প্রকাশনার ১৬ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

৭ই ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
২২শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
১৬ই জমাদিউস সানি, ১৪৪৭ হিজরি

রাজধানীর স্থবির জীবন

editor
প্রকাশিত নভেম্বর ৬, ২০২৫, ০৮:৩৫ পূর্বাহ্ণ
রাজধানীর স্থবির জীবন

Manual2 Ad Code

 

 

প্রজন্ম ডেস্ক:

যানজট যেন ঢাকা শহরের প্রতিদিনের অনিবার্য বাস্তবতা। প্রতিদিন সকালে লাখো মানুষ রাজধানীর রাস্তায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে থেকে কর্মস্থলে পৌঁছানোর লড়াই চালিয়ে যান। এই প্রতিবেদক তার ৩৩ কিলোমিটার পথ পাড়ি দেওয়ার অভিজ্ঞতায় ঢাকার যানজটের বাস্তব চিত্র তুলে ধরেছেন। যেখানে ক্লান্তি, ধৈর্য ও নিঃশব্দ হতাশা মিলেমিশে আছে নগরজীবনের টিকে থাকার সংগ্রামে।

 

গাবতলীতে যাত্রা শুরু

Manual4 Ad Code

রবিবার (২ নভেম্বর) সকাল ৮টা ৪০ মিনিট: রাজধানী ঢাকার গাবতলী বাসটার্মিনালের বাতাস ভারী— ধোঁয়া, ধুলা ও অধৈর্যের মিশ্রণে একাকার।

সারিবদ্ধ বাসগুলো ইঞ্জিন চালিয়ে ধোঁয়া ছাড়ছে, তাদের হর্ন বাজছে যেন এক অনন্ত তর্ক। চালকেরা গর্জন করছেন, কনডাক্টররা চিৎকার করছে, যাত্রীরা ঘামে ভিজে ব্যাগ আঁকড়ে ধরে বাসে ওঠার যুদ্ধে লিপ্ত।

সেদিন সকালে এই প্রতিবেদকও গাবতলী থেকে উঠেছিলেন একটি বাসে। গন্তব্য ডেমরা স্টাফ কোয়ার্টার।

 

গুগল ম্যাপ জানিয়েছিল, সময় লাগবে এক ঘণ্টা ২৭ মিনিট; তবে বাস্তবে লেগেছিল প্রায় চার ঘণ্টা।

 

বাস যেন ছাড়তেই চায় না

Manual4 Ad Code

সকাল ৮টা ৫০ মিনিটে প্রতিবেদক উঠেছিলেন আছিম পরিবহনের একটি বাসে। বাসের ভেতরটা তখন যেন এক জ্বলন্ত স্টোভ। গরমে হাঁসফাঁস অবস্থা যাত্রীদের। চালক যেন তাড়াহুড়োর মানুষ নন। তিনি আরও ১০ মিনিট বাসটি দাঁড় করিয়ে রাখলেন, যতক্ষণ না প্রতিটি আসন পূর্ণ হলো।

পুরো বাসটিই যেন ঢাকার পরিবহন ইতিহাসের সাক্ষী। অনেকটা লক্কড়-ঝক্কর অবস্থা, রঙের প্রলেপে বাসের ক্ষত ঢাকার চেষ্টা বিভিন্ন জায়গায়, সঙ্গে ভাঙা জানালা।

আসনগুলো এতটাই ঠাসা যে যাত্রীরা নিজেদের শরীর ভাঁজ করে বসেছেন, হাঁটু ঠেকেছে সামনের সিটের লোহার।

 

যাত্রীরা চিৎকার করে কনডাক্টরকে বললেন, “বাস চলবে নাকি বসে থাকবো?” চালক কাঁধ ঝাঁকিয়ে হর্ন বাজালেন। অবশেষে অনেক চিৎকার-চেঁচামেচির পর বাসটি সামনে এগোলো। ধোঁয়ার মেঘ রেখে গেলো পেছনে, সঙ্গে নিয়ে চললো বিশৃঙ্খলা।

 

