প্রজন্ম ডেস্ক:
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে নির্বাচন কমিশন (ইসি) দল ও প্রার্থীর জন্য জারি করেছে নতুন ‘নির্বাচনি আচরণবিধি-২০২৫’। এবারের বিধিমালায় পোস্টার ব্যবহার নিষিদ্ধ, ড্রোন উড্ডয়ন বন্ধ, সোশ্যাল মিডিয়ায় কড়াকড়ি, এক মঞ্চে ইশতেহার ঘোষণা- সব মিলিয়ে এক ডজনেরও বেশি নতুন ধারা সংযোজন করা হয়েছে। দেশের নির্বাচনব্যবস্থায় স্বচ্ছতা আনার লক্ষ্যে এসব বিধান যুক্ত হলেও প্রার্থীদের জন্য তা নতুন বাস্তবতা ও চ্যালেঞ্জ। বিশ্লেষকরা বলছেন, এবার নির্বাচনি প্রচারে অনেক নতুনত্ব আনা হলেও তা আর আগের মতো সহজ ও জৌলুসপূর্ণ হবে না। বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ইসির নতুন আচরণবিধি নির্বাচনের চরিত্রই পাল্টে দিচ্ছে। পোস্টারবিহীন, প্রযুক্তি নিয়ন্ত্রিত, নিয়মানুবর্তী এই নির্বাচনে জিততে হলে শুধু জনসমর্থন নয়, নিবিড় ও কৌশলগত প্রচারই হবে সাফল্যের চাবিকাঠি।
পোস্টার নিষিদ্ধ, বিলবোর্ড সীমিত
নির্বাচনি প্রচারে প্রথমবারের মতো পোস্টার ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করেছে নির্বাচন কমিশন। একজন প্রার্থী তার নির্বাচনি এলাকায় সর্বোচ্চ ২০টি বিলবোর্ড ব্যবহার করতে পারবেন, যার দৈর্ঘ্য ১৬ ফুট ও প্রস্থ ৯ ফুটের বেশি নয়। এই সিদ্ধান্তে প্রচারের ঐতিহ্যবাহী রঙিন চিত্র, দেয়ালজুড়ে পোস্টার লাগানো কিংবা লিফলেট বিতরণের উৎসবমুখর পরিবেশ হারিয়ে যাবে বলে মনে করছেন অনেকেই। তবে ইসি বলছে, এতে পরিবেশ রক্ষা ও প্রচারের আর্থিক বৈষম্য কমবে। প্রত্যেক দল ও প্রার্থীকে আচরণবিধি মানার বিষয়ে লিখিত অঙ্গীকারনামা দাখিল বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। আচরণবিধিতে বলা হয়েছে, অন্তর্বর্তী/তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যরাও প্রচারে অংশ নিতে পারবেন না।
ড্রোন ও শোডাউনে নিষেধাজ্ঞা
নির্বাচনের দিন বা প্রচারকালে ড্রোন, কোয়াডকপ্টার ও অনুরূপ যন্ত্র ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষেধ। এর পাশাপাশি শোডাউন, মিছিল ও মশাল মিছিল নিষিদ্ধ। ইসির যুক্তি, নিরাপত্তা ও জনস্বার্থের কারণে এই বিধান জরুরি। তবে প্রার্থীরা বলছেন, এতে তাদের নির্বাচনি প্রচারে ভিজ্যুয়াল প্রচারের বড় মাধ্যম হারিয়ে যাচ্ছে।
সোশ্যাল মিডিয়ায় কঠোর নিয়ন্ত্রণ
সবচেয়ে আলোচিত পরিবর্তন এসেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারে। প্রার্থী বা তার এজেন্টকে প্রচার শুরুর আগে ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটকসহ সব সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্টের নাম, আইডি ও ই-মেইল ঠিকানা রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে দাখিল করতেই হবে। তবে ঘৃণাত্মক ভাষা, বিকৃত চিত্র, মিথ্যা তথ্য, বিভ্রান্তিকর কনটেন্ট কিংবা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ব্যবহার করে প্রচার চালানোকে নির্বাচনি অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। ধর্মীয় বা জাতিগত অনুভূতি ব্যবহার করে ভোট চাওয়া যাবে না, আর সব কনটেন্ট প্রকাশের আগে সত্যতা যাচাই বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এই বিধান প্রার্থীদের ডিজিটাল প্রচার নিয়ন্ত্রণে আনবে, তবে সোশ্যাল মিডিয়ার বিশাল জগতে তা কতটা বাস্তবায়ন সম্ভব- সে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।
এক মঞ্চে ইশতেহার ঘোষণা
গণতান্ত্রিক চর্চা জোরদার করতে নতুন বিধিতে যুক্ত করা হয়েছে একটি আকর্ষণীয় ধারা- একই আসনের সব প্রার্থী নিয়ে এক মঞ্চে ইশতেহার ঘোষণা। ফলে কোনো দল বা প্রার্থী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আগের মতো দেশে-বিদেশে জনসভা, পথসভা, সভা-সমাবেশে প্রচার চালাতে পারবেন না। রিটার্নিং কর্মকর্তা নিজ উদ্যোগে এই আয়োজন করবেন। এতে ভোটাররা একই মঞ্চে সব প্রার্থীর বক্তব্য শুনতে পারবেন। এ ছাড়া সব প্রার্থীর জন্য একই দিনে গণমাধ্যমে সংলাপ ও প্রচারের সমান সুযোগ নিশ্চিত করার বিধান যুক্ত হয়েছে। তবে বিরোধপূর্ণ রাজনৈতিক সম্পর্কের কারণে বাস্তবে এটি কতটা কার্যকর হবে, তা নিয়েও সন্দেহ আছে।
