প্রজন্ম ডেস্ক:
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বৃহস্পতিবার (১৩ নভেম্বর) জাতির উদ্দেশে ভাষণে বলেছেন, একই দিনে জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট অনুষ্ঠিত হবে, যেখানে জনগণের ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ উত্তরই নির্ধারণ করবে বাংলাদেশের সংবিধান সংস্কারের ভবিষ্যৎ।
জুলাই জাতীয় সনদের সার্বিক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গত ১৭ অক্টোবর রাজনৈতিক দলগুলো সনদে স্বাক্ষর করে। স্বাক্ষরিত খসড়া ২৮ অক্টোবরের সুপারিশ আকারে প্রধান উপদেষ্টার কাছে জমা দেওয়া হয়। গতকাল ১৩ নভেম্বর প্রধান উপদেষ্টা সনদ বাস্তবায়নে গণভোটের ঘোষণা দেন। এতে বলা হয়, জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ ২০২৫ সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
রাজনৈতিক দলগুলোর স্বাক্ষর অনুষ্ঠান থেকে গণভোটের সিদ্ধান্ত পর্যন্ত তিন ধাপে জুলাই জাতীয় সনদের রূপান্তর ঘটেছে। প্রথম ধাপে দলীয় স্বাক্ষর, দ্বিতীয় ধাপে বাস্তবায়নের প্রস্তাব, আর তৃতীয় ধাপে সরকারের সিদ্ধান্ত- প্রতিটি স্তরে বদলেছে সনদের কাঠামো ও ভাষা। শুরুতে ছিল ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাব; ২৫ দলের স্বাক্ষরের পর তা নেমে এসেছে ৩০টি ঐকমত্যভিত্তিক ধাপে, যেখানে চার বিষয়ে একক প্রশ্নে গণভোটের মাধ্যমে জনগণ ভাগ্য নির্ধারণ করবে। সংবিধানে অন্তর্ভুক্তির প্রক্রিয়া শুরু হওয়ায়, জুলাই সনদ এখন শুধু একটি দলিল নয়- এটি দেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের নকশা।
দলগুলোর সইয়ে জুলাই সনদ গৃহীত
৩০টি রাজনৈতিক দল ও জোটের আলোচনার মধ্য দিয়ে তৈরি হয় ‘জুলাই জাতীয় সনদ’- এক অভূতপূর্ব সংস্কার নকশা, যার উদ্দেশ্য ছিল রাষ্ট্রকাঠামো, সংবিধান, নির্বাচনব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, প্রশাসন ও দুর্নীতি দমনব্যবস্থার মৌলিক পরিবর্তন আনা।
ঐকমত্য কমিশনের কয়েক মাসব্যাপী সংলাপের মাধ্যমে তৈরি এই সনদে শুরুতে ছিল ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাব, যার মধ্যে ২৫টি দল ও জোট ২০২৫ সালের ১৭ অক্টোবর আনুষ্ঠানিকভাবে সই করে। দলগুলোর প্রতিশ্রুতি ছিল- তারা ক্ষমতায় এলেও বা বিরোধী অবস্থানে থাকলেও, এই সংস্কারগুলো বাস্তবায়নে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকবে। এখানেই সনদটি পায় ‘জাতীয় ঐকমত্য’ তকমা। তবে এই পর্যায়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল, সব দল সংস্কারের নীতি ও লক্ষ্য নিয়ে একমত হলেও বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে বিভক্ত ছিল। কেউ চাইছিল সংসদের মাধ্যমে, কেউ চাইছিল বিশেষ গণভোটের মাধ্যমে। এই মতভেদই পরবর্তী ধাপের ভিত্তি তৈরি করে। প্রথম দফায় রাজনৈতিক দলগুলোর ‘নোট অব ডিসেন্ট’ যোগ করা ছিল।
প্রধান উপদেষ্টার কাছে দেওয়া ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশ নিয়ে বিতর্ক
প্রায় ৮ মাসের নিবিড় আলোচনার পর ২৮ অক্টোবর জাতীয় ঐকমত্য কমিশন তাদের চূড়ান্ত বাস্তবায়ন সুপারিশ প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের হাতে জমা দেয়। কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজের নেতৃত্বে জমাকৃত এই সুপারিশ ছিল দুটি বিকল্পে বিভক্ত।
