প্রজন্ম ডেস্ক:
আদালতপাড়ায় একের পর এক হত্যাকাণ্ড জনমনে তৈরি করেছে আতঙ্ক ও নিরাপত্তাহীনতা। পুলিশ বলছে, গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়ানোর পাশাপাশি জনবল সংকট একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
তবে আদালত সংশ্লিষ্টদের মত, যে অবস্থাই হোক, আদালতের নিরাপত্তায় অবহেলা চলবে না। সার্বিক পরিস্থিতিতে অনলাইন হাজিরা গ্রহণযোগ্য করার ওপরও জোর দিচ্ছেন তারা।
মাত্র দুই মাসে দেশের তিনটি আদালত প্রাঙ্গণে ঘটে গেছে তিনটি হত্যাকাণ্ড। আর গত এক বছরে এমন ঘটনা কমপক্ষে চারটি।
ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা ও সুনামগঞ্জ সব জায়গাতেই দিনদুপুরে ঘটে এসব হত্যাকাণ্ড। এমনকি বিচারকের বাসায় ঢুকে পরিবারের সদস্যকে খুনের পর নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আলটিমেটাম দিতে বাধ্য হন বিচারকরা। আদালতের এজলাসে চলমান বিচারকাজেও ঘটেছে ছুরিকাঘাতে হত্যার ঘটনা।
নভেম্বরে দেশের দুটি আদালতে তিনজনকে খুনের পর আদালত-সংশ্লিষ্টরা নিরাপত্তা ব্যবস্থার ত্রুটি ও গোয়েন্দা নজরদারির ঘাটতি নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন।
জানা যায়, আদালতপাড়ায় এজলাস থেকে বারান্দা পর্যন্ত প্রায়ই ঘটে অপ্রীতিকর ঘটনা যার অনেকটিই গণমাধ্যমে প্রকাশ পায় না। পেশিশক্তির প্রভাব, ধাক্কাধাক্কি, হুমকি, এমনকি অপহরণের মতো ঘটনাও ঘটে থাকে নিয়মিত।
জজকোর্টের সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট মো. মনজুর আলম বলেন, ‘আদালতের নিরাপত্তার দায়িত্ব সম্পূর্ণভাবে পুলিশের। বিচারপ্রার্থীরা ন্যায়বিচারের আশায় এখানে আসেন। কিন্তু আদালতে এসে কেউ যদি হত্যা বা লাঞ্ছনার শিকার হন, তা হলে বিচারব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থাই নষ্ট হবে।’ ডিজিটাল ব্যবস্থায় সাক্ষ্যগ্রহণ চালু হলে অনেক অপ্রীতিকর ঘটনা প্রতিরোধ করা সম্ভব বলেও তিনি মত দেন।
বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি ও নারায়ণগঞ্জ শ্রম আদালতের সিনিয়র জেলা জজ হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘আদালত একটি অত্যন্ত সংবেদনশীল জায়গা। এখানে নিরাপত্তা জোরদার করা জরুরি। শুধু পুলিশ দিয়ে সব জায়গায় নিরাপত্তা দেওয়া সম্ভব নয় এটিও সত্য। আদালতে বিচারপ্রার্থী যেমন আসেন, তেমনই আসেন আসামিও। অনেকেই তাদের প্রতি ক্ষুব্ধ থাকেন। পরিকল্পিত হামলা, প্রতিরোধ সবসময় সহজ নয়।’ সাম্প্রতিক ঘটনার পর আদালতপাড়ায় বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে বলেও তিনি জানান।
পুলিশ সদর দফতরের অতিরিক্ত আইজিপি (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) খন্দকার রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আদালতের মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থানে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেই চেষ্টা করি। তবে ব্যক্তিগত শত্রুতার কারণে হঠাৎ কিছু ঘটনা ঘটে যায়।’ তিনি জানান, আদালতে আসামি আনা-নেওয়া অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং, যেখানে বাড়তি নিরাপত্তা ও জনবল প্রয়োজন। কঠোর ব্যবস্থা নিলে অনেক সময় পুলিশ সমালোচিতও হয়। তবু বিশেষ আসামিদের ক্ষেত্রে গোয়েন্দা নজরদারি ও বাড়তি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয় বলেও জানান তিনি।
খুলনায় জোড়া খুন : সবশেষ গতকাল খুলনা নগরীর একটি আদালতে হাজিরা দিতে আসা দুই ব্যক্তিকে দিনের বেলা প্রকাশ্যে গুলি করে ও কুপিয়ে হত্যা করেছে সন্ত্রাসীরা। নগরীর কেডি ঘোষ রোডের খুলনা মহানগর দায়রা জজ আদালতের প্রধান ফটকের সামনে এবং সার্কিট হাউসের প্রধান ফটকের ঠিক উল্টোদিকে এ হত্যাকাণ্ড ঘটে।