মিরপুরের সকাল, শামুকগতি

গাবতলী থেকে মিরপুর-১১ পর্যন্ত ৬ দশমিক ৫ কিলোমিটার যেতে লেগেছে ৫২ মিনিট।

বাসটির গতি ছিল ঘণ্টায় মাত্র ৭ দশমিক ৫ কিলোমিটার। যা পায়ে চালিত সাইকেলের চেয়েও ধীরগতি।

আইন অনুযায়ী বড় বাসে ৫২ জন যাত্রীর সীমা থাকলেও, ওই বাসে ছিলেন অন্তত ৭০ জন। ১৫ জন দাঁড়িয়ে, আর কমপক্ষে ১০ জন দরজা ঝুলে ছিলেন।

ঢাকার সড়ক পরিবহন আইন অনুযায়ী, প্রতিটি যাত্রীর জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ জায়গা বরাদ্দ থাকার কথা—কিন্তু বাস্তবে তা কেবল কাগজেই।

বাসের যাত্রী মিরপুরের বাসিন্দা এক দোকানি বললেন, “আমরা মুরগির খাঁচায় বসে আছি। তারপরও ভাড়া বাড়ে।”

 

বাসটি মিরপুর-১০ এ পৌঁছালে কন্ডাক্টর নেমে ট্র্যাফিক পুলিশের সঙ্গে তর্ক শুরু করেন। তার ভাষ্য, “আজ যদি জরিমানা দেন, কাল আমার সংসার না খেয়ে থাকবে।”

অসহায়তা যেন সবার—পুলিশ, চালক, যাত্রী সবাই একই ফাঁদে বন্দি।

 

৮ স্টপেজ, থামলো ৬৮ বার

গাবতলী-ডেমরা রুটে অফিসিয়ালি ৮টি স্টপেজ, কিন্তু সেদিন বাস থেমেছিল ৬৮ বার। চালক ব্রেক কষেছেন তার ইচ্ছেমতো।

জানতে চাইলে কন্ডাক্টর মোহাম্মদ ইব্রাহিম খলিল বললেন, “জ্বালানি খরচেই দিনে ৪ হাজার ৫০০ টাকা লাগে। মালিককে দিতে হয় ২ হাজার ৭০০। ভালো দিনে ৩ হাজার টাকা লাভ হয়, কিন্তু জ্যামে কিছুই থাকে না। তাই বাড়তি যাত্রী তুলি।”

বাসের যাত্রী মিরপুরের ব্যবসায়ী মো. হোসেন বললেন, “জীবনের অর্ধেক সময় কেটেছে জ্যামে। ঢাকা আমাকে ধৈর্য শিখিয়েছে, উন্নতি নয়।”

 

যাত্রার এক ঘণ্টা ২০ মিনিট পর সকাল ১০টা ১০ মিনিটে বাসটি কুড়িল ফ্লাইওভারে পৌঁছায়। ততক্ষণে বেশিরভাগ যাত্রী নীরব, ক্ষোভের শব্দ বদলে গেছে ক্লান্ত নীরবতায়।

 

স্মৃতির চেয়েও ধীরে চলছে শহর

ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের (ডিটিসিএ) তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীর ৬৪ শতাংশ যাতায়াত বাসে হয়। গড় গতি ঘণ্টায় ৯ দশমিক ৭ কিলোমিটার; পিক আওয়ারে তা নেমে আসে ৫–৭ কিলোমিটারে। যা প্রায় একজন পথচারীর গতির সমান।

ঢাকা এমন এক শহর যেখানে সময়ও আটকে যায়। প্রতিটি বিরতি অনন্ত, প্রতিটি হর্ন অসহায়তার আর্তনাদ।

যমুনা ফিউচার পার্কের সামনে এই প্রতিবেদক দেখেছেন, শত শত মানুষ বাস ধরার জন্য হাত নাড়ছেন।

বেশিরভাগ বাসই পূর্ণ, কেউ জানালা দিয়ে ঢোকার চেষ্টা করছে, কেউ দরজায় ঝুলছে। বাতাসে গালাগাল ও ধোঁয়ার মিশ্রণ।

বাসের ভেতরে হঠাৎ শুরু হয় হাফ ভাড়া ঘিরে তর্ক। ছাত্রটির দাবি, “আমার হাফ ভাড়া।”

কন্ডাক্টর বলে, “সবাই ছাড় চায়, কিন্তু ডিজেলের দাম জানো?”

