প্রজন্ম ডেস্ক:
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্লট দুর্নীতির তিন মামলার রায় ঘোষণার আগে আদালত যে পর্যবেক্ষণ দিয়েছে, সেখানে তার সম্পদের প্রতি ‘লোভের’ কথা বলা হয়েছে।
আদালত এমন পর্যবেক্ষণ দেওয়ার পর শেখ হাসিনার সম্পদ এবং তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির আর কত মামলা ও অভিযোগ রয়েছে সে বিষয়টি আলোচনায় এসেছে।
বৃহস্পতিবার ওই তিন মামলায় শেখ হাসিনা, তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় ও মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলকে দোষী সাব্যস্ত করে বিভিন্ন মেয়াদে সাজার রায় দিয়েছে আদালত।
এর আগে জুলাই গণঅভ্যুত্থান দমানোর চেষ্টায় মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের দায়ে দোষী সাব্যস্ত করে গেল ১৭ নভেম্বর শেখ হাসিনাকে মৃত্যুদণ্ড দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এবার তাকে দুর্নীতি মামলায় কারাদণ্ড দেওয়া হল।
তিনি বাংলাদেশের দ্বিতীয় সাবেক রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধান, দুর্নীতির দায়ে যার সাজার রায় এল।
গত বছর ৫ অগাস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর শেখ হাসিনা পালিয়ে ভারতে চলে যান।
ক্ষমতার পালাবদলের পর সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা, তার পুত্র-কন্যা এবং বোন শেখ রেহানা, তার পুত্র-কন্যা ও দেবর–অর্থাৎ শেখ হাসিনা ও রেহানা পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধানে নামে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
‘ক্ষমতার অপব্যবহার’ করে প্লট, টোল ও অনুদান ‘দুর্নীতি ও অর্থপাচার’ এর মত অনিয়মের অভিযোগসহ আরও বিভিন্ন অভিযোগে তাদের বিরুদ্ধে মামলা, অনুসন্ধান ও তদন্ত করছে দুদক। এই পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে এরই মধ্যে অন্তত ১৫টি মামলা করেছে সংস্থাটি, যার তিনটিতে রায় হল বৃহস্পতিবার।
এছাড়া মেঘনা-গোমতী সেতুর টোল ‘অনিয়ম’, সূচনা ফাউন্ডেশন ও সিআরআই এর অনুদান ও লেনদেন, ব্যাংকের সিএসআর ফান্ড ‘আত্মসাৎ’, ‘বিদেশে অর্থপাচার’, শত শত কোটি টাকার ‘সন্দেহজনক ব্যাংক লেনদেন’ এবং বড় সরকারি প্রকল্পে ‘দুর্নীতির’ মামলা ও অভিযোগ অনুসন্ধান ও তদন্তের পর্যায়ে রয়েছে।
দুদকের হিসাবে, শেখ হাসিনা পরিবারের কয়েক হাজার কোটি টাকার ‘অবৈধ সম্পদসহ’ বড় প্রকল্পে ৮০ হাজার কোটি টাকা ও ৩০ কোটি ডলার ‘পাচারের’ মত অভিযোগ এখনও অনুসন্ধানের তালিকায় রয়েছে।
দুদকের মহাপরিচালক মো. আক্তার হোসেন বলেন, “সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অনুসন্ধান ও মামলার তদন্ত কার্যক্রম চলছে। অনুসন্ধান ও তদন্ত দল তাদের কাজ সম্পন্ন করার পর প্রতিবেদন কমিশনে দাখিল করবে। সেই প্রতিবেদনের আলোকে পরবর্তীতে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।”
তিনি বলেন, সমস্ত কার্যক্রমে ‘প্রমাণ ও দালিলিক তথ্যের’ ভিত্তিতে দুদক কর্মকর্তারা কমিশনে প্রতিবেদন দাখিল করেন এবং সেই আলোকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
প্লট দুর্নীতির তিন মামলার রায়
ঢাকার পঞ্চম বিশেষ জজ আদালতের বিচারক মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল মামুন বৃহস্পতিবার প্লট দুর্নীতির তিন মামলার রায় দেন।
তিন মামলায় শেখ হাসিনাকে ৭ বছর করে মোট ২১ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
শেখ হাসিনার পাশাপাশি তার ছেলে জয়কে একটি মামলায় এবং মেয়ে পুতুলকে আরেক মামলায় পাঁচ বছর করে সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
কারাদণ্ডের পাশাপাশি শেখ হাসিনাকে এক লাখ টাকা করে তিন লাখ টাকা অর্থদণ্ড, অনাদায়ে তাকে ৬ মাস করে মোট ১৮ মাস বিনাশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত। পুতুল ও জয়কে কারাদণ্ডের পাশাপাশি এক লাখ টাকা করে অর্থদণ্ড, অনাদায়ে ৬ মাস করে বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, ঢাকা শহরে বাড়ি বা ফ্ল্যাট বা আবাসন সুবিধা থাকার পরেও ‘সেই তথ্য গোপন করে তারা আইন ভেঙে দুর্নীতির মাধ্যমে’ পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে ১০ কাঠা আকারের তিনটি প্লট বরাদ্দ নিয়েছেন।
রায় ঘোষণার আগে পর্যবেক্ষণে বিচারক মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, “শেখ হাসিনা একজন ‘পলিটিক্যাল লিডার’, চারবারের প্রধানমন্ত্রী। তার কেন এতো টাকা লাগবে, এতো সম্পদ লাগবে?”
