প্রজন্ম ডেস্ক:
নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে ততই রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ সৃষ্টি হচ্ছে। দলগুলো অবস্থান বদলাতে শুরু করেছে। যে যার মতো গড়ে তুলতে চেষ্টা করছে নিজস্ব বলয়। এটি আরও স্পষ্ট হয়েছে সম্প্রতি ভারতের পত্রিকা ‘এই সময়’-এ বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সাক্ষাৎকারকে কেন্দ্র করে। এ সাক্ষাৎকারের বক্তব্য নিয়ে বেশ ক্ষুব্ধ হয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। যদিও বিএনপির পক্ষ থেকে এই সাক্ষাতকারের বিষয়টি পুরোপুরি অস্বীকার করা হয়েছে।
এরপরও এনসিপি জানিয়েছে বিএনপির রাজনীতি ভারতমুখী হলে জাতীয় নাগরিক পার্টি নতুন করে সিদ্ধান্ত নেবে। নতুন দল হলেও নির্বাচনের আগে নিজস্ব বলয় তৈরির চেষ্টা করছে এনসিপি। আর জামায়াতে ইসলামী ও বিএনপি দীর্ঘদিন জোটবদ্ধ হয়ে রাজনীতি করে এলেও জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর থেকে দুদলের নেতাদের কথায় ব্যবধান স্পষ্ট হয়েছে। বিএনপির এক সময়ের মিত্র জামায়াতে ইসলামী নির্বাচনি সমঝোতা করতে জোর তৎপরতা চালাচ্ছে। তাদের ভাষ্য, বিএনপিকে ছাড়া তারা এই সমঝোতা প্রক্রিয়ায় সব দলকে ভেড়ানোর চেষ্টা করছেন।
বিএনপিও তাদের মিত্র যুগপৎ শরিকদের নিয়ে রাজনৈতিক শক্তি বাড়াতে চাইছে। এ জন্য তারা আসন বণ্টনেও বেশ ছাড় দিচ্ছে।
এক সাক্ষাৎকারে বিএনপি মহাসচিব বলেন, জাতীয় নাগরিক পার্টিকে এখন আর কোনো শক্তি মনে করে না বিএনপি। জামায়াতে ইসলামীকে আর মাথায় উঠতে দেবে না। দলটির যত না শক্তি, বিএনপি অকারণে তার চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে।
‘বিএনপি-জামায়াতকে ভারত কেন এক বন্ধনীতে রাখছে, প্রশ্ন মির্জার’ শিরোনামে প্রকাশিত সাক্ষাৎকারটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোড়ন ও বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। সাক্ষাৎকারের কিছু বক্তব্য নিয়ে জামায়াতে ইসলামী তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে। প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন এনসিপি নেতারাও।
সাক্ষাৎকারের এক প্রশ্নে মির্জা ফখরুলের জবাব হিসেবে লেখা হয়েছে, আগামী নির্বাচনে জামায়াত বিএনপির কাছে ৩০টা আসন চেয়েছে। বিএনপি উৎসাহ দেখায়নি। প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে জামায়াতে ইসলামী সম্পর্কে দেওয়া বক্তব্য ও মন্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন দলটির সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার।
তিনি বলেন, বিএনপির মহাসচিব জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি এবং সংগঠনের মর্যাদা সম্পর্কে তাচ্ছিল্যের ভাষায় কথা বলেছেন। এটি সম্পূর্ণ অসত্য, অমর্যাদাকর ও প্রতিহিংসাপরায়ণ বক্তব্য। এই বক্তব্যের সঙ্গে সত্য ও শিষ্টাচারের কোনো মিল নেই। বিএনপির কাছে ৩০ আসন চাওয়ার দাবি প্রত্যাখ্যান করে দিয়ে গোলাম পরওয়ার বিবৃতিতে বলেন, ‘কারও কাছে আসন চাওয়ার রাজনীতির সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর বর্তমান সময়ে দূরতম কোনো সম্পর্কও নেই।’
ভবিষ্যতে এ ধরনের অসত্য ও বিভ্রান্তিকর বক্তব্য প্রদান থেকে বিরত থাকার জন্য বিএনপি মহাসচিবের প্রতি আহ্বান জানানো হয় বিবৃতিতে।
জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ও সাবেক এমপি ড. এইচএম হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, বিএনপি মহাসচিব মিথ্যা তথ্য দিয়েছেন। আমরা বিএনপির কাছে কোনো আসন চাইনি। যাদের ইন্ডিয়ান কানেকশন ভালো তারাই বলতে পারবে কেন এসব বলেছে।
জোট গঠন নিয়ে তিনি বলেন, আমরা বিএনপি বাদে সবাইকে নিয়ে নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক বোঝাপড়া করতে চাই। এটার নাম নির্বাচনি সমঝোতা হতে পারে। এটা কোনো জোট হবে না। জোট হলে একটি দলের নেতৃত্বের প্রশ্ন থাকে। তফসিল ঘোষণার আগে নির্বাচনি সমঝোতার বিষয়টি আরও পরিষ্কার হবে। এখন আমাদের সঙ্গে সাতটি দল যুগপৎ আন্দোলন করছে। সামনে তা আরও বাড়তে পারে। আর এনসিপিসহ আরও কয়েকটি দল আন্দোলনের মধ্যেই আছে। হয়তো প্যাটার্নটা ভিন্ন। সবাই তো পিআর চায়।
এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন বলেন, আমরা মনে করি বিএনপি ক্রমাগত দিল্লিপন্থি হয়ে উঠছে। বিএনপির নতুন নতুন বয়ান প্রমাণ করে তারা আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের জন্য প্রকাশ্যে কাজ করছে। একই সঙ্গে জাতীয় পার্টিকেও তারা ভোটে রাখতে চাচ্ছে। গণতন্ত্রের জন্য এগুলো হুমকিস্বরূপ। বিএনপির মতো এত বড় দলের কাছ থেকে আমরা এমন ভূমিকা আশা করি না।
তিনি বলেন, দলের ভেতরে সংস্কারে বিএনপির একটি বড় সুযোগ ছিল, গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বিএনপি সেই সুযোগ মিস করেছে। দলটির বর্তমান নেতৃত্ব পর্যায় থেকে যেসব বক্তব্য আসছে তা রীতিমতো প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। আমরাও তাদের আচরণে শঙ্কিত হয়ে যাই।
যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার বলেন, বিএনপি বোঝাতে চাচ্ছে তারা ভারতের জন্য হুমকি নয়। বিএনপি মূলত ভারতের বিশ্বাসের জায়গায় যেতে চাচ্ছে। কিন্তু আমাদের পররাষ্ট্র নীতি হলো কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়, আবার সখ্যও নয়। বিএনপি ৫ আগস্টের পর বিগত ১৫ বছরের ইতিহাস ভুলে গেছে। এই দম্ভ ভালো নয়। একসময় বিএনপির পল্টনে সেøাগান দেওয়ার লোক ছিল না। আওয়ামী লীগের চেয়ে বড় দল কেউ ছিল না। কিন্তু এখন তা দূর অতীত। বিএনপির উচিত সব দলকে সম্মান দেওয়া। আমরা মনে করি বিএনপি মহাসচিবের মতো নেতার কাছ থেকে এনসিপি নিয়ে মন্তব্য করা মানে আমরা রাইট ট্র্যাকে আছি।
জোট গঠন নিয়ে তিনি বলেন, আমরা বিএনপি-জামায়াতের বাইরে আলাদা ব্লক হতে চাই। সে জন্য সাংগঠনিক অবস্থান তৈরি করতে কাজ করছি। নির্বাচনের আগে আমরা কারও সঙ্গে কৌশলগত জোট করতেও পারি। তবে জামায়াতের সঙ্গে জোট হবে না বলে জানান এনসিপির এই নেতা।
জোট গঠন নিয়ে তিনি বলেন, বর্তমানে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী দুটি বলয় গঠনে কাজ করছে। যারা পুরোনো ক্ষমতাধর শক্তি। এনসিপি পুরোনো কোনো ক্ষমতাধর শক্তির সঙ্গে জোট করবে না। আমরা নতুন দল। নিজস্ব বলয় গঠনের চেষ্টা করছি।
সাক্ষাৎকারে বিএনপি মহাসচিব বলেন, তারা বলেছেন ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও ১৪ দলীয় জোটের শরিকরা ‘নির্বাচনে অংশ নিক’, তারা চান একটা সুষ্ঠু ও অবাধ ভোট হোক। এ জন্য অনেকে তাকে ‘ভারতের এজেন্ট’, আওয়ামী লীগের ‘দালাল বলে গালাগাল’ দিচ্ছে।
