প্রজন্ম ডেস্ক:
জাতিসংঘে গত মঙ্গলবার রোহিঙ্গা ইস্যুতে উচ্চ পর্যায়ের সম্মেলন থেকে এই সংকট কাটিয়ে ওঠার জন্য স্পষ্ট কোনো পথরেখা পাওয়া যায়নি। দীর্ঘদিন ধরে জিইয়ে থাকা এই সংকটের সহসা কোনো সমাধানের আশাও দেখা যাচ্ছে না। প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস তার বক্তব্যে এই সংকট সমাধানে ৭ দফা প্রস্তাব পেশের পাশাপাশি বলেছেন যে প্রত্যাবাসনই রোহিঙ্গা সংকটের একমাত্র শান্তিপূর্ণ সমাধান। কিন্তু প্রত্যাবাসনের স্পষ্ট কোনো চিত্র এই সম্মেলন থেকে উঠে আসেনি। তবে রোহিঙ্গা ইস্যুতে মানবিক তহবিলে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য নতুন সহায়তার ঘোষণা দিয়েছে, যা ইতিবাচক। আন্তর্জাতিক ও শরণার্থী বিশ্লেষকরা এমন অভিমত ব্যক্ত করেন।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যে মিয়ানমার অত্যাচার-নিপীড়ন করছে তা রোহিঙ্গা সম্মেলনে স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। সম্মেলনে সবাই বলেছেন যে রোহিঙ্গা সংকট মিয়ানমার সৃষ্টি করেছে এবং এই সংকটের সমাধান মিয়ানমারেই। প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস বলেছেন যে প্রত্যাবাসনই রোহিঙ্গা সংকটের একমাত্র শান্তিপূর্ণ সমাধান। কিন্তু রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ইস্যুতে বা এই সংকট সমাধানের জন্য সম্মেলন থেকে স্পষ্ট কোনো ধারণা পাওয়া যায়নি। উচ্চ পর্যায়ের এই সম্মেলন অনুষ্ঠানে বৈশ্বিক নেতাদের জন্য খুব কম সময় বরাদ্দ ছিল। সম্মেলনের ফরমেটও খুব বেশি চৌকস ছিল না। মিয়ানমারে যদি স্থিতিশীলতা ফিরে না আসে তবে এই সংকট সমাধান হবে না। কিন্তু সহসা মিয়ানমারে স্থিতিশীলতা ফেরার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সভাপতি আনালেনা বেয়ারবক সম্মেলনের সূচনা বক্তব্যে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে হওয়া অন্যায়-অবিচাররের প্রসঙ্গ উপস্থাপন করে মিয়ানমারের ক্রমবর্ধমান সংকট পুরো অঞ্চলের স্থিতিশীলতাকে হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে বলে সতর্ক করেন। তিনি বলেন, ৫০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা নারী, পুরুষ ও শিশু একই ধরনের অভিজ্ঞতা বহন করছে। শুধু বাংলাদেশের কক্সবাজার শরণার্থী শিবিরেই ৮ লাখ শিশু বিদ্যালয়ের বাইরে আছে। ২০২৫ সালের মানবিক সহায়তা পরিকল্পনার এখনও মাত্র ১২ শতাংশ অর্থায়ন পেয়েছে। এটি সবাইকে ‘লজ্জিত’ করার মতো বিষয়। এই সংকটের সমাধান রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন। নিরাপদ, স্বেচ্ছামূলক ও টেকসই প্রত্যাবাসনের জন্য রাজনৈতিক সমাধান গুরুত্বপূর্ণ।
