প্রজন্ম ডেস্ক:
বাংলাদেশের রাজনীতিতে আলোচনা আছে, ভোটের মাঠে অনেক সময় ব্যক্তির জনপ্রিয়তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে দলীয় প্রতীক। বিশেষ করে ধানের শীষ ও নৌকা প্রতীক ভোটারদের কাছে অনেক জনপ্রিয় বলে মনে করা হয়।
কিন্তু আরপিও (গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ) সংশোধন অনুযায়ী, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জোটের প্রতীকে ভোট করতে পারছে না শরিক দলগুলো। অর্থাৎ বিএনপির সঙ্গে জোট হলেও ধানের শীষ প্রতীকে ভোট করতে পারছেন না তারা। ফলে জয়ের ব্যাপারে ঝুঁকিতে পড়তে পারে বিএনপির জোট শরিকরা। ছোট দলগুলোর দলীয় প্রতীক ভোটারদের কাছে অনেকটাই অপরিচিত।
গত বছরের ৫ আগস্টের পর নিবন্ধন পাওয়া দলগুলোর মধ্যে আরও বেশি উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা কাজ করছে। দলীয় প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করার সিদ্ধান্তের কারণে অনেক নেতা-কর্মী নির্বাচনি প্রচারে অংশ নেবেন কি না, তা নিয়েও শঙ্কায় রয়েছে জোট শরিকরা।
দলগুলোর একাধিক নেতা বলছেন, আরপিও সংশোধনের পর আসন ছাড় পেলেও নতুন ভাবনায় পড়েছেন তারা। তাদের মতে, নির্বাচনের ঠিক আগ মুহূর্তে সরকারের এমন সিদ্ধান্তে জোট শরিক হিসেবে ছোট দলের প্রার্থীরা ভোটের মাঠে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারেন। কিন্তু ধানের শীষ প্রতীকে ভোট করতে পারলে তাদের জয় অনেকটা সহজ হতো। কিন্তু নিজস্ব প্রতীকে জয় পাওয়া বেশ কঠিন হবে।
সূত্র জানায়, নির্বাচনকে সামনে রেখে ২৩৬ আসনে সম্ভাব্য প্রার্থী ঘোষণা করেছে বিএনপি। বাকি ৬৪টি আসনের মধ্যে কিছু আসন শরিকদের জন্য রাখা হয়েছে। ইতোমধ্যে ১২ জন শরিককে সুবজ সংকেত দেওয়া হয়েছে। বিএনপির সঙ্গে আসন সমঝোতা নিয়ে শরিকদের সঙ্গে দর-কষাকষি চলছে। কিন্তু বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ হলেও ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ বন্ধ হয়ে গেছে শরিকদের। এতে শরিকদের জয় নিয়েও দুশ্চিন্তায় পড়েছে বিএনপি।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘আমাদের সঙ্গে আন্দোলনে থাকা দলগুলোকে সর্বোচ্চ মূল্যায়ন করা হবে। তাদের কে কোথায় নির্বাচন করবে, তার আলোচনা চলছে। দ্রুতই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেওয়া হবে।’
গত ৩ নভেম্বর প্রকাশিত নির্বাচনসংক্রান্ত আইন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ বা আরপিও গেজেট আকারে প্রকাশ হয়। সে অনুযায়ী নির্বাচনে অংশ নিতে হবে নিজ দলের প্রতীকে। তবে যেসব দলের নিবন্ধন নেই তারা অন্য দলের প্রতীক অর্থাৎ ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে। এর ফলে যাদের নিবন্ধন নেই তারা স্বস্তিতে আছে। তবে নির্বাচনের জয়ের ব্যাপারে শরিকরা জোটপ্রধানের সঙ্গে আলোচনা করে সামনের দিকে এগোতে চায়।
