প্রজন্ম ডেস্ক:
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযোগ দাখিল হলে নির্বাচনে অযোগ্য হবেন। গতকাল মঙ্গলবার এ-সংক্রান্ত আইনে সংশোধনী আনা হয়েছে। এ নিয়ে আইনটিতে তৃতীয় দফা সংশোধনী আনল অন্তর্বর্তী সরকার। সংশোধিত আইন অনুযায়ী প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে ট্রাইব্যুনালে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করা হলেই অভিযোগসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি দেশের জাতীয় নির্বাচন থেকে শুরু করে স্থানীয় সরকারসহ কোনো নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন না।
এর ফলে আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনাসহ দলের বেশির ভাগ নেতার নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ বন্ধ হয়ে গেল।
কারণ চব্বিশের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে সারা দেশে হত্যাকাণ্ড ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগের বেশির ভাগই তাদের বিরুদ্ধে। শেখ হাসিনাসহ দলটির শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে বিচার শুরু হয়েছে। বাকিদের বিরুদ্ধে বিচারের প্রক্রিয়া চলছে। বিষয়টি স্পষ্ট হচ্ছে যে, সংশোধিত আইনের আওতায় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের বেশির ভাগ আগামী জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিতে পারছেন না।
চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে কারাবন্দি আছেন ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী আনিসুল হক, আমির হোসেন আমু, ড. আব্দুর রাজ্জাক, অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম, মুহাম্মদ ফারুক খান, ডা. দীপু মনি, গোলাম দস্তগীর গাজী, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান ও তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, সাবেক প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদার, জুনাইদ আহমেদ পলক ও সাবেক এমপি সোলায়মান মোহাম্মদ সেলিম। এ ছাড়া বিগত সরকারের মোর্চা ১৪ দলের শরিক জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু এবং ওয়ার্কার্স পাটির সভাপতি রাশেদ খান মেনন একই অভিযোগে কারাবন্দি আছেন।
গতকাল আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের লেজিসলেটিভ ও সংসদবিষয়ক বিভাগের সচিব হাফিজ আহমেদ চৌধুরীর সই করা প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, আইসিটিতে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে প্রজাতন্ত্রের কোনো চাকরি বা সরকারি পদে নিয়োগের জন্যও অযোগ্য হিসেবে গণ্য করা হবে। প্রজ্ঞাপনে আরও স্পষ্ট করা হয়, অভিযুক্ত ব্যক্তি কেবল সংসদ সদস্য পদের জন্যই নন বরং স্থানীয় সরকার সংস্থার সদস্য, কমিশনার, চেয়ারম্যান, মেয়র বা প্রশাসক হিসেবেও নির্বাচিত বা নিয়োগ পাওয়ার যোগ্যতা হারাবেন। এমনকি সেই ব্যক্তি সরকারি চাকরিতেও অযোগ্য হবেন। তবে যদি কোনো অভিযুক্ত ব্যক্তি ট্রাইব্যুনাল থেকে অব্যাহতি পান বা খালাসপ্রাপ্ত হন, তাহলে তার ক্ষেত্রে এই বিধান প্রযোজ্য হবে না।
এ ব্যাপারে ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানান, রাষ্ট্রকে সঠিক ট্র্যাকে তোলার জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের আইন সংশোধন করা হয়েছে। সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে ফরমাল চার্জ বা আনুষ্ঠানিক অভিযোগ যদি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দাখিল করা হয়, তাহলে সেই ব্যক্তি বাংলাদেশের কোনো নির্বাচনে যোগ্য হবেন না। অর্থাৎ তিনি ভোটে দাঁড়াতে পারবেন না। মেয়র, চেয়ারম্যানসহ সরকারি কোনো কার্যালয়েও নিয়োগ পাবেন না।’
তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘আপনারা হয়তো প্রশ্ন করতে পারেন, পরিবর্তনটা আবার কেন করা হলো? আমরা যেটা মনে করি যে, একটা রাষ্ট্র বিপ্লব-উত্তর পরিবেশে যখন একটা পুনর্গঠন প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে, তখন রাষ্ট্র বা দেশকে সামনে এগিয়ে নেওয়ার প্রয়োজনে সরকার এই আইন শুধু নয়; বিভিন্ন আইনেরই সংশোধনী আনছে রাষ্ট্রকে সঠিক ট্র্যাকে তোলার জন্য। এরই অংশ হিসেবে এটা করা হয়েছে সময়ের প্রয়োজনে। এখন থেকে আইনটা সেভাবেই প্রয়োগযোগ্য হবে।’
বিচার চলাকালীন আইন সংশোধন হওয়ার বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে কি না, এমন প্রশ্নের উত্তরে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, ‘এমন কোনো সুযোগ নেই। কারণ দল হিসেবে আওয়ামী লীগের বিচার প্রক্রিয়া চলমান। যদি একজন ব্যক্তির বিচার চলমান থাকা অবস্থায় বিচারকে প্রভাবিত করতে পারে, এমন কিছু সংশোধন হলে প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে। এখানে যে আইনটা সংশোধন করা হয়েছে, সেটি এখনো প্রয়োগযোগ্য হয়নি। তাই প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার সুযোগ নেই। ন্যায়বিচারের পরিপন্থিও হবে না। কারণ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনটি সংবিধান দ্বারা প্রোটেক্টেট একটি আইন। সুতরাং এতে সবকিছুই বৈধ বলে গণ্য হবে। আদালতে চ্যালেঞ্জও করা যাবে না।’
