প্রজন্ম ডেস্ক:
সরকারি কর্মচারীরা দুভাবে পেনশন নিতে পারতেন। অর্ধেক তুলে নিয়ে বাকি অর্ধেকের সুবিধা মাসে মাসে ভোগ করতে পারতেন, যা এখনো বহাল। আর একটি পদ্ধতি ছিল পুরো পেনশন সুবিধা একবারে তুলে নেওয়া। কিছু অনিয়মের কারণে একসঙ্গে তুলে নেওয়ার পদ্ধতিটি সরকার ২০১৭ সালে বাতিল করে দেয়। কিন্তু পরের বছরই অর্থাৎ ২০১৮ সালে তাদের আবার পেনশনের আওতায় আনে।
নিয়ম করা হয় যাদের অবসরের বয়স ১৫ বছর হয়ে গেছে, তারা একসঙ্গে পেনশন তুলে নিলেও আবার তারা পেনশন পাবেন। অর্ধেক তুলে নেওয়া পেনশনাররা যে সুবিধা পান, শতভাগ উত্তোলনকারীরাও একই সুবিধা পাবেন। এবার সেই সুবিধা ১৫ থেকে কমিয়ে ১০ বছরে নিয়ে আসা হচ্ছে। এ নিয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে বৈঠক হয়েছে। সেখানে এর অনুকূলে সিদ্ধান্ত নিয়ে তা বাস্তবায়নের জন্য অর্থ বিভাগে পাঠানো হয়। অর্থ বিভাগ তা বেতন কমিশনে পাঠিয়েছে। তাদের সুপারিশে বিষয়টি থাকবে বলে জানা গেছে।
পেনশন পুনঃস্থাপনের বয়সসীমা ১০ বছরে নামিয়ে আনার বিষয়ে জানতে চাইলে মন্ত্রিপরিষদ সচিব ড. শেখ আব্দুর রশীদ বলেন, ‘১৫ বছর পর যদি বিবেচনা করা হয় সেটিও দয়া বা অনুকম্পা। ১০ বছর পর পুনঃস্থাপন করাও দয়ারই অংশ। অবসরে যাওয়া পেনশনভুক্তদের বয়স, পারিবারিক অসচ্ছলতা ও বার্ধক্য বিবেচনায় সরকার এ প্রক্রিয়ায় সম্মতি দিয়েছে। বাস্তবায়নের দায়িত্ব অর্থ মন্ত্রণালয়ের।’
শতভাগ পেনশন গ্রহণকারীদের ২০১৭ সালে পুনরায় পেনশনের আওতায় এনে সমালোচনার মধ্যে পড়ে সরকার। মোট কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর তুলনায় সরকারি চাকরিজীবীরা একটি ক্ষুদ্র অংশ। তারা এমনিতেই সুবিধাভোগী। যুদ্ধ বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মহামারী বা অর্থনৈতিক মন্দা কোনো কিছুতেই বন্ধ থাকে না সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন-ভাতা। করোনা মহামারীতে বেসরকারি প্রায় সব সেক্টর ধসে পড়লেও, একমাত্র সরকারি কর্মচারীরা নিয়মিত বেতন-ভাতা পেয়েছেন। আর বেসরকারি অনেক খাতে বেতন দেওয়া তো দূরের কথা, কর্মক্ষেত্রই বন্ধ করে দেওয়া হয়। কিছু সেক্টর প্রণোদনার ওপর ভর দিয়ে টিকে ছিল। এইতো গেল মহামারীর সময়ের কথা। স্বাভাবিক নিয়মে তারা অবসরে গেলেও মাসে মাসে পান পেনশনের টাকা। ফলে আর্থসামাজিক অবস্থায় অনেকটা নির্ভার থাকেন সরকারি চাকরিজীবীরা। তাদের নির্ভার রাখতে গিয়ে আর্থিক খাতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। তাছাড়া সরকারের এ সুবিধাভোগী শ্রেণিকে টিকিয়ে রাখতে হয় সাধারণ করদাতাদেরই।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক ড. মুস্তফা কে মুজেরী বলেন, ‘দেশের মোট কর্মশক্তির ক্ষুদ্র একটা অংশ সরকারি চাকরিজীবী। ৮৫ শতাংশ মানুষই বেসরকারি চাকরি অথবা দরিদ্রসীমায় আয় করে। সরকারি চাকরিজীবী ক্ষুদ্র অংশকেই সন্তুষ্ট করতে সজাগ রাষ্ট্র। সাধারণ শ্রমজীবীদের কথা বিবেচনায় আনা হচ্ছে না।’
