প্রজন্ম ডেস্ক:
ইন্ডিয়ান প্লেট, ইউরেশিয়ান প্লেট এবং বার্মা প্লেটের সংযোগস্থলে হওয়ায় টেকটোনিকভাবে জটিল অঞ্চলে অবস্থান করছে বাংলাদেশ। নরসিংদীতে একাধিক ভূমিকম্পের পর যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব নর্থ ক্যারোলাইনা অ্যাট শার্লটের গবেষকরা বাংলাদেশের ভূমিকম্পের আশঙ্কা নিয়ে নতুন তথ্য দিয়েছেন। তারা বলেছেন, মাটির নিচে জমাট শক্তির বিস্ফোরণের মারাত্মক ঝুঁকিতে রয়েছে দেশ।
পরিসংখ্যানভিত্তিক পয়সন রিগ্রেশন মডেল ব্যবহার করে তারা বলছেন, আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে বড় ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বাংলাদেশে। রিখটার স্কেলে ৬ বা তার বেশি মাত্রার ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কা প্রায় ৩৫ দশমিক ৮ শতাংশ। রিখটার স্কেলে ৭ বা তার বেশি মাত্রার ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কা প্রায় ৪৩ দশমিক ১ শতাংশ।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক সরোয়ার জাহান এবং ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মমিনুল ইসলাম এই গবেষণা প্রতিবেদনের সঙ্গে একমত। তারা দুজনেই বলেছেন, বাংলাদেশের বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে ‘ডাউকি ফল্টে’ যে শক্তি জমেছে তা যেকোনো সময় নির্গত হতে পারে। এই ঘটনা মাঝারি থেকে বড় মাত্রার ভূমিকম্পের কারণ হতে পারে।
যা বলছেন যুক্তরাষ্ট্রের গবেষকরা
নরসিংদীর পলাশে গত বৃহস্পতিবার ৩ দশমিক ৩ মাত্রার ভূমিকম্পের পর ইউনিভার্সিটি অব নর্থ ক্যারোলাইনা অ্যাট শার্লটের প্রকৌশল প্রযুক্তি ও নির্মাণ ব্যবস্থাপনা বিভাগের গবেষক এম এম রেজওয়ান সম্প্রতি ‘বাংলাদেশের ভূকম্পন ঝুঁকি মূল্যায়ন: ২০২৫-এর নরসিংদী ভূমিকম্পের পরিপ্রেক্ষিতে পরিসংখ্যানগত বিশ্লেষণ এবং মেশিন লার্নিং’ শিরোনামে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেন।
রেজওয়ান এবং তার দল ১৮৯৭ সালের শিলংয়ে ৮ দশমিক ১ মাত্রার ভূমিকম্প, ২০১১ সালে সিকিমে ৬ দশমিক ৯ মাত্রার সিকিম ভূমিকম্প, ২০১৬ সালে ভারতের মণিপুর রাজ্যের ইম্ফলে ৬ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্পের নানা তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করেছেন। তারা বলেছেন, এই অঞ্চলে বড় মাত্রার ভূমিকম্প হওয়ার প্রচণ্ড ঝুঁকি রয়েছে।
গবেষণায় বাংলাদেশের জন্য ভূমিকম্পের একটি বিশেষ মান (বি-ভ্যালু) নির্ণয় করা হয়েছে শূন্য দশমিক ৪১, যা খুব কম। বি-ভ্যালু মান ১-এর নিচে হলে বুঝতে হবে মাটির নিচে চাপ বাড়ছে। এই মান যত কম হবে, বড় ধরনের ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কা তত বেশি হবে। গবেষণায় দেখা গেছে, ২০০৭ সালে বাংলাদেশে বি-ভ্যালু ছিল শূন্য দশমিক ৮৬, যা ২০২৪ সালে কমে দাঁড়িয়েছে শূন্য দশমিক ৫৪। এর মানে হলো, বাংলাদেশের টেকটোনিক প্লেটগুলোতে চাপ ক্রমাগত বাড়ছে, যা নির্দেশ করে, মাটির নিচে শক্তি জমছে।