ভোটার স্লিপেও কড়াকড়ি
নির্বাচনি আসনগুলোতে এবার ভোটার স্লিপে কোনো প্রার্থীর নাম, ছবি, প্রতীক বা পদের নাম উল্লেখ করা যাবে না। এতে ভোটারদের বিভ্রান্তি কমবে বলে ইসি মনে করছে। তবে এটি প্রচারের ক্ষেত্রে আরেক ধরনের সীমাবদ্ধতা হিসেবে দেখছেন প্রার্থীরা।
বিধি ভঙ্গে কঠোর শাস্তি ও প্রার্থিতা বাতিল
নতুন আচরণবিধিতে দল ও প্রার্থীদের জন্য শাস্তি আরও কঠোর করা হয়েছে। বিধি ভাঙলে প্রার্থীর সর্বোচ্চ ছয় মাসের কারাদণ্ড ও দেড় লাখ টাকা জরিমানা। রাজনৈতিক দলের ক্ষেত্রেও একই পরিমাণ অর্থদণ্ড নির্ধারণ করা হয়েছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন হলো ইসি এখন তদন্ত সাপেক্ষে সরাসরি প্রার্থিতা বাতিল করতে পারবে, যা আগে আচরণবিধিতে স্পষ্ট ছিল না।
আইটি-সাপোর্টেড পোস্টাল ভোটিং
প্রথমবারের মতো চালু হচ্ছে আইটি-সাপোর্টেড পোস্টাল ব্যালট ভোটিং। এর আওতায় দেশের নির্দিষ্ট শ্রেণির ভোটার ও প্রবাসী বাংলাদেশিরা ডাকযোগে ভোট দিতে পারবেন। এই ব্যবস্থাকে নির্বাচনি প্রযুক্তিতে একটি বড় অগ্রগতি হিসেবে দেখা হচ্ছে।
এআইয়ের অপব্যবহার রোধে নতুন ধারা
গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে (আরপিও) ৯১ ধারা যুক্ত করা হয়েছে, যাতে ইসিকে সরাসরি প্রার্থিতা বাতিলের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এতে এআইয়ের অপব্যবহার, গুজব ছড়ানো, ভুয়া-বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রচারকে নির্বাচনি অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। আর এ ধরনের অপরাধে জড়িত প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিলের ক্ষমতা থাকবে ইসির হাতেই। একটি নতুন ধারা নির্বাচনব্যবস্থায় শৃঙ্খলা আনতে গুরুত্বপূর্ণ হলেও প্রার্থীদের জন্য নতুন ধরনের আইনি ঝুঁকি তৈরি করছে।
পরিবেশবান্ধবসামগ্রী বাধ্যতামূলক
নির্বাচনের সময় পরিবেশ রক্ষায় প্রচারসামগ্রী হিসেবে পলিথিন, রেকসিন, পিভিসি ব্যানার বা প্লাস্টিকসামগ্রী ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। প্রচারে ওই সব সামগ্রীর পরিবর্তে পরিবেশবান্ধব উপকরণ ব্যবহারের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া শব্দের মাত্রা ৬০ ডেসিবেল নির্ধারণ করা হয়েছে। আলোকসজ্জা করা যাবে কেবল ডিজিটাল বিলবোর্ডে।
ইসি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এসব বিধান নির্বাচনকে অধিক স্বচ্ছ, ব্যয়সংকুচিত ও প্রযুক্তিনির্ভর করবে। তবে দল ও প্রার্থীদের মতে, এতে প্রচারের সুযোগ অনেক কমে যাবে, বিশেষত গ্রামীণ ভোটারদের কাছে পৌঁছাতে বাধা তৈরি হবে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এবার প্রার্থীদের জনসংযোগের ধরন পাল্টাতে হবে- ডিজিটাল কৌশল, মাঠপর্যায়ের সংগঠন ও সরাসরি ভোটার সংযোগই হবে মূল অস্ত্র। নির্বাচন হবে পোস্টারবিহীন, প্রযুক্তি নিয়ন্ত্রিত ও শৃঙ্খলাভিত্তিক। জিততে হলে শুধু জনপ্রিয়তা নয়, প্রার্থীদের নিবিড়, কৌশলগত ও নিয়ম মাফিক প্রচারে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে। নতুন আচরণবিধির ফাঁদে পড়ে নয়- বরং তা মেনে মাঠে জয়ী হওয়ার কৌশলও প্রার্থীদের রপ্ত করতে হবে।
সম্পাদক মন্ডলীর সভাপতিঃ মোহাম্মদ আফছার খান সাদেক
সম্পাদক ও প্রকাশকঃ মিলাদ মোঃ জয়নুল ইসলাম
প্রকাশনালয়ঃ রিপোর্টার লজ, কসবা, বিয়ানীবাজার, সিলেট ।
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ উত্তর বাজার কেন্দ্রিয় মসজিদ মার্কেট (২য় তলা), বিয়ানীবাজার, সিলেট ।
মোবাঃ ০১৮১৯-৬৫৬০৭৭, ০১৭৩৮-১১ ৬৫ ১২
ইমেইলঃ agamiprojonma@gmail.com, milad.jaynul@gmail.com