বিস্মিত হয়ে তিনি এও বলেন, “তার সম্পদের প্রতি এত লোভ!”
হাসিনা-রেহানা পরিবারের ‘প্লট দুর্নীতি’
দুদক বলছে, শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে মোটা দাগে তিন ধরনের কার্যক্রম চলছে—দুদকের দায়ের করা মামলা, অভিযোগের ভিত্তিতে অনুসন্ধান, বহু কোটি টাকার ‘দুর্নীতি, অর্থপাচার ও সম্পদ গোপনের’ তদন্ত।
অন্তর্বর্তী সরকারের গেল ১৫ মাসে শেখ হাসিনা ও তার বোন রেহানা পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির যে ১৫টি মামলা হয়েছে তার সাতটিতেই আসামির তালিকায় হাসিনার নাম রয়েছে।
পূর্বাচলে প্লট দুর্নীতির ছয়টি মামলার মধ্যে আরেকটি মামলার রায় হবে ১ ডিসেম্বর। এ মামলায় রেহানা ও তার মেয়ে ব্রিটিশ এমপি টিউলিপ সিদ্দিকের সঙ্গে শেখ হাসিনাও আসামি।
প্লট দুর্নীতির আরও দুটি মামলা রয়েছে, যেখানে শেখ হাসিনার সঙ্গে তার দুই ভাগ্নে-ভাগ্নি রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ও আজমিনা সিদ্দিক রূপন্তীও আসামি। এ দুই মামলার বিচার চলছে।
রাজউকের সহযোগিতায় অবৈধভাবে পূর্বাচল নতুন শহরের কূটনৈতিক অঞ্চলে ১০ কাঠা আকারের ছয়টি প্লট (মোট ৬০ কাঠা) বরাদ্দ নেওয়ার এই মামলাগুলো দুদক করেছে চলতি বছর ১২–১৪ জানুয়ারির মধ্যে।
মেঘনা-গোমতী সেতুর টোল ‘দুর্নীতি’
মেঘনা–গোমতী সেতুর টোল আদায় কাজে চুক্তিগত অনিয়ম, দরপত্রে কারসাজি এবং সরকারি অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে গেল অক্টোবর মাসে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ১৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক।
দুদকের সহকারী পরিচালক তানজিল হাসান বাদী হয়ে দায়ের করা এই মামলায় এজাহারে বলা হয়েছে, ২০১৬ সালে মেঘনা-গোমতী সেতুর টোল আদায়ের জন্য কম্পিউটার নেটওয়ার্ক সিস্টেম (সিএনএস) লিমিটেডকে শতকরা ১৭.৭৫ শতাংশ সার্ভিস চার্জে (ভ্যাট ও আইটি ব্যতীত) পাঁচ বছরের জন্য কার্যাদেশ দেওয়া হয়।
“আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে নিজেদের ও অন্যদের আর্থিকভাবে লাভবান করতে প্রতারণা ও সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন, যার ফলে সরকারের ৩০৯ কোটি ৪২ লাখ ৪৫ হাজার ৮৯০ টাকার ক্ষতি হয়।”
সূচনা ফাউন্ডেশনের ‘দুর্নীতি’
সূচনা ফাউন্ডেশন নামে ‘ভুয়া’ প্রতিষ্ঠান গড়ে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ‘দানের নামে ঘুষ আদায় এবং তা আত্মসাৎ করার’ অভিযোগে গেল সেপ্টেম্বরে শেখ হাসিনার মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলসহ ৩৫ জনের বিরুদ্ধে দুদক মামলা দায়ের করে।
মামলায় দুদক অভিযোগ করেছে, পুতুলসহ অন্যান্য আসামিরা সূচনা ফাউন্ডেশন নামের একটি ‘কাগুজে প্রতিষ্ঠান’ গঠন করে এনজিও ব্যুরো ও সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে নিবন্ধন নেন। এরপর তারা বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে অনুদানের নামে ‘অবৈধ সুবিধা দিয়ে ঘুষ আদায় করেন এবং সেই টাকা প্রতিবন্ধীদের কল্যাণে ব্যয় না করে আত্মসাৎ করেন’।
