প্রকাশনার ১৬ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

৭ই ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
২২শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
১৬ই জমাদিউস সানি, ১৪৪৭ হিজরি

জুলাই সনদ, গণভোট ও জাতীয় নির্বাচন: সংঘাত না সমঝোতা

editor
প্রকাশিত নভেম্বর ১২, ২০২৫, ১২:৪০ অপরাহ্ণ
জুলাই সনদ, গণভোট ও জাতীয় নির্বাচন: সংঘাত না সমঝোতা

Manual7 Ad Code

প্রজন্ম ডেস্ক:

 

রাজনৈতিক দলগুলো জুলাই সনদ বাস্তবায়নে গণভোটের দিনক্ষণ নিয়ে এখনো ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেনি। এ নিয়ে মুখোমুখি অবস্থানে প্রধান দুই দল বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী। নবগঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টিও (এনসিপি) অসন্তুষ্ট সরকার ও অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মকাণ্ডে। গণভোট নিয়ে বিএনপি-জামায়াতের অনড় অবস্থানের মধ্যেই চলছে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি। ক্রমেই এগিয়ে আসছে সরকার ঘোষিত নির্বাচনের সময়। ইসি আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তুতি শুরু করেছে। সংসদ নির্বাচনের বাকি রয়েছে তিন মাসেরও কম সময়। এ অবস্থায় গণভোট ইস্যুতে প্রধান দুই দলের অনড় অবস্থানে সংঘাতের আশঙ্কা করছে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল।

অবশ্য সরকারসংশ্লিষ্টরা গণভোট নিয়ে বিএনপি-জামায়াতের মতপার্থক্য দূর করতে চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। গত সপ্তাহে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল জুলাই সনদ বাস্তবায়ন ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলোর মতপার্থক্য প্রসঙ্গে বলেন, সরকার আলোচনার আয়োজন করবে না। রাজনৈতিক দলগুলো যদি এক সপ্তাহের মধ্যে ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্ত দিতে না পারে, তাহলে সরকার তার মতো করে সিদ্ধান্ত নেবে। তিনি ৩ নভেম্বর অনুষ্ঠিত উপদেষ্টা পরিষদের জরুরি বৈঠকে আলোচনার প্রসঙ্গ টেনে বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোকে নিজেদের উদ্যোগে আলোচনা করে দ্রুততম সময়ে অন্তর্বর্তী সরকারকে ঐক্যবদ্ধ দিকনির্দেশনা দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে।

Manual1 Ad Code

গণভোট ইস্যুতে সমঝোতার জন্য বিএনপি-জামায়াতকে দেওয়া এক সপ্তাহের সময় গতকাল রবিবার শেষ হয়েছে। কিন্তু দল দুটির মধ্যে কোনো সমঝোতা হয়নি। অন্তর্বর্তী সরকারও তাদের অবস্থান ধরে রাখতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াতের নেতাদের সঙ্গে আলোচনার জন্য বৈঠক করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এ বৈঠক যেকোনো দিন অনুষ্ঠিত হতে পারে।

 

জানা গেছে, এ বৈঠকে জুলাই সনদ বাস্তবায়নে গণভোটের দিনক্ষণ চূড়ান্ত করার চেষ্টা থাকবে। সেখানে জুলাই সনদের অন্য অমীমাংসিত বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করে একটা সমঝোতায় পৌঁছানোর লক্ষ্য রয়েছে। বিশেষ করে বিএনপির ‘নোট অব ডিসেন্ট’-এর প্রস্তাবগুলো নিয়ে সমঝোতার চেষ্টা থাকবে। এ ইস্যুতে অন্তর্বর্তী সরকারের ভূমিকায় অসন্তুষ্ট বিএনপি। দলটির নেতারা মনে করছেন, সরকার বিএনপিকে চাপে রাখার কৌশল নিয়েছে। এ অবস্থায় সরকার-বিএনপি এবং বিএনপি-জামায়াতে ইসলামীর মধ্যে সমঝোতা না হলে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান আয়োজন অনিশ্চিত হয়ে পড়ার ঝুঁকিসহ সংঘাতের আশঙ্কা করছেন রাজনীতিকরা।