তিনি বলেন, ‘সরকারি কর্মচারীদের সুযোগ বাড়াতে গিয়ে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা মূল্যায়ন করা হচ্ছে না। বেতন-মজুরির নিশ্চয়তা পাচ্ছে না অন্য পেশার জনগণ। ফলে ক্ষুদ্র সেই চাকরিজীবী গোষ্ঠীর সঙ্গে বাকিদের জীবন-মানে বৈষম্য বাড়ছে, যা ন্যায়নীতি-সমতার পরিপন্থী।’
তিনি আরও বলেন, ‘২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের যে বৈষম্যবিরোধী স্পিরিট সেটিও এখানে লঙ্ঘিত হচ্ছে। শুধু সরকারি চাকরিজীবীদের নিরাপত্তার কথা ভাবাটা একদমই সমীচীন নয়। সরকার শুধু একশ্রেণির জন্যই পে-কমিশন গঠন করল, মহার্ঘ্য ভাতার আয়োজন করল, বিশেষ ব্যবস্থায় বেতন বাড়ানো হলো কিন্তু তার একটিও অন্য পেশার জন্য হয়নি।’
অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, পেনশন খাতে সরকারের আলাদা কোনো বাজেট নেই। পেনশনারদের টাকা দেওয়া হয় সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি থেকে। সরকার সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বড় কর্মসূচি হিসেবে দেখায়, যা দিয়ে সরকার মানবিক রাষ্ট্র গঠনের চেষ্টার কথা প্রচার করে। কিন্তু এ খাতের বড় একটি অংশই চলে যায় সরকারি কর্মচারীদের জন্য। ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘সামাজিক নিরাপত্তা খাতের ব্যাপ্তি এবং গুরুত্ব বিবেচনায় আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরে ১ লাখ ১৬ হাজার ৭৩১ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখার প্রস্তাব করছি। এ ক্ষেত্রে পেনশন ছাড়া সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর জন্য ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বরাদ্দের পরিমাণ দাঁড়াবে ৮১ হাজার ২৯৭ কোটি টাকা।’ অর্থাৎ, পেনশন খাতে সরকারের মোট ব্যয় হয় প্রায় ৩৫ হাজার ৪৩৪ কোটি টাকা।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাজেটের বড় অংশ চলে যায় পেনশন দিতে। তাতে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী ও উন্নয়নবঞ্চিতরা আরও বঞ্চিত হন। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বাজেট থেকে পেনশন খাত আলাদা করা উচিত।
সরকারের কর্মচারীদের দাবি ছিল, পেনশন পুনঃস্থাপনের অপেক্ষাকাল ১৫ থেকে কমিয়ে ৮ বছরে নামিয়ে আনা। কিন্তু মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে অনুষ্ঠিত বৈঠকে তা ১০ বছর নির্ধারণ করা হয়। সমালোচনার ভয়ে তা ১০ বছরে স্থির করা হয় বলে জানা গেছে। এ ছাড়া, পুনঃস্থাপনের আগে কেউ মারা গেলে তার স্বামী/স্ত্রী বা যোগ্য উত্তরাধিকারীদের পেনশন সুবিধা দেওয়ার বিষয়টিও পর্যালোচনার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
