশংসা করে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ড. ইউনূস দূরদৃষ্টিসম্পন্ন। দুনিয়াজোড়া তার সুনাম। তিনি দেশকে একটি কাঙ্ক্ষিত মানে দেখতে চান। এটি শহিদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানেরও চাওয়া ছিল। আমি ড. ইউনূসের মাঝে আমাদের দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের প্রতিচ্ছবি দেখতে পাই।
২০০৪ সালে বিএনপি সরকারের উদ্দেশে আওয়ামী লীগ একটি ট্রাম্প কার্ড বা তুরুপের তাস দিয়েছিল। আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল বলেছিলেন, ৩০ এপ্রিলের পর বিএনপি আর ক্ষমতায় থাকবে না। খালেদা জিয়া প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী হয়ে যাবেন।
সে সময় রাজনৈতিক মহলে গুঞ্জন ছিল, বিএনপি থেকে ১০০ এমপিকে বিরোধী দলে নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করবে। শেষ পর্যন্ত সেই চেষ্টা সফল হয়নি, বিএনপি মেয়াদের শেষ দিন পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিল।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থেকে প্রশ্নবিদ্ধ তিনটি নির্বাচনে জাতীয় পার্টিকে ট্রাম্প কার্ড হিসেবে ব্যবহার করেছে বলে আলোচনা আছে। তবে গত ২৪ সেপ্টেম্বর জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের বলেছেন, আগামী নির্বাচনে জাতীয় পার্টিই হবে ট্রাম্প কার্ড। আওয়ামী লীগের ভোট আমাদের প্রতীকে পড়তে পারে।
জি এম কাদেরের ট্রাম্প কার্ড সফল হওয়ার বিষয়টি আগামী দিনের রাজনীতির গতি-প্রকৃতির ওপর নির্ভর করছে। আবদুল জলিলের ট্রাম্প কার্ড সফলতার মুখ না দেখলেও ড. ইউনূসের উদ্যোগকে সফলতা হিসেবে দেখা হচ্ছে।
তিন দলের নেতাদের জাতিসংঘে নিয়ে যাওয়ার ঘটনাকে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা ড. ইউনূসের বিচক্ষণতা হিসেবে দেখছেন। তারা বলছেন, ড. ইউনূস এটাই চেয়েছিলেন। যারা তাকে চেনেন এবং জানেন, তারা প্রায় সবাই স্বীকার করবেন- ড. ইউনূস কথা বলেন কম, শোনেন বেশি। তিনি রাজনীতিবিদও নন। অথচ এবার তিনিই রাজনীতিতে এক ধরনের বাজিমাত করলেন। সময়মতো ট্রাম্প কার্ড খেলে তিন দলের দূরত্ব কমিয়েছেন। নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা দূর করেছেন।
ড. ইউনূস নিজেই একে ‘ভালো কাজ’ হিসেবে উল্লেখ করে বলেছেন, ‘জাতিসংঘে আসার সময় আমরা রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে নিয়ে এসেছি। তারা একসঙ্গে মেলামেশা করতে পারবেন, কারণ তারা দেশে একজন আরেকজনের সঙ্গে কথা বলতেন না। তাই আমরা উনাদের নিয়ে এসেছি একসঙ্গে এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যোগদানের সুযোগ করে দিচ্ছি।’
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের ফাঁকে বাংলাদেশের বিদেশি বন্ধুদের নিয়ে আয়োজিত এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “আমরা বিদায়ী সরকার আর তারা আগামীর সরকার। বাংলাদেশে তারা সবসময় একে অপরের সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে পড়েন। এখানে তারা একসঙ্গে অনুষ্ঠানে অংশ নিচ্ছেন, কথা বলছেন। এটি একসঙ্গে মিলেমিশে থাকার এক ধরনের প্রক্রিয়া। কেউ একজন ছবি তুলে বলেছেন, ‘এটি জাতিসংঘে ঐক্যবদ্ধ বাংলাদেশ’। একই ফ্রেমে রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে আমিও ছিলাম। সুতরাং এটি খুব ভালো একটা মন্তব্য ছিল।”