ছাত্রের জবাব, “এই শহরে বেঁচে থাকার দাম জানো?”

 

ভিড়, হয়রানি ও ক্লান্তি

এই শহরে বাসের ভিড়ভাট্টা যেন প্রতিদিনের অপমানেরও মঞ্চ। যাত্রীর ভিড়ে নারীরা হয়রানির শিকার হন, পকেটমাররা অবাধে ঘোরে।

 

অফিস কর্মী মো. কামরুজ্জামান বললেন, “তারা দলবেঁধে কাজ করে। একজন ধাক্কা দেয়, আরেকজন ব্যাগ কেটে নেয়।”

যাত্রাপথে প্রতিবেদক নিজ চোখে দেখেন, এক নারী চিৎকার করছেন পাশের এক যাত্রীকে উদ্দেশ করে—“লজ্জা নেই? আবার ছোঁবে তো পুলিশ ডাকবো!”

পুরুষটি পরের স্টপেজেই নেমে গেলেন। কেউ কিছু বললো না।

এই নীরবতা যেন ঢাকার নাগরিক নিয়ম—মাথা নিচু রাখো, বেঁচে থাকো।

 

চালকদের অভিযোগ

চালক কামরুল ইসলামের কণ্ঠে ক্ষোভ স্পষ্ট—“প্রতিবছর জ্যাম বাড়ছে। গাড়ির সংখ্যা বাড়ে, লেন হয় না। নিয়ম না ভাঙলে মালিককে টাকা দিতে পারবো না।”

বাস মালিকরা “জমা” পদ্ধতিতে গাড়ি দেন। চালক প্রতিদিন নির্দিষ্ট ভাড়া দেন, বাড়তি আয় তার নিজের। ফলে যত বেশি যাত্রী, তত লাভ। প্রতিটি অবৈধ থামা বা ওভারলোড একপ্রকার বাঁচার চেষ্টা।

কামরুল বলেন, “সবাই আমাদের দোষ দেয়। কিন্তু সিস্টেমটাই যদি দুর্বল হয়, আমরা সোজা চালাবো কীভাবে?”

 

দুর্ঘটনা ও স্থবিরতা

রামপুরা ব্রিজে এসে যাত্রা পুরোপুরি থেমে যায়। “সামনে দুর্ঘটনা,” কনডাক্টরের চিৎকার। উলটে থাকা ট্রাক ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে রাস্তা বন্ধ করে রেখেছে, উদ্ধার দল আসেনি।

যাত্রীরা পায়ে হেঁটে এগোয়, ময়লা ও কাদার মাঝ দিয়ে। বাতাসে দুর্গন্ধ ও ধোঁয়ার মিশ্রণ। অগত্যা এই প্রতিবদেকও হেঁটে ট্রাকের বাধা পার হন।

যাত্রা শুরুর আড়াই ঘণ্টা পর দুপুর ১২টা ২ মিনিটে এই প্রতিবেদক আছিম পরিবহনের আরেকটি বাসে ওঠেন।

ব্যবসায়ী ফারিদুল ইসলাম পাশে বসে বলেন, “আমার ক্লায়েন্ট ডেমরায়। এই সময়ের মধ্যে নোয়াখালী গিয়ে ফিরে আসতাম।”

 

বিশৃঙ্খলার অর্থনীতি

ঢাকার সড়কের এই স্থবিরতা কেবল যানজট নয়, অর্থনীতির ক্ষয়ও বটে।

বিশ্বব্যাংকের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ঢাকার যানজটে প্রতিদিন ৫০ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়, ক্ষতি বছরে প্রায় ১২ বিলিয়ন ডলার।

নগর পরিকল্পনাবিদদের মতে, এর কারণ অসংখ্য সংস্থা, দুর্বল প্রয়োগ ও রাজনৈতিক উদাসীনতা।

পরিবহন বিশ্লেষক শামসুল হক বলেন, “প্রতিটি ফ্লাইওভার বা মেট্রোরেল মূল সমস্যার ওপরে সাময়িক প্রলেপ মাত্র। আমাদের দরকার সমন্বিত ব্যবস্থা, নতুন রাস্তা নয়।”