প্রথম বিকল্পে বলা হয়- সংবিধান সংশোধন-সংক্রান্ত সংস্কারগুলো বাস্তবায়নে সরকার একটি বিশেষ আদেশ জারি করবে, যার ভিত্তিতে গণভোট অনুষ্ঠিত হবে। গণভোটে প্রস্তাব পাস হলে পরবর্তী সংসদ ২৭০ দিনের মধ্যে সংবিধান সংস্কার করবে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সংসদ তা করতে ব্যর্থ হলে, সংস্কার প্রস্তাবগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হবে।
দ্বিতীয় বিকল্পে প্রক্রিয়াটি ছিল প্রায় একই। তবে ব্যর্থতার ক্ষেত্রে কী হবে, তা উল্লেখ ছিল না। কিন্তু এই ধাপের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা ছিল, রাজনৈতিক দলগুলোর ‘নোট অব ডিসেন্ট (ভিন্নমত নথি)’ চূড়ান্ত প্রতিবেদনে অন্তর্ভুক্ত না করা। ঐকমত্য কমিশন শেষ মুহূর্তে এ সিদ্ধান্ত নেয়, আনুষ্ঠানিক প্রতিবেদন থেকে সব নোট অব ডিসেন্ট বাদ থাকবে, যাতে সনদটি ‘ঐক্যবদ্ধ দলিল’ হিসেবে উপস্থাপিত হয়। তবে এই সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক বিতর্কের জন্ম দেয়। কারণ কমিশনের আলোচনাপর্বে অন্তত ৯টি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে দলগুলো ভিন্নমত নথিভুক্ত করেছিল-
১. রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পদ্ধতি ও ক্ষমতা: রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রক্রিয়া ও ক্ষমতার সীমা নির্ধারণে বিভক্তি।
২. প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ ও একাধিক পদে থাকা: ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ বনাম মেয়াদ সীমার প্রশ্নে মতভেদ।
৩. দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ গঠন: উচ্চকক্ষ প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি।
৪. সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব: নির্বাচনি ব্যবস্থায় আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতি চালু করা নিয়ে দ্বিধা।
৫. সংবিধান সংশোধনে উচ্চকক্ষের ভূমিকা: অনুমোদন প্রক্রিয়ায় উচ্চকক্ষের ক্ষমতা কতটা হবে, তা নিয়ে বিতর্ক।
৬. নারী প্রার্থী কোটা বৃদ্ধি: বাধ্যতামূলক কোটা বনাম স্বেচ্ছাপ্রণোদিত অংশগ্রহণের প্রশ্নে মতভেদ।
৭. ন্যায়পাল নিয়োগ প্রক্রিয়া: বাছাই ও অনুমোদনের ধরন নিয়ে পার্থক্য।
৮. মহা হিসাব-নিরীক্ষকের ক্ষমতা: বিধি প্রণয়নে স্বাধীনতা ও সংসদীয় নিয়ন্ত্রণের ভারসাম্য নিয়ে মতভেদ।
৯. দুর্নীতি দমন কমিশনের ক্ষমতা: স্বাধীনতা বনাম প্রশাসনিক জবাবদিহির সীমা নিয়ে বিতর্ক।
এই ৯টি বিষয়ে দলগুলোর অবস্থান নথিবদ্ধ হলেও, কমিশনের চূড়ান্ত প্রতিবেদনে সেগুলো প্রকাশ না করার সিদ্ধান্তে রাজনৈতিক স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। বিভিন্ন দল পরে মন্তব্য করে যে, ‘ঐকমত্যের নামে ভিন্নমতের কণ্ঠ রুদ্ধ করা হয়েছে।’ এর ফলে সংস্কার বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া, সময়সীমা ও কর্তৃত্ব নিয়ে মতপার্থক্য আরও প্রকট হয়।
অন্তর্বর্তী সরকার দলগুলোকে আহ্বান জানায়, নিজেদের মধ্যে আলোচনায় বসে একটি ঐক্যবদ্ধ দিকনির্দেশনা দিতে। কিন্তু তারা তা করতে ব্যর্থ হয়। এই অচলাবস্থার প্রেক্ষাপটে সরকার নিজেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের দিকে অগ্রসর হয়, যা ১৩ নভেম্বর প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে বাস্তবে রূপ পায়।