জার্মান সমাজবিজ্ঞানী এবং রাজনৈতিক অর্থনীতিবিদ ম্যাক্স ওয়েবারের তার বিখ্যাত ‘পলিটিক্স অ্যাজ এ ভোকেশন’ শীর্ষক বিখ্যাত বক্তৃতায় বলেছেন, রাজনীতি হলো শক্তিশালী এবং ধীরগতির কঠিন বোর্ডে ছিদ্র করার মতো একটি কাজ। এর জন্য যেমন আবেগ প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন দূরদর্শিতারও।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আনোয়ার উল্লাহ চৌধুরী মনে করেন, তিন দলের প্রতিনিধিকে সফরসঙ্গী করা ভালো উদ্যোগ এবং এটি ড. ইউনূসের রাজনৈতিক দূরদর্শিতার পরিচায়ক। তিনি বলেন, ‘আগামী নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে করার ক্ষেত্রে এই তিন দলের একটা ইতিবাচক ভূমিকা প্রয়োজন। তাই এই তিন দলের মধ্যে মতবিরোধ নিরসন করা দরকার। সেই উদ্দেশ্যে প্রধান উপদেষ্টা তাদের নিয়ে গেছেন।’
তিনি বলেন, ‘তিন দল যেন পরস্পরের কাছাকাছি আসে, তাদের মধ্যে যেন ভাবের আদান-প্রদান হয় এবং এই সফরের মধ্য দিয়ে তাদের মতবিরোধ কমে আসে এটাই প্রধান উপদেষ্টা চেয়েছেন। এ ক্ষেত্রে তিনি কিছুটা সফলও হয়েছেন।’
রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী মনে করেন, রাজনীতিবিদ না হয়েও ড. ইউনূস রাজনৈতিক দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন। এ কারণে গত কয়েক মাসের রাজনৈতিক অস্থিরতা অনেকটাই কমে গেছে। তিনি বলেন, ‘তবে বল এখন রাজনৈতিক দলগুলোর কোর্টে। বিবদমান সব ইস্যু তাদের নিজেদেরই নিষ্পত্তি করতে হবে। পাশাপাশি নিজেদের ঐক্য তারা ধরে রাখবে বলে প্রত্যাশা করি।’
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই অধ্যাপক বলেন, ‘নির্বাচনের সময়, জুলাই সনদ ও সংস্কারসহ বেশ কয়েকটি ইস্যুতে এতদিন এক ধরনের বিবাদ চলছিল। কিন্তু উনি (প্রধান উপদেষ্টা) ঠিক করে রেখেছিলেন কখন কী করবেন। সময়মতো তিন দলকে যুক্তরাষ্ট্র নিয়ে গিয়ে একত্র করতে পেরেছেন। এটাতে তিনি বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছেন। আমরাও এটাই চেয়েছিলাম।’
যুক্তরাষ্ট্রে এক বক্তৃতায় বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘আমরা খুশি সব রাজনৈতিক দলগুলোকে ড. ইউনূস এই সফরে সংযুক্ত করেছেন। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের ঐক্য প্রকাশ পেয়েছে।’ জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে নিয়ে অংশগ্রহণ করে প্রধান উপদেষ্টা এক অনন্য নজির স্থাপন করেছেন। বিশ্ববাসী দেখেছে আমরা বিপ্লব-পরবর্তী কার্যক্রম পরিচালনায়
ঐক্যবদ্ধ আছি। আগামী দিনেও আমরা দেশের প্রয়োজনে ঐক্যবদ্ধ থাকব।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার ড. ইউনূসের এই উদ্যোগের প্রশংসা করে বলেন, বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলগুলো অনেক সময় আলাপ-আলোচনা একসঙ্গে বসে করার সুযোগ পান না। তিনটি বড় দলের বিদেশে এই সুযোগ ড. ইউনূস করে দিয়েছেন। নিঃসন্দেহে এটি ইতিবাচক ঘটনা।
নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলো জানাচ্ছে, বেশ কয়েকটি ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিরোধ তৈরি হওয়ায় কিছুটা অস্বস্তিতে ছিলেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। কারণ তিনি যেকোনো মূল্যে একটি সুষ্ঠু একটি নির্বাচন করে ক্ষমতা হস্তান্তরে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। দলগুলোকে একত্রিত করার সুযোগ খুঁজছিলেন তিনি। এ জন্য জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনকে সামনে রেখে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে আলাপ করেন। তিন দল থেকে তিনজনকে সফরসঙ্গী করার প্রস্তাব করা হলে তারা রাজি হন। তবে জামায়াতের আমির অসুস্থ থাকায় দলটির নায়েবে আমির ড. আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহেরকে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়। প্রথমে তিনজনের কথা থাকলেও পরে সেটিকে ছয়জন করা হয়।
সূত্রগুলো জানাচ্ছে, জাতিসংঘের অধিবেশন ছাড়াও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকালেও ড. ইউনূস তিনটি দলকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানান। দলগুলোর নিজেদের মধ্যে বিভিন্ন ইস্যুতে বিরোধ থাকলে তা নিয়ে যেন নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে নিষ্পত্তি করেন এমন বার্তা দেন তিনি। তবে ফ্যাসিবাদবিরোধী ঐক্য যেন অটুট থাকে তিনি সে অনুরোধ করেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও অর্থনীতিবিদ ড. মাহবুব উল্লাহ বলেন, তিন দলকে সফরসঙ্গী করে ড. ইউনূস প্রশংসা পাওয়ার মতো কাজ করেছেন। তার মতে, চব্বিশে যারা ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে তাদের জাতীয় স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ থাকা উচিত। তাদের মধ্যে যদি বড় রকমের দূরত্ব হয় সেটা আমাদের সবার জন্য চিন্তার বিষয়। যারা দেশকে ভালোবাসে, দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব নিয়ে উদ্বিগ্ন, তারা তো চায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল যারা আছে, তারা যেন ঐক্যবদ্ধ হয়ে এগিয়ে যায়।
ড. মাহবুব উল্লাহ বলেন, নিজেদের মধ্যে রাজনৈতিক মতপার্থক্য নিশ্চয়ই আছে, কারণ তারা আলাদা রাজনৈতিক দল। তারও ঊর্ধ্বে হলো দেশ এবং দেশের জন্য সবার অবস্থান এক জায়গায় হওয়া উচিত। বিশেষ করে সীমান্তের ওপার থেকে হুমকি আসছে। শেখ হাসিনা যেভাবে নগ্ন ভাষায় কথাবার্তা বলছেন, এ ক্ষেত্রে ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা অনেক বেশি।
তার মতে, এই মুহূর্তে ভারতীয় আধিপত্যবাদের আগ্রাসন ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। ড. ইউনূস যে কাজ করছেন সেটার জন্য অবশ্যই প্রশংসা পাবেন।
পরিস্থিতির কারণে যেভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা উচিত, সেভাবেই তিনি ব্যক্ত করছেন। ভারতকে খুশি না করলে ক্ষমতায় থাকতে পারব না, এ ধরনের চিন্তা ড. ইউনূস করেন না। বাংলাদেশের কোনো রাষ্ট্রপতি জাতিসংঘে গিয়ে ভারত সম্পর্কে এভাবে বলেনি। ড. ইউনূস সেটি বলে বাংলাদেশকে নতুন মর্যাদায় উপস্থাপন করেছেন।
সম্পাদক মন্ডলীর সভাপতিঃ মোহাম্মদ আফছার খান সাদেক
সম্পাদক ও প্রকাশকঃ মিলাদ মোঃ জয়নুল ইসলাম
প্রকাশনালয়ঃ রিপোর্টার লজ, কসবা, বিয়ানীবাজার, সিলেট ।
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ উত্তর বাজার কেন্দ্রিয় মসজিদ মার্কেট (২য় তলা), বিয়ানীবাজার, সিলেট ।
মোবাঃ ০১৮১৯-৬৫৬০৭৭, ০১৭৩৮-১১ ৬৫ ১২
ইমেইলঃ agamiprojonma@gmail.com, milad.jaynul@gmail.com