# শীর্ষ সন্ত্রাসীদের সহযোগী হিসেবে অন্তত সহস্রাধিক কিশোর-তরুণ এখন মাঠে
# সন্ত্রাসীদের হাতে থাকা ক্ষুদ্র আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার কম
# আন্ডারওয়ার্ল্ড নিয়ন্ত্রণে তৎপর রয়েছে পুলিশ : ডিএমপি কমিশনার
প্রজন্ম ডেস্ক:
তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী তারিক সাইফ মামুনকে হত্যার পর জামিনে থাকা শীর্ষ সন্ত্রাসীরা অপরাধ জগৎ নিয়ন্ত্রণে আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠার আগাম সংকেত দিয়েছেন বলে তথ্য পেয়েছেন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যরা। গোয়েন্দাদের ভাষ্য, গত সোমবার প্রকাশ্যে গুলি করে শীর্ষ সন্ত্রাসী মামুনকে হত্যা করে সমাজে আতঙ্ক সৃষ্টির বার্তা দিতে চেয়েছেন তাঁরা। বুঝাতে চেয়েছেন শীর্ষ সন্ত্রাসীদের ছত্রছায়ায় সামনে এমন আরো অনেক খুনাখুনির ঘটনা ঘটতে পারে। লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধার সন্তোষজনক না হওয়ায় এটিও শঙ্কা বাড়িয়ে দিচ্ছে।
যদিও পরিস্থিতির আগাম গোয়েন্দা তথ্য পেয়ে এরই মধ্যে সারা দেশে পুলিশ ও র্যাবের পাশাপাশি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী সতর্ক রয়েছে বলে পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র বলছে।
পুলিশ ও আদালত সূত্র জানায়, গত ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর অন্তত ছয়জন শীর্ষ সন্ত্রাসী দীর্ঘ কারাবাসের পর জামিনে মুক্তি পান। এর মধ্যে রয়েছেন হাজারীবাগ এলাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী সানজিদুল ইসলাম ওরফে ইমন, ওরফে ইমন, ‘কিলার আব্বাস’ হিসেবে পরিচিত মিরপুরের আব্বাস আলী, মোহাম্মদপুরের ইমামুল হাসান হেলাল ওরফে পিচ্চি হেলালসহ ঢাকার অপরাধজগতের আরো দুই অন্যতম সদস্য খন্দকার নাঈম আহমেদ ওরফে টিটন ও খোরশেদ আলম ওরফে রাসু ওরফে ফ্রিডম রাসু। তাঁরা এখন দেশ ও দেশের বাইরে থেকে অপরাধজগৎ ‘আন্ডারওয়ার্ল্ড’ নিয়ন্ত্রণ করছে।
এর বাইরে বিদেশে থাকা শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানও দেশে সহযোগীদের দিয়ে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করছেন।
তদন্তসংশ্লিষ্ট এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, রাজধানীতে শীর্ষ সন্ত্রাসীদের সহস্রাধিক সদস্য রয়েছে। তাদের বেশির ভাগ এখনো অধরা রয়েছে। তাদের কাছে রয়েছে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র। মূলত চাঁদাবাজির পাশাপাশি হত্যাকাণ্ডে জড়িত রয়েছে এরা। অস্ত্রধারীদের বেশির ভাগ কিশোর তরুণ গ্যাং সদস্য।
জামিনে থাকা শীর্ষ সন্ত্রাসীদের মধ্যে ইমন গত ৫ আগস্টের পর জামিনে মুক্তি পেয়ে ব্যাঙ্ককে একসময়ের ‘ঢাকার মাফিয়া ডন’ হিসেবে পরিচিত আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের ডেরায় আত্মগোপন করেন। অন্যদিকে মোহাম্মদপুরের আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী জোসেফ আহমেদ ওরফে জোসেফও ৫ আগস্টের পর মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমিয়েছেন। তবে এই দুই শীর্ষ সন্ত্রাসী বিদেশে অবস্থান করে কলাবাগান, ধানমণ্ডি, জিগাতলা, রায়েরবাজার, মোহাম্মদপুর, বছিলা ও আদাবর এলাকার আন্ডারওয়ার্ল্ড নিয়ন্ত্রণ করছে বলে তথ্য পেয়েছেন গোয়েন্দারা।
তথ্য রয়েছে, ২০০১ সালের ২৫ ডিসেম্বর ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর নাম তৎকালীন সরকার ঘোষণা করেছিল। জুলাই অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ৫ থেকে ৮ আগস্ট পর্যন্ত মূলত দেশে কোনো সরকার ছিল না। তাঁদের মধ্যে ছয় শীর্ষ সন্ত্রাসী বর্তমানে জামিনে রয়েছেন। তাঁদের সবাই প্রায় ১৫ থেকে ২০ বছর জেল খেটেছেন।
জামিন পাওয়া শীর্ষস্থানীয় সন্ত্রাসীদের সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে আরো জানা গেছে, এঁদের মধ্যে পূর্ব রাজাবাজার এলাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী শেখ আসলাম ওরফে সুইডেন আসলাম, হাজারীবাগের সানজিদুল ইসলাম ইমনসহ ফ্রিডম রাসু ও পিচ্চি হেলাল, মিরপুরের আব্বাস উদ্দিন (কিলার আব্বাস নামে পরিচিত), মোহাম্মদপুরের ইমামুল হাসান হেলাল ওরফে পিচ্চি হেলাল, খোরশেদ আলম ওরফে রাসু ওরফে ফ্রিডম রাসু ও খন্দকার নাঈম আহমেদ ওরফে টিটন ও আব্বাস উদ্দিন ওরফে কিলার আব্বাস নিজ নিজ এলাকায় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে তৎপর। তাঁদের বাইরে শীর্ষ সন্ত্রাসীদের মধ্যে গ্রেপ্তার না হওয়া জিসান আহমেদ ওরফে জিসান দীর্ঘদিন ধরে মতিঝিল, রামপুরাসহ আরো কয়েকটি এলাকায় ব্যাপকভাবে চাঁদাবাজি শুরু করেছেন।