এদিকে ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন সূত্রে জানা গেছে, চব্বিশের জুলাই গণ-অভ্যুত্থান এবং ২০০৯ সাল থেকে গত বছরের ৫ আগস্ট পর্যন্ত গুম-খুনসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ৫ শতাধিক অভিযোগ জমা পড়েছে। এতে সহস্রাধিক ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রাথমিক তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে ৩০টি মামলা (মিস কেস) করা হয়েছে। এসব মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ আসামি রয়েছেন ২০৯ জন। ৩০ মামলার মধ্যে তদন্ত ও অভিযোগ যাচাই শেষে ৬টি মামলার অভিযোগপত্র আনুষ্ঠানিকভাবে ট্রাইব্যুনালে দাখিল করা হয়েছে। ৬টি অভিযোগপত্রে মোট আসামি ৬২ জন। এর মধ্যে একটি মামলায় শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ পর্যায়ে। এরপর উভয় পক্ষের যুক্তিতর্ক শেষে শিগগিরই রায় ঘোষণা হতে পারে। এ মামলায় অপর দুই আসামি হলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে অভিযুক্ত অপরাধের দায় স্বীকার ও ক্ষমা চেয়ে সত্য ঘটনা তুলে ধরার অঙ্গীকার করে রাজসাক্ষী হয়েছেন চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। তিনি রাজসাক্ষীর মর্যাদায় কারাগারে আছেন। শেখ হাসিনা ও কামাল মামলার আগে থেকেই (গত বছরের ৫ আগস্ট) পলাতক। এই মামলাটির আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গত ১ জুন ট্রাইব্যুনালে দাখিল করা হয়।
চব্বিশের জুলাই অভ্যুত্থানে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় প্রথম অভিযোগপত্র দাখিল করা হয় গত ২৫ মে। চানখাঁরপুলে শিক্ষার্থী আনাসসহ ৬ জনকে হত্যার ঘটনায় ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমানসহ ৮ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। এ মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণ চলছে।
জুলাই অভ্যুত্থানে প্রথম নিহত রংপুরের সাঈদ হত্যা মামলায় বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) সাবেক ভিসি হাসিবুর রশীদ বাচ্চুসহ ৩০ জনের বিরুদ্ধে ৩০ জুন অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। এতে স্থানীয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীকেও অভিযুক্ত করা হয়। মামলাটির সাক্ষ্য গ্রহণ চলছে।
আশুলিয়ায় ৬ লাশ পোড়ানো ও জীবিত একজনকে পুড়িয়ে মারার মামলায় সাবেক এমপি সাইফুল ইসলামসহ ১৬ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হয় গত ২ জুলাই। এ মামলাটিরও সাক্ষ্য গ্রহণ চলছে।
জুলাই আন্দোলনের সময় কুষ্টিয়ায় ৬ জনকে হত্যার মামলায় হাসানুল হক ইনুর বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হয় গত ২৫ সেপ্টেম্বর। ট্রাইব্যুনাল অভিযোগটি আমলে নিয়েছেন। আগামী ১৪ অক্টোবর অভিযোগ গঠনের বিষয়ে শুনানি ধার্য আছে।
জুলাই আন্দোলনের সময় কুষ্টিয়ায় কয়েকজনকে হত্যার মামলায় আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারাণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফসহ চারজনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হয় গত রবিবার (৫ অক্টোবর)। আসামিরা সবাই পলাতক। ট্রাইব্যুনাল অভিযোগ আমলে নিয়ে আসামিদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন।
সম্প্রতি চিফ প্রসিকিউটর জানিয়েছেন, চলতি সপ্তাহেই গুম-খুনসংক্রান্ত একাধিক মামলার অভিযোগপত্র ট্রাইব্যুনালে দাখিল করা হবে।
গত বছর আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ট্রাইব্যুনালের তৎকালীন প্রসিকিউটররা পদত্যাগ করেন। ওই বছরের ৫ সেপ্টেম্বর ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর হিসেবে নিয়োগ পান সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। একই বছর ১৪ অক্টোবর ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করা হয়। হাইকোর্টের বিচারপতি গোলাম মর্তুজা মজুমদারকে চেয়ারম্যান এবং বিচারপতি শফিউল আলম মাহমুদ ও অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ মোহিতুল হক এনাম চৌধুরীকে সদস্য হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। পরে চলতি বছরের ৮ মে ট্রাইব্যুনাল-২ গঠন করা হয়। হাইকোর্টের সাবেক বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরীকে চেয়ারম্যান করে অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ মো. মঞ্জুরুল বাছিদ এবং মাদারীপুরের জেলা ও দায়রা জজ নূর মোহাম্মদ শাহরিয়ার কবীরকে সদস্য করা হয়। বর্তমানে এই দুটি ট্রাইব্যুনালে মামলাগুলোর বিচার চলছে।
সম্পাদক মন্ডলীর সভাপতিঃ মোহাম্মদ আফছার খান সাদেক
সম্পাদক ও প্রকাশকঃ মিলাদ মোঃ জয়নুল ইসলাম
প্রকাশনালয়ঃ রিপোর্টার লজ, কসবা, বিয়ানীবাজার, সিলেট ।
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ উত্তর বাজার কেন্দ্রিয় মসজিদ মার্কেট (২য় তলা), বিয়ানীবাজার, সিলেট ।
মোবাঃ ০১৮১৯-৬৫৬০৭৭, ০১৭৩৮-১১ ৬৫ ১২
ইমেইলঃ agamiprojonma@gmail.com, milad.jaynul@gmail.com