এম এম রেজওয়ান ও তার গবেষণা সঙ্গীরা বাংলাদেশকে তিনটি প্রধান ভূমিকম্প ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলে ভাগ করেছেন। তাদের প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ইন্ডিয়ান প্লেট প্রতিবছর প্রায় ৫৫ মিলিমিটার গতিতে উত্তর দিকে সরে যাচ্ছে। ইন্ডিয়ান প্লেট যখন উত্তরে ধাক্কা দেয় তখন এই পুরো অঞ্চলটি (বিকৃতি অঞ্চল) ভীষণভাবে বেঁকে যায়, ভেঙে যায় এবং সংকুচিত হয়। এই প্রচণ্ড ধাক্কা এবং চাপের ফলে মাটির নিচে অসংখ্য ফাটল বা ফল্ট লাইন তৈরি হয়। এই ফাটল বা ভূকম্পন উৎপাদক কাঠামোগুলোতেই শক্তি জমা হতে থাকে এবং একসময় হঠাৎ করে বিশাল ভূমিকম্প তৈরি করে।
এই প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, ইন্ডিয়ান প্লেট তির্যকভাবে বার্মা প্লেটের নিচে চলে যাচ্ছে। এর ফলে রিখটার স্কেলে ৮ মাত্রার বড় ভূমিকম্প হতে পারে।
আসামের শিলং মালভূমির দক্ষিণ দিকে মাটির নিচে রয়েছে বিশাল ফাটল– ‘ডাউকি ফল্ট’। এই থ্রাস্ট ফল্ট অবরুদ্ধ হয়ে রয়েছে। এর অর্থ হলো– ফাটলটি নড়াচড়া না করে জমে আছে। দুটি প্লেট একে অন্যের ওপর ক্রমাগত চাপ দিচ্ছে, কিন্তু ফাটলটি আটকে থাকার কারণে সেই চাপ মুক্তি পাচ্ছে না। চাপ জমতে জমতে যখন হঠাৎ করে মুক্ত হবে তখন বিশাল ভূমিকম্প হবে। ঢাকা ও টাঙ্গাইল অঞ্চলের নিচে রয়েছে মধুপুর ফল্ট। এই আন্তপ্লেট কাঠামো মাঝারি আকারের ভূমিকম্প তৈরি করতে পারে।
২৩ নভেম্বর মায়ানমার উপকূলে ৫ দশমিক ৩ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানে। সেই ভূমিকম্পটি সাগাইং ফল্ট বরাবর ঘটেছে। এই ফল্টটি ভারত ও ইউরেশিয়া প্লেটের মধ্যে অবস্থিত একটি বড় স্ট্রাইক-স্লিপ ফল্ট, যা মায়ানমারের মান্দালয় থেকে শুরু হয়ে আন্দামান সাগর পর্যন্ত বিস্তৃত।
এই ভূমিকম্পের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মমিনুল ইসলাম বলেন, ‘মায়ানমারের সাগাইং ফল্টে ভূমিকম্পের কেন্দ্র ছিল মাটির ১০ কিলোমিটার অভ্যন্তরে। তবে এই ভূমিকম্প সাগাইং ফল্টের সরাসরি প্লেটে হয়নি, হয়েছে সাব-ফল্টে। আমরা দেখছি, এই সাগাইং ফল্টে শক্তি নির্গত হচ্ছে পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে। অর্থাৎ ভারতের মিজোরাম, মণিপুর, আসাম হয়ে এই শক্তি ক্রমাগত আমাদের সিলেট অঞ্চলের দিকে আসছে। এককথায়, ডাউকি ফল্টের দিকে এগোচ্ছে। এই ডাউকি ফল্টেও কিন্তু অনেক দিন কোনো বড় মাত্রার ভূমিকম্প হয়নি। সর্বশেষ ১৯১৮ সালে শ্রীমঙ্গলে ৭ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছিল। সুতরাং, এই অঞ্চলে মাটির নিচে ক্রমাগত শক্তি জমা হচ্ছে। এই শক্তি নির্গত হবেই। তবে সেটা কবে হবে, কেউ বলতে পারবে না।’
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক সরোয়ার জাহান বলেন, ‘বাংলাদেশের চট্টগ্রাম-সিলেট খুবই ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চল। সম্প্রতি যে কয়েকটি আফটার শক হয়েছে, সবগুলোর উৎপত্তিস্থল ওই এলাকায়। এই জায়গাগুলোতে দীর্ঘদিন শক্তি জমে থাকার ফলে এখন ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। ওই সব এলাকায় ঘন ঘন আফটার শক হচ্ছে। এই তথ্যের পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, সামনে বড় মাত্রার ভূমিকম্পের ঝুঁকি রয়েছে।’