 

Manual5 Ad Code

এদিকে সময় যতই যাচ্ছে, জুলাই সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে আগে থেকে বিপরীত অবস্থানে থাকা বিএনপি ও জামায়াত আরও মুখোমুখি এসে দাঁড়াচ্ছে। গত শনিবার ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী জামায়াতসহ আট দলের রাস্তার কর্মসূচির প্রতি ইঙ্গিত করে বক্তব্য দেন। তিনি বিএনপির কঠোর অবস্থানের ইঙ্গিত দিয়ে বলেন, ‘কথায় কথায় আপনি রাস্তায় যাবেন। এখন অন্য দল যদি তার প্রতিবাদে আবার রাস্তায় যায়, তাহলে কী হবে; সংঘর্ষ হবে না?’

Manual8 Ad Code

এর আগে গত বৃহস্পতিবার ঢাকায় এক কর্মসূচিতে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, ‘সোজা আঙুলে যদি ঘি না ওঠে, আঙুল বাঁকা করব।’

জামায়াতের দাবি, নভেম্বরের মধ্যে গণভোটের আয়োজন করতে হবে। বিএনপি আগামী ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আরেকটি বিশাল ব্যয় পরিহার করতে চায়। তারা সংসদ নির্বাচনের দিন গণভোট আয়োজনের জন্য সরকারকে পরামর্শ দিয়েছে। জুলাই সনদের একাধিক প্রস্তাবে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দেওয়া সত্ত্বেও তা আমলে নেওয়া হয়নি- বারবার এমন অভিযোগ করে আসছে বিএনপি। এ বিষয়টিতে তীব্র আপত্তি রয়েছে দলটির। এমনকি এ জন্য প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার পক্ষপাতদুষ্ট বলে অভিযোগ করে বিএনপির প্রায় সব নেতা সভা-সমাবেশে বক্তব্য দিয়ে আসছেন। ফলে সরকার-বিএনপি এবং বিএনপি-জামায়াতের মধ্যে মতপার্থক্য দিন দিন তীব্র হচ্ছে। এরই মধ্যে দাবি আদায়ে অনড় জামায়াতসহ আট দল আগামীকাল মঙ্গলবার ঢাকায় সমাবেশের ডাক দিয়েছে।

 

এদিকে আওয়ামী লীগ সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রনেতাদের রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতাদেরও সরকারের প্রতি অসন্তোষ রয়েছে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন ইস্যুতে। কিছু ইস্যুতে জামায়াতের সঙ্গে তাদের মতপার্থক্য স্পষ্ট হয়েছে। রয়েছে বিএনপির সঙ্গেও দূরত্ব।

এই পরিস্থিতিতে আগামী ১৩ নভেম্বর বৃহস্পতিবার ক্ষমতাচ্যুত ও কার্যক্রম নিষিদ্ধ হওয়া আওয়ামী লীগ ‘ঢাকা লকডাউন’ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। এই কর্মসূচি পালনের জন্য দলটির নেতারা প্রবাস থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও অনলাইনে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন। প্রবাস থেকে নির্দেশ পেয়ে কার্যক্রম চালাতে গিয়ে দলটির নেতা-কর্মীরা প্রায়ই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হচ্ছেন। বর্তমানে আওয়ামী লীগের এই তৎপরতা নিয়ে সতর্ক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ও পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আওয়ামী লীগের তৎপরতা নিয়ে জনগণকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করছেন। তারা বলছেন, ওই দিন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক থাকবে।

 

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য বেগম সেলিমা রহমান বলেন, ‘আমরা শুনেছি তারা (আওয়ামী লীগ) ১৩ নভেম্বর একটা কর্মসূচি দিয়েছে। তবে তারা কিছু করতে পারবে বলে আমরা মনে করছি না। এক বছর ধরে তারা নানা ষড়যন্ত্র করে অনেক কিছু করার চেষ্টা করেছে। আগেও পারেনি, এবারও জনগণের প্রতিরোধের মুখে টিকতে পারবে না।’