এই প্রসঙ্গে এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটোয়ারি বলেন, বিএনপির ‘রাজনীতি ভারতমুখী’ হলে জাতীয় নাগরিক পার্টি নতুন করে সিদ্ধান্ত নেবে। বিএনপি ইলেকশনে আওয়ামী লীগ এবং জাতীয় পার্টিকে নিয়ে আসতে চায়। এটা একটা জাতি হিসেবে আমাদের জন্য লজ্জার। বিএনপির তৃণমূলে যারা নেতাকর্মী রয়েছেন, আমরা তাদের আহ্বান জানাব শহিদ জিয়া বাংলাদেশে এই রাজনীতি করেননি, খালেদা জিয়া বাংলাদেশে এই রাজনীতি করেননি। যদি আপনাদের রাজনীতি ভারতমুখী হয়ে থাকে, তা হলে আপনারা আমাদের জানান, আমরা আপনাদের ব্যাপারে নতুন করে সিদ্ধান্ত নেব।
অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামীর অতীত তুলে ধরে তীব্র সমালোচনা করেছেন বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। তার সন্দেহ, জামায়াত এখন ‘পতিত ফ্যাসিস্টদের সঙ্গে’ কাজ করছে।
তিনি বলেন, এখন আবার তারা স্বরূপে বেরিয়েছেন এবং আওয়ামী লীগের পুনর্বাসন চাচ্ছেন, ভারতের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক চাচ্ছেন। কিন্তু এটাও আমাদের মনে রাখতে হবে, দেশটি শেখ হাসিনার মতো রক্তপিপাসু দানবকে প্রশ্রয় দিয়েছে নিজ দেশের মানুষকে হত্যা করার জন্য।
রিজভী বলেন, আমাদের দেশে ইসলামপন্থি একটি রাজনৈতিক দল বরাবরই আমার মনে হয়েছে আওয়ামী লীগকে সন্তুষ্ট করার জন্য কাজ করছে। তারা এ দেশে রাজনীতি করার সুযোগ পেয়েছে শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কাছ থেকে। তারা নিষিদ্ধ দল ছিল। শহিদ জিয়া তাদের রাজনীতি করার সুযোগ দিয়েছেন।
যুগপৎ মিত্রদের পর্যাপ্ত আসন ছাড় বিএনপির : গত সপ্তাহে দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরামে যুগপৎ আন্দোলনের শরিকদের পর্যাপ্ত আসন ছাড় দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি। বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে দলটি মনে করছে, মিত্রদের কোনোভাবে হাতছাড়া করা যাবে না। এতদিন যারা বিএনপির সঙ্গে আন্দোলন-সংগ্রামে মাঠে ছিল; তাদের নিয়ে নির্বাচনি বৈতরণী পার হতে চায় দলটি। এমনকি ডান-বাম ইসলামপন্থি আরও কিছু দল ও সংগঠনকে ভোটের আগে নিজেদের বলয়ে ভেড়াতে চায় বিএনপি। স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান সময়ের আলোকে বলেন, শরিকদের নিয়ে দল অত্যন্ত ইতিবাচক। তাদের কাছে বিএনপির শুরু থেকেই কমিটমেন্ট ছিল। আমরা প্রাথমিক আলোচনায় সিদ্ধান্ত নিয়েছি যৌক্তিক আসনে ছাড় দিতে। পরবর্তী মিটিংয়ে হয়তো আসন ছাড়ের বিষয়টি চূড়ান্ত করা যাবে। মাঠের নানা দিক পর্যালোচনা করে এটি ঠিক করা হবে।
এদিকে জামায়াতের মতো বিএনপিও চেষ্টা করছে ইসলামপন্থি দলগুলো নিজের ঘরে রাখতে। বিএনপির লিয়াজোঁ কমিটির সদস্যরা ইসলামিক দলগুলোর সঙ্গে অভ্যন্তরীণ আলোচনা অব্যাহত রেখেছে। রাজনৈতিক দল না হলেও ভোটের মাঠে বড় ফ্যাক্টর হেফাজতে ইসলামকেও কৌশলে পাশে রাখার চেষ্টা করছে বিএনপি। হেফাজতের উচ্চ পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক করে তাদের মূল কিছু দাবি নিয়ে কাজ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে বিএনপি। এতে দলটির আচরণে আশ্বস্ত হয়েছে কওমি মাদরাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম।
সম্পাদক মন্ডলীর সভাপতিঃ মোহাম্মদ আফছার খান সাদেক
সম্পাদক ও প্রকাশকঃ মিলাদ মোঃ জয়নুল ইসলাম
প্রকাশনালয়ঃ রিপোর্টার লজ, কসবা, বিয়ানীবাজার, সিলেট ।
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ উত্তর বাজার কেন্দ্রিয় মসজিদ মার্কেট (২য় তলা), বিয়ানীবাজার, সিলেট ।
মোবাঃ ০১৮১৯-৬৫৬০৭৭, ০১৭৩৮-১১ ৬৫ ১২
ইমেইলঃ agamiprojonma@gmail.com, milad.jaynul@gmail.com