ভূতাত্ত্বিক গঠন, ভূমির শ্রেণিবিন্যাস বুঝে বানাতে হবে ভবন
গতকাল শুক্রবার সকালে ‘ভূমিকম্প, অগ্নিকাণ্ডে বিপর্যস্ত বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর ঢাকার পরিকল্পনাগত সংকট ও করণীয়’ শীর্ষক ভার্চুয়াল আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি)।
অনুষ্ঠানের মূল প্রবন্ধে আইপিডির পরিচালক এবং জাহাঙ্গীনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ‘ভবন নির্মাণ ও আবাসন প্রকল্পগুলোতে বিল্ডিং কোড ও বিধিমালার কার্যকর প্রয়োগের অভাব রয়েছে। জলাশয়, জলাভূমি, প্লাবনভূমির ওপর ভরাট করা দুর্বল মাটিতে নির্বিচারে অনিরাপদ বহুতল ভবন গড়ে উঠেছে। মনে রাখতে হবে, ভূমিকম্প প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়, তবে ক্ষয়ক্ষতি কমানো সম্ভব। এ জন্য জরুরি কঠোরভাবে ভবন নির্মাণে বিল্ডিং কোড ও নির্মাণ বিধিমালা অনুসরণ করতে হবে।’
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের সহযোগী ড. ফরহাদুর রেজা, আইপিডির উপদেষ্টা অধ্যাপক আকতার মাহমুদ, বিআইপির সহসভাপতি পরিকল্পনাবিদ সৈয়দ শাহরিয়ার আমিন, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ-এর শিক্ষক ও আইপিডির রিসার্চ ফেলো কে এম আসিফ ইকবাল আকাশ, একিউমেন ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ তাহের, শেলটেক কনসালট্যান্টের পুর প্রকৌশলী তোফায়েল আহমেদ সজীব এই আলোচনায় যুক্ত ছিলেন।
তারা বলেন, মাটির ভূতাত্ত্বিক গঠন, ভূমির শ্রেণিবিন্যাস ও শহরের ভার বহনক্ষমতা বিবেচনায় নিয়ে শহরের বিশদ পরিকল্পনা করতে হবে। বিএনবিসি কার্যকর করতে বাংলাদেশ বিল্ডিং রেগুলেটরি অথরিটি (বিবিআরএ) অতি দ্রুত গঠন করতে হবে।
বিবিআরএ গঠন করে দ্রুত বিল্ডিং কোড বাস্তবায়নের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। সিসমিক মাইক্রো জোনেশন ম্যাপ অনুযায়ী নগরায়ণ করতে হবে। জলাধার, জলাভূমি ভরাট করে কোনো সরকারি-বেসরকারি উন্নয়নই অনুমোদন করা যাবে না। ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো চিহ্নিত করতে হবে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক সরোয়ার জাহানও একই কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নগরায়ণ বা কোনো স্থাপনাই ভূমিকম্পের কথা মাথায় রেখে করা হয় না। অধিকাংশ স্থাপনা করা হয় পুকুর বা খাল ভরাট করে। ফলে এই ভবনগুলোর স্থায়ীত্বকাল এমনিতেই কম থাকে। বাংলাদেশে মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পেও এই ভবন ধসে এক অকল্পনীয় পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।’
সম্পাদক মন্ডলীর সভাপতিঃ মোহাম্মদ আফছার খান সাদেক
সম্পাদক ও প্রকাশকঃ মিলাদ মোঃ জয়নুল ইসলাম
প্রকাশনালয়ঃ রিপোর্টার লজ, কসবা, বিয়ানীবাজার, সিলেট ।
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ উত্তর বাজার কেন্দ্রিয় মসজিদ মার্কেট (২য় তলা), বিয়ানীবাজার, সিলেট ।
মোবাঃ ০১৮১৯-৬৫৬০৭৭, ০১৭৩৮-১১ ৬৫ ১২
ইমেইলঃ agamiprojonma@gmail.com, milad.jaynul@gmail.com