পলিসি এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান এম মাশরুর রিয়াজ এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘এক ব্যক্তি কীভাবে দুবার পেনশন পান, এটি খুবই আশ্চর্যের বিষয়। পেনশনের ওয়ার্ল্ড ওয়াইড যে নীতিমালা আছে, সেটি অনুসরণ করা উচিত। এক ব্যক্তির ডাবল কাউন্টিং হওয়া উচিত নয়। এমনিতেই আমাদের সীমিত সম্পদ। জনগণের ট্যাক্সের টাকার সুবিধা একজন বারবার পেলে অন্যরা বঞ্চিত হবে।’
সরকারের পেনশন নিয়ে নানা ধরনের সিদ্ধান্তের সমালোচনা রয়েছে সরকারের ভেতরেই। যারা এককালীন পেনশন সুবিধা গ্রহণ না করে অর্ধেক সুবিধা নিয়েছেন, তারা পেনশন পুনঃস্থাপন অপেক্ষাকাল সিদ্ধান্তের সমালোচনা করছেন। তারা বলছেন, এতে সরকারের আর্থিক ক্ষতি হবে। জনমনে সরকারের বৈষম্যের বার্তা যাবে। বর্তমানে পেনশন পুনঃস্থাপন সুবিধা পাচ্ছেন প্রায় ৪০ হাজার কর্মকর্তা। আর মোট পেনশনারের সংখ্যা প্রায় আট লাখ বলে অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
১৯৯৪ সাল থেকে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ‘শতভাগ’ পেনশন বিক্রি বা সমর্পণ প্রথা চালু হয়। বর্তমান বেতন স্কেলে সপ্তম গ্রেডের একজন কর্মকর্তা মাসিক পেনশন নেওয়ার শর্তে এককালীন প্রায় ৫০ লাখ টাকা তুলতে পারতেন এবং মাসে প্রায় ৩০ হাজার টাকা ভাতা পেতেন। কিন্তু যদি তিনি পুরো পেনশন তুলে নেন, তাহলে একসঙ্গে উত্তোলন করতেন প্রায় এক কোটি টাকা। সে ক্ষেত্রে মাসিক কোনো পেনশন মিলত না। সরকারের এ সিদ্ধান্তে সে সময় এককালীন পেনশন তোলার প্রবণতা বাড়তে থাকে। অনেক কর্মকর্তা সেই অর্থ নিয়ে বিদেশে চলে যান। অনেকে দেশে উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ না করে ভোগে ব্যয় করেন। এতে অর্থনীতিতে চাপ বাড়তে থাকে। পরে সরকার ২০১৭ সালের ৩০ জুন শতভাগ পেনশন বিক্রি পদ্ধতি বন্ধ করে। পাশাপাশি একই বছরের ১ জুলাই থেকে পেনশনের ৫০ শতাংশ সরকারের কাছে বাধ্যতামূলকভাবে সংরক্ষণের বিধান চালু করে।
রাজধানীর বাংলা মোটরের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের একজন কর্মকর্তা নাম-ঠিকানা না প্রকাশ করার শর্তে বলেন, ‘এটা জনগণের ট্যাক্সের টাকার লুটপাট ছাড়া আর কিছু নয়। যে কর্মকর্তা জেনে-শুনে মাসিক পেনশন সুবিধা না নিয়ে এককালীন কোটি টাকা উত্তোলন করলেন, তাকেই আবার ১৫ বছর পর মাসিক পূর্ণ পেনশন দেওয়া হচ্ছে! এখন এ সময়কে আরও এগিয়ে ১০ বছর করার প্রস্তাব এসেছে, যা স্পষ্টতই দুর্নীতি ও অন্যায়।’