বাসে তখন ক্লান্তির চিহ্ন স্পষ্ট। একজন দাঁড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়েছেন, আরেকজন শিশু কোলে ধরে দুলছেন।

সবার চোখে একই ভাষা, “অরাজকতা মেনে নাও, না হলে তাতে পিষ্ট হও।”

 

স্থিতির শহর

যাত্রা শুরুর তিন ঘণ্টা ৪৪ মিনিট পর দুপুর ১২টা ৩৪ মিনিটে প্রতিবেদক পৌঁছান ডেমরা স্টাফ কোয়ার্টারে। বাসের গড় গতি ছিল ঘণ্টায় মাত্র ৮ দশমিক ৮ কিলোমিটার।

বাস থেকে নামা মানে যেন বন্দিদশা থেকে মুক্তি। শরীর ব্যথায় ভরা, ফুসফুস ধুলোয় জ্বলছে, সময়ের হিসাব যেন হারিয়ে গেছে। তবু লাখো মানুষের কাছে এটাই দৈনন্দিন রুটিন।

প্রতিদিন সকালে ঢাকা জেগে ওঠে একই ছন্দে—ক্ষোভ ও সমর্পণের।

Manual7 Ad Code

কর্মজীবীরা ঘর ছাড়েন ঘণ্টাখানেক আগেই, শিক্ষার্থীরা যানজটের মানচিত্র মুখস্থ করে ফেলেন, চালকেরা ভাগ্যকে গালাগাল করেন। সবাই মানিয়ে নেয়।

 

“এই শহর চলে না, এটা শুধু টিকে আছে”, বললেন ফারিদুল ইসলাম নামের এক যাত্রী।

 

আটকে থাকা শহরের চিত্র

ঢাকার পরিবহন স্থবিরতা যে তার শাসনব্যবস্থার প্রতিচ্ছবি। বিভক্ত, প্রতিক্রিয়াশীল ও লেনদেননির্ভর।

ট্র্যাফিক ব্যবস্থাপনায় ৪০টিরও বেশি সংস্থা কাজ করে, কিন্তু সমন্বয় নেই।

মেট্রোরেল, বিআরটি করিডোর, অসংখ্য ফ্লাইওভারে বিনিয়োগ হলেও মূল কাঠামো অপরিবর্তিত।

বেসরকারি বাস, যেগুলো অনিয়ন্ত্রিত ও লাভকেন্দ্রিক, নিয়ন্ত্রণ করছে ৮০ শতাংশ পরিবহন বাজার। ফলাফল—অরাজকতা।

২০১৯ সালে সিপিডির এক প্রতিবেদনে সতর্ক করা হয়েছিল, ২০৩৫ সালের মধ্যে ঢাকায় গড় গতি ঘণ্টায় ৫ কিলোমিটারের নিচে নেমে যাবে। যা একজন পথচারীর হাঁটার চেয়েও ধীর। সেই ভবিষ্যৎ এখন বাস্তব।

 

স্থবিরতার প্রতীক

সেদিনের সেই দীর্ঘযাত্রায় এই প্রতিবেদকের কাছে ঢাকা ধরা দিলো চলমান কিন্তু অচল এক শহর হয়ে।

ঢাকার সড়ক যেন দেশের বৈপরীত্যের প্রতিফলন। সমন্বয়হীন উচ্চাকাঙ্ক্ষা, বিশ্রামহীন স্থিতি, আর দিকহীন গতি।

সেদিন আছিম পরিবহনের সেই বাসে ৭০টি গল্প ছিল—কর্মজীবী, ছাত্র, বিক্রেতা, মা—সবাই টিকে থাকার একই ধীর স্রোতে ভাসমান।

তাদের ক্লান্তি ছিল সম্মিলিত, ধৈর্য ছিল অনিচ্ছাকৃত, সহনশীলতা ছিল অযথার্থ।

Manual8 Ad Code

বাসের দরজা খুলে গেলে একজন যাত্রী বলে উঠলেন, “এখানে সময়ের কোনও দাম নেই। ঢাকায় আমরা চলি না—বেঁচে থাকি।”

Sharing is caring!

Manual1 Ad Code
Manual7 Ad Code