 

তিনি বলেন, ‘আশা করি, জুলাই সনদ নিয়ে আলোচনার টেবিলেই সবকিছুর সমাধান হয়ে যাবে। গণভোট ও জুলাই সনদের ব্যাপারে বিএনপির অবস্থান জাতির সামনে তুলে ধরেছি। প্রয়োজনে আমরা রাজনৈতিক কর্মসূচির ঘোষণা দেব, তবুও সংঘাতের রাজনীতিতে যাবে না বিএনপি। সংঘাতের রাজনীতি আমরা আর করব না।’

 

জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, ‘আগামী দিনে রাজনীতিতে সংঘাতের কোনো কারণ আমরা দেখছি না। ভিন্নমত থাকা গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। ভিন্নমত থাকলেও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ থাকতে হবে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের পতনের পর দেশের বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে হয়েছে, সেখানে কোনো ধরনের সহিংসতা হয়নি।’

 

তিনি বলেন, ‘কেউ যদি আওয়ামী ফ্যাসিস্টের দোসর হিসেবে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে চায়, তাহলে জনগণ তাদের রুখে দেবে। আমরা কোনো ধরনের সংঘাতের রাজনীতি চাই না। আমরা সর্বোচ্চ ধৈর্য ধারণ করে নিয়মতান্ত্রিকভাবে কর্মসূচি পালন করে যাব।’

 

বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) উপদেষ্টা খালেকুজ্জামান বলেছেন, নির্বাচনের কথা বলছে সরকার। কিন্তু আদতে নির্বাচন হবে কি না, তা নিয়ে মানুষের মনে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। অনেকে মনে করেন, নির্বাচন যদি হয় তবে সেটা হবে একটা দুর্ঘটনা। নাগরিকদের অনেকে বলছেন, এই অনির্বাচিত সরকারে যারা আছেন, তারা দীর্ঘ মেয়াদে থাকার মনোবাসনা পোষণ করছেন।

 

তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারে যারা আছেন, তাদের কারও রাষ্ট্র পরিচালনার অভিজ্ঞতা নেই। তাদের কাজে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। তাদের যে নানা উদ্দেশ্য, সেসবে গলদ রয়েছে। তারা এখন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলকে কাছে টানছে; আবার কিছু দলকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে। এই প্রক্রিয়া রাজনৈতিক অস্থিরতা, অরাজকতা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। সরকারের ব্যর্থতা ও দুর্বলতার কারণে পরাজিত শক্তির উত্থানের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে বলে তিনি মনে করেন।

 

জাতীয় নাগরিক পার্টির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন বলেন, “দেশটা সংঘাতের দিকে যাচ্ছে। কারণ নির্বাচনের ডামাডোলের মধ্যে দেশটাকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। পরিস্থিতি সংঘাতের দিকে যাচ্ছে, কারণ সংস্কার কার্যক্রম সম্পন্ন হয়নি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ঠিক করা হয়নি। বিভিন্ন জায়গায় ‘নমিনেশন’ পাওয়ার পর থেকে সংঘাত হচ্ছে, একধরনের অলিখিত হরতাল পরিস্থিতি আমরা দেখতে পাচ্ছি। যদি সংস্কার শেষ হতো কিংবা শেষ হওয়ার আগের পরিস্থিতি হতো এমন রূপ আমাদের দেখতে হতো না। সংবাদ কখন হয়? যখন রাজনৈতিক ‘কনফ্লিক্ট’ থাকে। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বড় দলগুলোর ভেতরে আমরা ‘কনফ্লিক্ট’ দেখতে পাচ্ছি। কারণ রাজনৈতিক দলগুলো এখন সংস্কারকে প্রাধান্য দিচ্ছে না।”

Manual2 Ad Code

Sharing is caring!

Manual1 Ad Code
Manual5 Ad Code