রোহিঙ্গাদের জন্য মানবিক সহায়তার তহবিল ফুরিয়ে আসছে বলে সতর্ক করে মানবিক সংস্থাগুলো সম্মেলনে বলেছে, শরণার্থীরা অপুষ্টিতে ভুগছে এবং অনেকেই বিপজ্জনক সমুদ্রযাত্রার দিকে ঝুঁকছে। রোহিঙ্গাদের মূল আবাসভূমি মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের অবস্থা কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ। সেখানে সাধারণ মানুষজন সেনাবাহিনী ও জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীর দ্বন্দ্বের মাঝে আটকা পড়েছে। রোহিঙ্গাদের এই সংকট লাখ লাখ মানুষের মানবাধিকার, মর্যাদা ও নিরাপত্তাকে পদদলিত করেছে এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতাকে হুমকির মুখে ফেলেছে। অবিলম্বে সেখানে আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী বেসামরিক মানুষকে সুরক্ষা, মানবিক সহায়তার প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা এবং শরণার্থী ও আশ্রয়দাতা সম্প্রদায়ের ওপর চাপ কমাতে বিনিয়োগ বাড়ানো, এই ৩টি পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
মিয়ানমার উইমেন্স পিস নেটওয়ার্কের প্রতিষ্ঠাতা ওয়াই ওয়াই নু সম্মেলনে বলেন, ২০১৭ সালে যখন ৭ লাখ ৫০ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ-শিশু সহিংসতা থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আসে, সেখানে কিন্তু নৃশংসতা শেষ হয়নি বরং তা আরও ভয়াবহ হয়েছে। মিয়ানমারে সেনাবাহিনী ও সশস্ত্র গোষ্ঠীর হাতে রোহিঙ্গাদের হত্যা, জোরপূর্বক সেনা নিয়োগ, যৌন সহিংসতা ও অনাহারে ফেলে দেওয়ার ঘটনা অব্যাহত রয়েছে। এখনই কোনো পদক্ষেপ না নিলে ততক্ষণ পর্যন্ত রোহিঙ্গারা নিজভূমির বাইরে পাড়ি জমাতেই থাকবে, যতক্ষণ না মিয়ানমারে আর কোনো রোহিঙ্গা অবশিষ্ট থাকে। তা ছাড়া সীমান্ত পেরিয়ে মানবিক সহায়তা করিডোর, লক্ষ্যভিত্তিক নিষেধাজ্ঞা ও নৃশংসতার বিচার হওয়া প্রয়োজন।
আরাকান ইয়ুথ পিস নেটওয়ার্কের প্রতিষ্ঠাতা রফিক হুসন সম্মেলনে বলেন, কীভাবে জান্তা বাহিনী রোহিঙ্গা পুরুষ ও ছেলেদের জোর করে সেনা হিসেবে প্রায়শই মানবঢাল বানিয়ে ব্যবহার করছে। এক সপ্তাহেই অন্তত ৪০০ জন নিহত হয়েছে। ২০২৪ সালের মে মাসের এক হামলায় এক দিনেই ২ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছিল। রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তাহীনতার এ সংকট নিরসন করা কেবল এই পরিষদের নয়, মানবতারও পরীক্ষা। উত্তর রাখাইনে আন্তর্জাতিক তদারকিতে নিরাপদ অঞ্চল সৃষ্টি করা প্রয়োজন।
জাতিসংঘের বিশেষ দূত জুলি বিশপ সম্মেলনে বলেন, মিয়ানমারের বহুমাত্রিক সংকট ২০২১ সালের অভ্যুত্থানের পর সৃষ্ট রাজনৈতিক অস্থিরতার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কোনো যুদ্ধবিরতি না থাকার কারণে সংঘাত ছড়িয়ে পড়ছে। এ বছর পরবর্তী নির্বাচনের পরিকল্পনা বৈধতা নয়, সহিংসতা আরও বাড়াবে। এখানে শান্তির কোনো স্পষ্ট রূপরেখা নেই। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মিয়ানমারের জান্তা সরকারের প্রতি নিন্দা ক্রমশ কমছে, অথচ নির্যাতন অব্যাহত রয়েছে, যা দুঃখজনক।
ইউএনএইচসিআরের প্রধান ফিলিপো গ্রান্ডি সম্মেলনে বলেন, মিয়ানমারের সাহসী পদক্ষেপ ছাড়া রোহিঙ্গাদের দুর্দশার অবসান হবে না। এই সংকটের উৎপত্তি মিয়ানমারে। আর সমাধানও সেখানেই।