বিএনপির নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, যেসব আসনে শরিকদের ছাড় দেওয়া হবে সেই সব আসনে ধানের শীষের কোনো প্রার্থী দেওয়া হবে না। এছাড়া দলের বিদ্রোহী প্রার্থী হতে সবাইকে নিরুৎসাহী করা হবে। যদি কেউ দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে নির্বাচনে অংশ নেয় তার বিরুদ্ধে বহিষ্কারের মতো কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। একই সঙ্গে বিদ্রোহী প্রার্থীর সঙ্গে যারা নির্বাচনি মাঠে কাজ করবে তাদের বিরুদ্ধেও কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ছাড়া জোটপ্রার্থীরা নিজস্ব ক্যারিশমায় বিএনপির নেতা-কর্মীদের কতটা সংগঠিত করতে পারেন, তার ওপরও জোট শরিকদের জয় নির্ভর করছে।
জানা গেছে, ফ্যাসিবাদবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনে ৪০টির মতো দল ছিল। দলগুলোর মধ্যে রয়েছে ১২-দলীয় জোট, ১১ দলের জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, ৬ দলের গণতন্ত্র মঞ্চ, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি), বাম গণতান্ত্রিক জোট, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি), গণঅধিকার পরিষদ, জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন (এনডিএম), গণফোরাম, লেবার পার্টি। এই দলগুলোর চার-পাঁচজন নেতা ছাড়া শরিকদের বেশির ভাগের নিজস্ব কোনো ভোটব্যাংক না থাকায় তাদের জয়ের সম্ভাবনা কমে যেতে পারে। শরিকরা নির্বাচনি বৈতরণী কীভাবে পার হবেন তার হিসাব-নিকাশও মেলানো কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে বিএনপির পক্ষে।
দলটির দুশ্চিন্তার আরও বড় কারণ হলো, শেখ হাসিনা ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের পরপর তিনটি নির্বাচনে গোয়েন্দা সংস্থা এবং প্রশাসনের প্রভাব খাটিয়ে শরিক দলের প্রার্থীদের জয়লাভ করিয়ে এনেছেন। অনেকের মতে, শেখ হাসিনা শুধু প্রার্থীদের নামের তালিকা দিয়েছেন; ফলাফল ঠিক করেছে প্রশাসন। শুধু মনোনয়ন পেয়েই তারা পাস করেছেন। এমনকি তাদের অনেককে নির্বাচনে তেমন অর্থও খরচ করতে হয়নি। কিন্তু ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে সেই ধরনের নির্বাচন কোনোভাবেই সম্ভব হবে না বলে বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল মনে করছে।
তাদের মতে, দেশের বিদ্যমান বাস্তবতায় বিএনপি বা কোনো দলের ইচ্ছায় প্রার্থীদের জয়লাভ করা সম্ভব হবে না। জনগণের ভোটের মাধ্যমেই তাদের জয়লাভ করতে হবে।
এছাড়া প্রতিটি আসনে বিএনপির একাধিক মনোনয়নপ্রত্যাশীর মধ্যে কেউ বিদ্রোহী হয়ে ভোটে অংশ নেন কি না, তা নিয়েও সংশয় রয়েছে বিএনপির ভেতরেই।
২০১৮ সালে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বগুড়া-২ আসনে নির্বাচন করেছিলেন। এবারও তিনি বিএনপির সবুজ সংকেত পেয়েছেন। মান্না বলেন, ‘আরপিও সংশোধন হলেও জয়ের ব্যাপারে বড় কোনো ঝুঁকি দেখছি না। তবে ধানের শীষ জনপ্রিয় প্রতীক। আমি আশা করি, জোট শরিক হিসেবে এবার ধানের শীষ প্রতীক না পেলেও নেতা-কর্মী ও ভোটারদের কাছে নিজেকে ধানের শীষের লোক হিসেবে বোঝাতে সক্ষম হব।’