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হলে সরকারের ব্যয় আরও বেড়ে যাবে। তাদের হিসাবে, একজন কর্মকর্তা যদি মাসে গড়ে ৫০ হাজার টাকা পেনশন পাওয়ার যোগ্য হন, তবে মাত্র পাঁচ বছরেই তার জন্য সরকারের অতিরিক্ত খরচ দাঁড়ায় প্রায় ৩০ লাখ টাকা। কয়েক হাজার কর্মকর্তার ক্ষেত্রে এ খরচের পরিমাণ কয়েক হাজার কোটি টাকায় পৌঁছাবে। সরকারের পেনশন খাতে যে বরাদ্দ সময়সীমা কমালে এ খাতের ব্যয় আরও ফুলেফেঁপে উঠবে। এর ফলে উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থায়ন, সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রম কিংবা অবকাঠামো খাতে বাজেট সংকোচনের আশঙ্কা রয়েছে।
এদিকে অবসরপ্রাপ্ত সরকারি চাকরিজীবীদের শতভাগ পেনশন হস্তান্তরের ১০ বছরের মাথায় নতুন করে পেনশন সুবিধা পাওয়ার এ বিধান সরকারের সর্বজনীন পেনশন স্কিম ধারণার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। কারণ সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচিতে দেশের সব নাগরিককে একটি সমধর্মী প্ল্যাটফর্মে অন্তর্ভুক্ত করার বিধান রয়েছে। সেই লক্ষ্য বাস্তবায়নে কাজ করছে সর্বজনীন পেনশন কর্তৃপক্ষ। আইন দ্বারা সৃষ্ট এ প্রতিষ্ঠানের অধীনে বিভিন্ন পেশাভিত্তিক নাগরিকদের জন্য ভিন্ন ভিন্ন পেনশন স্কিম রয়েছে। ওইসব স্কিমের মধ্যে সরকারি চাকরিজীবীদের জন্যও নির্ধারিত স্কিম রয়েছে। কিন্তু সরকারি চাকরিজীবীরা সেই ব্যবস্থা নিজেদের জন্য চালু না করলেও অন্যদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিচ্ছেন। আর নিজেরা বাড়তি সুবিধার সরকারি পেনশনের মধ্যেই অবস্থান করছেন। এ বিষয়টি নিয়ে এরই মধ্যে নানা ধরনের জটিলতা দেখা দিয়েছে।
চাকরিজীবীদের বেতন-ভাতা নতুন করে নির্ধারণ করতে গত জুলাই মাসে নবম পে-কমিশন গঠন করে সরকার। বর্তমানে ২০১৫ সালে সর্বশেষ পে-কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী বেতন-ভাতা নির্ধারণ করা হয়। এরপর প্রায় ১০ বছর পার হয়ে গেলেও কর্মচারীদের বেতন বাড়ানো হয়নি। বৈশি^ক করোনা মহামারী ও ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো ছিল না। এ কারণে সরকার কর্মচারীদের সুবিধা বাড়ায়নি। এর মধ্যে গত বছর ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর কর্মচারীরা তাদের বেতন বাড়ানোর দাবি তোলেন। এ ছাড়া সচিবালয়ের নন-ক্যাডার কর্মকর্তারা পুলিশ, বিজিবি, ফায়ার সার্ভিসের মতো রেশন সুবিধা দাবি করে আসছেন। সরকারের উপদেষ্টারা বেতন বাড়ানোর পাশাপাশি রেশন সুবিধা দেওয়ারও আশ্বাস দিয়েছেন।
সম্পাদক মন্ডলীর সভাপতিঃ মোহাম্মদ আফছার খান সাদেক
সম্পাদক ও প্রকাশকঃ মিলাদ মোঃ জয়নুল ইসলাম
প্রকাশনালয়ঃ রিপোর্টার লজ, কসবা, বিয়ানীবাজার, সিলেট ।
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ উত্তর বাজার কেন্দ্রিয় মসজিদ মার্কেট (২য় তলা), বিয়ানীবাজার, সিলেট ।
মোবাঃ ০১৮১৯-৬৫৬০৭৭, ০১৭৩৮-১১ ৬৫ ১২
ইমেইলঃ agamiprojonma@gmail.com, milad.jaynul@gmail.com