উচ্চ পর্যায়ের সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস তার বক্তব্যে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে বিশ্ববাসীর প্রতি ৭ দফা দাবি উপস্থাপন করেন। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আট বছর আগে রোহিঙ্গা গণহত্যা শুরু হয়, যা এখনও চলছে। এই গণহত্যা বন্ধে উদ্য্যাগ নেওয়ায় ঘাটতি রয়েছে। এরই মধ্যে এই সংকটে মানবিক তহবিল কমেছে, যা অ্যালার্মিং। রোহিঙ্গা সংকট মিয়ানমারের সৃষ্টি করা। এই সংকটের সমাধানও মিয়ানমারে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে মিয়ানমার ও আরাকান আর্মির প্রতি প্রকৃত চাপ প্রয়োগ করতে হবে, যাতে রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতন বন্ধ হয় এবং রাখাইনে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে (মিয়ানমার ও আরাকান আর্মি) তারা কাজ করে। এই সংকটের এটাই একমাত্র সমাধান। যা মিয়ানমারের বৃহত্তর সংস্কারের কাছে এই সংকটের সমাধান প্রক্রিয়াকে জিম্মি করে রাখা সঠিক হবে না।
শরণার্থী বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর বলেন, জাতিসংঘের উচ্চ পর্যায়ের সম্মেলনে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে নতুন কোনো পরিকল্পনা বা সমাধানের পথ উঠে আসেনি। একটি বিষয়ই ইতিবাচক। তা হচ্ছে যে এই সময়ে রোহিঙ্গা ইস্যুতে মানবিক তহবিল কমতির পথে। সেখানে সম্মেলন থেকে বড় দুটি দেশ নতুন করে তহবিল ঘোষণা করেছে, যা ইতিবাচক। সম্মেলনে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর দক্ষতা, সুযোগ, শিক্ষা ইত্যাদির বিষয়ে বলা হযেছে, যাতে রোহিঙ্গারা তাদের মাতৃভূমিতে ফিরে গিয়ে কাজ করে বাঁচতে পারেন। জাতিসংঘের সম্মেলন দেখে মনে হয়নি যে বিশ্ব নেতারা দ্রুত সমাধানের পথ খুঁজছেন। সম্মেলনে মিয়ানমারে শান্তি প্রতিষ্ঠার কথা বলা হলেও এই শান্তি কীভাবে, কোন প্রক্রিয়ায় হবে তা স্পষ্ট নয়।
অন্যদিকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সম্মেলনে নতুন কিছু করার প্রস্তাব চোখে পড়েনি। আমাদের প্রদান উপদেষ্টা বলেছেন যে রাখাইনে স্থিতিশীলতা নিশ্চিতে আন্তর্জাতিক সমর্থন প্রয়োজন এবং স্থিতিশীলতা নিশ্চিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মনিটর করা প্রয়োজন, যেখানে মিয়ানমারই অস্থিতিশীল সেখানে রাখাইনের স্থিতিশীলতা নিশ্চিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মনিটরিং কীভাবে সম্ভব, তাও স্পষ্ট নয়।
সাবেক রাষ্ট্রদূত মো. শহীদুল হক বলেন, রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান একটাই, তা হচ্ছে প্রত্যাবাসন। কিন্তু প্রত্যাবাসন নিয়ে জাতিসংঘের সম্মেলন থেকে ব্রেক থ্রু কিছু পাওয়া যায়নি। এই সম্মেলন থেকে একটাই ইতিবাচক বিষয় উঠে এসেছে যে রোহিঙ্গা মানবিক ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য নতুন করে তহবিল সহায়তার ঘোষণা দিয়েছে। মাত্র দুটি দেশ তহবিলের ঘোষণা দিয়েছে, আশা করি যে সামনে আরও অনেক দেশ ঘোষণা দেবে। এবারের সম্মেলনে আরেকটি নতুন বিষয় চোখে লেগেছে যে আরব লীগ এবং ওআইসি সম্মেলনে যোগ দিয়েছে, যা ইতিবাচক। প্রধান উপদেষ্টা এবার প্রথমবারের মতো এই সম্মেলনে মিয়ানমারের মাদক কারবারের কথা বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করেছেন, যার প্রয়োজন ছিল।
Sharing is caring!