নির্বাচন ও গণভোট একই দিনে: প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণা
জুলাই সনদে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন আসে গতকাল ১৩ নভেম্বর। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতির উদ্দেশে ভাষণে ঘোষণা করেন, ‘জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোট একই দিনে অনুষ্ঠিত হবে।’ তিনি জানান, জুলাই সনদের ৩০টি ঐকমত্যভিত্তিক সংস্কার প্রস্তাবের মধ্যে শুধু ৪টি মূল বিষয়কে কেন্দ্র করে একক প্রশ্নে ‘হ্যাঁ’-‘না’ ভোটের মাধ্যমে জনগণের মত (গণভোট) নেওয়া হবে। সরকারের এই সিদ্ধান্তে জুলাই জাতীয় সনদ এক নতুন রূপ পায়। একদিকে হয় এটি সংবিধান সংস্কারের রাজনৈতিক ভিত্তি, অন্যদিকে এটি রূপান্তরিত হয় জাতীয় গণভোটের প্রশ্নপত্রে। প্রধান উপদেষ্টা তার ভাষণে আরও পরিষ্কার করেন, কীভাবে আইন পরিষদের উচ্চকক্ষ নির্ধারণ করা হবে। সেখানে বলা হয়, জাতীয়ভাবে প্রাপ্ত ভোটের ভিত্তিতে আইনসভার উচ্চকক্ষ গঠন করা হবে।
প্রধান উপদেষ্টা তার ভাষণে সংবিধানে জুলাই সনদ অন্তর্ভুক্তির ঘোষণা দিয়ে জানান, জুলাই সনদ বাস্তবায়নের অঙ্গীকারনামা অনুসারে সংবিধানে ‘জুলাই জাতীয় সনদ’ অন্তর্ভুক্ত করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এর মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকার ‘জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫’ অনুমোদন করে, যা গেজেট প্রকাশের অপেক্ষায়। পরে গতকালই গেজেট প্রকাশ করা হয়।
৩০টি সংস্কারে সম্মতি, ৪টি বিতর্কিত ইস্যু
প্রধান উপদেষ্টার ভাষণ অনুযায়ী, ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় ৩০টি সংবিধান-সম্পর্কিত প্রস্তাবে দলগুলো ঐকমত্যে পৌঁছেছে। বাকি প্রস্তাবগুলোর মধ্যে কিছুতে সামান্য ভিন্নমত, আর কিছুতে বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে আছে বিতর্ক। মূলত যে ৪টি বিষয়ের ওপর গণভোটে সিদ্ধান্ত হবে, তা হলো- ১. সংসদীয় না মিশ্র শাসনব্যবস্থা, ২. প্রধান নির্বাচন কমিশনের গঠন পদ্ধতি, ৩. প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের কাঠামো এবং ৪. বিচার বিভাগের নিয়োগ ও জবাবদিহির ধরন। এসব বিষয়ই এখন জুলাই সনদের ‘একক প্রশ্নে হ্যাঁ-না ভোট’-এর ভিত্তি।
জুলাই সনদের রাজনৈতিক তাৎপর্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, এর তিন ধাপ (দলীয় সই, কমিশনের সুপারিশ, সরকারের ঘোষণায় বাস্তবায়ন) দেশের রাজনৈতিক বিবর্তনের এক নতুন পথচিহ্ন। এতে একদিকে যেমন দলীয় রাজনীতির বহুমাত্রিক মতভেদ কমেছে, অন্যদিকে অন্তর্বর্তী সরকারের সক্রিয় ভূমিকা গণতন্ত্র পুনর্গঠনের মডেল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
সম্পাদক মন্ডলীর সভাপতিঃ মোহাম্মদ আফছার খান সাদেক
সম্পাদক ও প্রকাশকঃ মিলাদ মোঃ জয়নুল ইসলাম
প্রকাশনালয়ঃ রিপোর্টার লজ, কসবা, বিয়ানীবাজার, সিলেট ।
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ উত্তর বাজার কেন্দ্রিয় মসজিদ মার্কেট (২য় তলা), বিয়ানীবাজার, সিলেট ।
মোবাঃ ০১৮১৯-৬৫৬০৭৭, ০১৭৩৮-১১ ৬৫ ১২
ইমেইলঃ agamiprojonma@gmail.com, milad.jaynul@gmail.com