১২-দলীয় জোটের মুখপাত্র ও বাংলাদেশ এলডিপির চেয়ারম্যান শাহাদাত হোসেন সেলিমকে লক্ষ্মীপুর-১ আসনে সবুজ সংকেত দিয়েছে বিএনপি। তিনি বলেন, উচ্চ কক্ষে পিআর পদ্ধতি (সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধি) হবে ভেবে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আলোচনায় বেশির ভাগ দলই জোটের প্রতীকে বেশি গুরুত্ব দেয়নি। এখন সবাই হায়-হায় করছে। কারণ সংসদ নির্বাচনে প্রতীকও একটা ব্যাপার। জোট শরিকরা প্রতীক পাবেন না এমন ঘটনায় বিএনপিও চিন্তিত হয়ে পড়েছে। তবে যাদের নিবন্ধন নেই তারা বেঁচে গেছেন।
কিশোরগঞ্জ-৫ আসনে বিএনপির সবুজ সংকেত পেয়েছেন বাংলাদেশ জাতীয় দলের চেয়ারম্যান ও ১২-দলীয় জোটের সমন্বয়ক সৈয়দ এহসানুল হুদা। তিনি বলেন, ‘আমার দলের নিবন্ধন নেই। আমি জোটের ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন করব।’
ঢাকা-১৩ আসনে জোটের প্রার্থী হিসেবে জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের (এনডিএম) চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজকে সবুজ সংকেত দিয়েছে বিএনপি। তার দল এনডিএমের প্রতীক সিংহ। ববি হাজ্জাজ বলেন, ‘জোট শরিকদের প্রতীক দেওয়া নিয়ে একটা ষড়যন্ত্র চলছে। সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর পরামর্শ ছাড়াই আরপিও সংশোধন করেছে। আমরা জোটের সঙ্গে চূড়ান্ত আলোচনার পরই প্রতীক বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেব। ইতোমধ্যে জোটের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনি এলাকায় গণসংযোগ শুরু করেছি।’
২০১৮ সালে ধানের শীষে নির্বাচন করেছেন লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) মহাসচিব ড. রেদোয়ান আহমেদ। এবারও তিনি কুমিল্লা-৭ আসন থেকে নির্বাচন করার জন্য বিএনপির সবুজ সংকেত পেয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমি ছাতা প্রতীক নিয়ে প্রচার চালাচ্ছি।’
সম্প্রতি ইসির নিবন্ধন পেয়েছে বাংলাদেশ লেবার পার্টি। দলটির প্রতীক আনারস। দলের চেয়ারম্যান ডা. মোস্তাফিজুর রহমান ইরান বলেন, ‘নতুন নিয়মে আমাদের কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। এর জন্য শরিকদের খেসারত দিতে হচ্ছে। অনেক ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে। জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপির আগ্রাসনের শিকার হয়েছি আমরা। বিএনপিসহ আমাদের কোনো কথায় কর্ণপাত করেনি সরকার।’
তিনি বলেন, আমি আনারস প্রতীক নিয়ে ব্যানার-ফেস্টুন নিয়ে নির্বাচনি এলাকায় ‘ডোর-টু-ডোর’ যাচ্ছি। আনারস প্রতীক স্থানীয় সরকার নির্বাচনে থাকায় অনেকটাই সুবিধা পাচ্ছি। কাউকে প্রতীক পরিচয় করিয়ে দেওয়া লাগছে না।
২০১৮ সালে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) সাধারণ সম্পাদক শহীদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপন ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করেছিলেন। তিনি বলেন, ‘আগেও সুযোগ ছিল নিজ প্রতীক বা জোটের প্রতীক নিয়ে অংশগ্রহণ। কিন্তু এবার আরপিও সংশোধন হয়েছে। জনপ্রিয় প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করলে কিছুটা সুবিধা পাওয়া যায়। মাঠে কার্যক্রম পরিচালনা করা সহজ হয়। তবুও নিজ দল ও দলের প্রতীক পরিচিত করার সুযোগ পাওয়া যাবে। এটা নিবন্ধিত দলগুলোর জন্য ভালো হবে।’
Sharing is caring!