নিহতরা হলেন ফজলে রাব্বি রাজন (৩১) ও হাসিব হাওলাদার (৪৫)। রোববার দুপুরে এ হত্যাকাণ্ড ঘটে বলে নিশ্চিত করেন খুলনা সদর থানার ওসি শফিকুল ইসলাম। তিনি জানান, হত্যাকাণ্ডের শিকার দুজন একটি মামলায় আদালতে হাজিরা দিতে এসেছিলেন।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্র জানায়, রাজন রূপসা উপজেলার বাগমারা গ্রামের এজাজ শেখের ছেলে ও হাসিব নগরীর নতুন বাজার লঞ্চঘাট এলাকার আবদুল মান্নানের ছেলে। তারা দুজনই শীর্ষ সন্ত্রাসী ও মাদক কারবারি পলাশ গ্রুপের সক্রিয় সদস্য ছিল। তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র, মাদকসহ ছয়টি করে মামলা রয়েছে। দুজনেই অস্ত্র মামলায় হাজিরা দিতে আদালতে এসেছিল।
এদিকে প্রকাশ্যে জনাকীর্ণ আদালত এলাকায় জোড়া হত্যাকাণ্ডের পর চরম আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। মুহূর্তের মধ্যে রাস্তাঘাট ফাঁকা ও দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়। আদালতে আসা মানুষ ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, দুপুর সোয়া ১২টার দিকে রাজন ও হাসিব অস্ত্র মামলায় আদালতে হাজিরা দিয়ে মহানগর দায়রা জজ আদালতের প্রধান ফটকের সামনে নম্বরবিহীন একটি এফ জেড মডেলের মোটরসাইকেল রেখে চা পান করার জন্য অপেক্ষা করছিল। সেখানে আগে থেকে ওত পেতে থাকা চার থেকে পাঁচজন সন্ত্রাসী হেঁটে এসে প্রথমে তাদের মাথায় পরপর চার-পাঁচ রাউন্ড গুলি করে। গুলির আঘাতে তারা রাস্তার ওপর লুটিয়ে পড়লে সন্ত্রাসীরা ধারালো চাপাতি দিয়ে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে পালিয়ে যায়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেন, দুজন মোটরসাইকেলের ওপর বসেছিল। এ সময় হঠাৎ চার-পাঁচজন যুবক আসে। তখন তাদের মধ্যে মাথায় ক্যাপ পরা একজন পরপর চার-পাঁচটি গুলি করে। এরপর অন্যরা তাদের চাপাতি দিয়ে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে জখম করে। এতে হাসিব হাওলাদার ঘটনাস্থলেই মারা যায়। এরপর সন্ত্রাসীরা হাঁটতে হাঁটতে ঘটনাস্থল ত্যাগ করে।
প্রত্যক্ষদর্শী সূত্র আরও জানায়, আদালত এলাকার কাছে একটি কালো রঙের মাইক্রোবাস দাঁড়িয়েছিল। সন্ত্রাসীরা পায়ে হেঁটে গিয়ে ওই মাইক্রোবাসে উঠে জিলা স্কুলের সামনে দিয়ে কাস্টমঘাট এলাকার দিকে চলে যায়। এ সময় চারটি মোটরসাইকেলে কয়েকজন যুবক তাদের পাহারায় ছিল।
এদিকে গুলির শব্দ ও জোড়া হত্যাকাণ্ডের খবর আদালত এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে চরম আতঙ্ক দেখা দেয়। ভয়ে আদালতে হাজিরা দিতে আসা লোকজন ও আইনজীবীরা দিগ্বিদিক ছোটাছুটি করতে থাকে। অনেকে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নেয়। পরে খবর পেয়ে পুলিশ, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন ঘটনাস্থলে পৌঁছায়।
এদিকে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) ডা. শামীম হাসান জানান, হত্যাকাণ্ডের পর নিহত ফজলে রাব্বি রাজনের মরদেহ খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে নেওয়া হয়। তবে হাসিবের মরদেহ ইজিবাইকে হাসপাতালে নিয়ে আসার পথে কে বা কারা ছিনতাই করে নিয়ে গেছে বলে শুনেছি। যদিও পরে তার মরদেহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ময়নাতদন্তের জন্য আনা হয়। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, রোববার সকালে মরদেহ ময়নাতদন্ত শেষে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হবে।
পুলিশ সূত্র জানায়, গত ৩০ মার্চ রাতে যৌথবাহিনীর হাতে শীর্ষ সন্ত্রাসী পলাশের সঙ্গে রাজন ও হাসিব গ্রেফতার হয়। আড়াই মাস আগে উচ্চ আদালত থেকে তারা জামিনে মুক্তি পেয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে। আজ (গতকাল) নগরীর সোনাডাঙ্গা থানার একটি অস্ত্র মামলায় তাদের আদালতে হাজিরার দিন ছিল। দুপুরে তারা আদালতে হাজিরা দিয়ে বের হওয়ার সময় প্রতিপক্ষের সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হয়।
খুলনা সদর থানার ওসি শফিকুল ইসলাম বলেন, নিহত রাজন ও হাসিব খুলনার শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী পলাশ গ্রুপের সদস্য। তাদের দুজনের বিরুদ্ধে খুলনা থানায় হত্যাসহ ছয়টি করে মামলা রয়েছে। এ ছাড়া তাদের বিরুদ্ধে নগরীর সোনাডাঙ্গা ও লবণচরা থানাসহ অন্যান্য থানাতেও একাধিক মামলা রয়েছে।
খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের (কেএমপি) সহকারী কমিশনার (মিডিয়া অ্যান্ড সিপি) ত. ম. রোকনুজ্জামান জানান, নিহত দুজন খুলনার শীর্ষ সন্ত্রাসী পলাশ গ্রুপের সক্রিয় সদস্য। এ ডাবল মার্ডারের সঙ্গে পলাশ গ্রুপের প্রধান প্রতিপক্ষ অন্য শীর্ষ সন্ত্রাসী ও মাদক ব্যবসায়ী গ্রেনেড বাবুর সম্পৃক্ততা রয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। আধিপত্য বিস্তার নিয়ে এ হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়ে থাকতে পারে। হত্যাকাণ্ডস্থলের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ এবং মোটরসাইকেলের বিভিন্ন চিত্র পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে।
শিগগিরই হত্যাকারীদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা সম্ভব হবে বলে মনে করেন তিনি। অন্যদিকে হাসিবের ভাই শাকিল হাওলাদার জানান, আদালত চত্বর একটি নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যে থাকে। সেখানে এমন হত্যাকাণ্ড, যা ভাবিয়ে তুলেছে। আমরা চাইব, প্রশাসন এই হত্যাকাণ্ডের কারণ দ্রুত উদঘাটন করে সংশ্লিষ্টদের আইনের আওতায় এনে সর্বোচ্চ সাজা নিশ্চিত করবে।
কয়েকটি ঘটনা : পুরান ঢাকার ন্যাশনাল মেডিকেল ইনস্টিটিউট হাসপাতালের সামনে গত ১০ নভেম্বর পুলিশের তালিকাভুক্ত ‘শীর্ষ সন্ত্রাসী’ তারিক সাইফ মামুনকে (৫৫) খুব কাছ থেকে গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। আদালতে হাজিরা দিতে এসে হত্যাকাণ্ডের শিকার হন তিনি। এর আগে চলতি বছরের ৬ অক্টোবর সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা উপজেলা আদালত প্রাঙ্গণে সাবেক স্বামীর ছুরিকাঘাতে নিহত হন শরীফা আক্তার (২৮) নামে এক গৃহবধূ।
ক্রমবর্ধমান এসব হত্যাকাণ্ডের পর দেশের আদালত এলাকায় নিরাপত্তা জোরদারে পোশাকে পুলিশের পাশাপাশি সাদা পোশাকের গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন পুলিশ সদর দফতরের এআইজি (মিডিয়া)। তিনি বলেন, আদালতগুলোতে বাড়ানো হয়েছে পুলিশের টহলও।
২০২৪ সালের ২৬ নভেম্বর জাতীয় পতাকা অবমাননার অভিযোগে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় দাসের জামিনকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রাম আদালতপাড়ায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ সময় আইনজীবী সাইফুল ইসলামকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করা হয়।
এর আগে ৬ নভেম্বর ঢাকার জজকোর্ট প্রাঙ্গণে বিচারপ্রার্থী তিন ভাই আদালত কক্ষে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গেই হেলমেট পরা ৮-১০ জন বহিরাগতের হামলার শিকার হন। তাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা একটি মামলার শুনানিতে হাজিরা দিতে এসেছিলেন তিন ভাই। অতর্কিত এ হামলায় তিনজনই গুরুতর আহত হন।
২০২২ সালের ২১ জুলাই সুনামগঞ্জ আদালত চত্বরে হাজিরা দিতে এসে খুন হন মিজানুর হোসেন ওরফে খোকন মিয়া। সেদিন মামলার কয়েক আসামি ধারালো অস্ত্র দিয়ে তাকে কুপিয়ে আহত করেন। পরে এ মামলায় একজনকে মৃত্যুদণ্ড এবং চারজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন আদালত।
২০১৯ সালের ১৫ জুলাই কুমিল্লায় আদালত কক্ষে বিচারকের উপস্থিতিতে শুনানিকালেই এক আসামির ছুরিকাঘাতে নিহত হন আরেক আসামি।
সহিংসতার এ প্রবণতা আদালত প্রাঙ্গণ ছাড়িয়ে বিচারকদের বাসাবাড়িতেও দেখা গেছে। গত ১৩ নভেম্বর রাজশাহী মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক মোহাম্মদ আবদুর রহমানের ভাড়া বাসায় ঢুকে তার ছেলে তাওসিফ রহমানকে (সুমন) ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়।
এ ঘটনায় গভীর শোক ও ক্ষোভ প্রকাশ করে বিচারকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতসহ দুটি দাবিতে সরকারকে ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম দেয় বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন। দাবিমতো ব্যবস্থা না নিলে ১৬ নভেম্বর সারা দেশে একযোগে কলম বিরতির হুঁশিয়ারি দেয় সংগঠনটি।
Sharing is caring!