সাম্প্রতিক অপরাধমূলক পরিস্থিতি নিয়ে গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর মিন্টু রোডে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) মিডিয়া সেন্টারে জরুরি সংবাদ সম্মেলনে আন্ডারওয়াার্ল্ড নিয়ন্ত্রণে পুলিশ তৎপর রয়েছে জানিয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার (ডিএমপি) শেখ মো. সাজ্জাত আলী বলেন, আন্ডারওয়ার্ল্ড নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চলছে। পুরান ঢাকায় প্রকাশ্যে সন্ত্রাসীদের গুলিতে ‘শীষ সন্ত্রাসী’ তারিক সাইফ মামুন হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় মামলা হবে। তদন্ত করে খুনিদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনা হবে।
গত বুধ থেকে শুক্রবার পর্যন্ত বন্দর নগরী চট্টগ্রামে পর পর তিন দিন প্রকাশ্যে খুন ও অস্ত্রবাজি চলে। এতে চট্টগ্রাম-৮ আসনের এমপি প্রার্থী এরশাদ উল্লাহসহ কয়েকজন গুলিবদ্ধ হন। গুলিতে মারা যান মুহাম্মদ আলমগীর আলম নামের যুবদলকর্মী। তার আগের দিন ঢাকার বাইরে মুন্সীগঞ্জে আরিফ মীর নামের এক বিএনপি নেতাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এর এক সপ্তাহ আগে এ এলাকায় তুহিন দেওয়ান নামের এক তরুণকে গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। খুলনা মহানগরীর ২ নম্বর কাস্টম ঘাটে গত ৬ অক্টোবর রাতে ইমরান মুনশি নামে এক যুবককে মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে গুলি করে সন্ত্রাসীরা। এভাবে একের পর এক হত্যার ঘটনায় এরা জড়িত থাকলেও তাদের নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী। গতকাল রাজধানীর গুলশান এলাকায় সৌরভ হোসেন নামে ছাত্রদলের এক নেতাকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। মোহাম্মদপুরে বাসায় আরেক ছাত্রদল নেতা সাব্বির মোহাম্মদের লাশ তাঁর বাসা থেকে উদ্ধার করা হয়। এর মধ্যে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও খুলনায় একাধিক হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে শীর্ষ সন্ত্রাসীরা জড়িত থাকার তথ্য পেয়েছে পুলিশ।
অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর গাছাড়া ভাবের কারণে বর্তমানে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অপরাধীরা সুযোগ নিচ্ছে। শীর্ষ সন্ত্রাসীদের অনেকেই আড়ালে থেকে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করছেন। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীগুলোকে তাদের বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। না হলে খুনাখুনি বাড়বে।
পুলিশ এরই মধ্যে এসব শীর্ষ সন্ত্রাসী ও তাঁদের সহযোগীদের গ্রেপ্তার অভিযান শুরু করেছে। গতকাল চট্টগ্রামের রাউজানের তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী ইকবাল হোসেন চৌধুরী ওরফে মেজর ইকবালকে গ্রেপ্তারের তথ্য দিয়েছে। তিনি খুন, ডাকাতি, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন মামলার ওয়ারেন্টভুক্ত আসামি বলে জানিয়েছেন রাউজান থানার ওসি মনিরুল ইসলাম ভুঁইয়া।
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে রাজনৈতিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিরোধের জের ধরে সম্প্রতি দেশে চরম অস্থিরতা শুরু হয়েছে। হঠাৎ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বেড়ে যাওয়ায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর ঊর্ধ্বতনরা জরুরি বৈঠক করছেন। গতকাল সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে আইন-শঙ্খলাসংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক শেষে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, সন্ত্রাসীদের কোনো ধরনের ছাড় দেওয়া হবে না।
নিহত মামুনের পরিবারের অভিযোগ : মামুন হত্যাকাণ্ডের পর প্রশাসন নড়েচড়ে বসেছে। এদিকে মামুনের পরিবারের সদস্যদের পাশাপাশি তাঁর খালাতো ভাই হাফিজ বলেন, ‘আমার ভাই একজন সাধারণ মানুষ। কারা তাঁকে হত্যা করেছে, কী কারণে করেছে আমার জানা নেই।’
নিহতের স্ত্রী বিলকিস আক্তার দীপা বলেন, ‘মামুনের মিরপুরে গার্মেন্টস ব্যবসা রয়েছে। ইমন ছাড়া কেউ এই কাজ করেনি। কয়েক দিন আগে ইমন লোক দিয়ে মামুনকে মারধর করেছিল। তবে কোন ইমন, সে বিষয়টি তিনি তাৎক্ষণিক বলতে রাজি হননি।’
মামুনের শরীরে পাঁচটি গুলির চিহ্ন : ঢামেক হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, নিহত তারিক সাইফ মামুনের সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করেন সূত্রাপুর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) সাইদুল হোসেন মিলন। প্রতিবেদনে তিনি বলেন, মোট পাঁচটি গুলিবিদ্ধ জখমের চিহ্ন পাওয়া যায় মামুনের শরীরে। মাথার নিচে একটি, বাঁ পিঠে একটি, বুকের ডান পাশে একটি, বাঁ হাতের কবজিতে একটি এবং ডান হাতের কবজির ওপরে একটি।
Sharing is caring!