স্বেচ্ছাসেবী ও অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ২০১৪ সালে গড়ে ওঠা সূচনা ফাউন্ডেশন মানসিক প্রতিবন্ধিতা, স্নায়বিক প্রতিবন্ধিতা, অটিজম এবং মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা যুক্ত ব্যক্তিদের নিয়ে কাজ করে। সায়মা ওয়াজেদ এটির প্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারপারসন ছিলেন।
গত বছর ৫ অগাস্টের পর দুদক সূচনা ফাউন্ডেশনের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করে। ২৪ নভেম্বর বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) ফাউন্ডেশনের ব্যাংক হিসাব জব্দ করে এবং চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ফাউন্ডেশনের আয়কর অব্যাহতি বাতিল করে।
২৯ জানুয়ারি দুদক ফাউন্ডেশনের অফিসে অভিযান চালিয়ে প্রতিষ্ঠানটিকে ‘অস্তিত্বহীন’ বলে জানায়।
জয়ের ৬০ কোটি টাকার ‘অবৈধ সম্পদ’
আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনার ছেলে জয়ের বিরুদ্ধে ‘অবৈধ সম্পদ অর্জন এবং অর্থ পাচারের’ অভিযোগে গেল অগাস্টে মামলা করে দুদক।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টার দায়িত্ব থাকার সময় ‘ক্ষমতার অপব্যহার করে’ ৬০ কোটি টাকার বেশি মূল্যের ‘অবৈধ’ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ আনা হয়েছে জয়ের বিরুদ্ধে।
এছাড়াও তার বিরুদ্ধে ‘সন্দেহজনক লেনদেন, দুর্নীতি ও ঘুষ গ্রহণের’ অভিযোগ এনেছে দুদক। ২০০০ সাল থেকে ২০২৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত সময়কালে জয় এই ‘অবৈধ সম্পদ অর্জন, ঘুষ-দুর্নীতি ও অর্থ পাচার’ করেছেন বলে দুদক দাবি করছে।
মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, জয় তার সরকারি দায়িত্ব ‘ব্যবহার করে অবৈধ উপায়ে’ মোট ৬০ কোটি ৮৪ লাখ ৭৩ হাজার ৯৭০ টাকা মূল্যের সম্পদ অর্জন করেছেন, যা তার জ্ঞাত আয়ের উৎসের সাথে ‘অসঙ্গতিপূর্ণ’। এই অর্থের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে দুটি বাড়ি কেনায় ও বিনিয়োগে ব্যয় করা হয়েছে ৫৪ কোটি ৪ লাখ ৩২ হাজার ২৯৮ টাকা।
সিআরআই এর ‘অনিয়ম ও দুর্নীতি’
আওয়ামী লীগের গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশন (সিআরআই)-এর বিভিন্ন ‘অনিয়ম ও দুর্নীতির’ অভিযোগে জয়, পুতুল ও রেহানাপুত্র রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববিসহ আটজনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা করেছে দুদক।
জয় সিআরআই ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান, পুতুল ভাইস চেয়ারম্যান এবং ববি ট্রাস্টি হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন।
মামলার এজাহারে ঘটনার সময়কাল বলা হয়েছে ২০১৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর থেকে ২০২৪ সালের ১০ জুলাই পর্যন্ত।
এজাহারে দুদক বলেছে, সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে নিবন্ধন না থাকলেও সিআরআই ২৩টি প্রতিষ্ঠান থেকে মোট ৪৫ কোটি ৩৫ লাখ ৯৫ হাজার টাকা নিয়েছে।
এছাড়া প্রতিষ্ঠানের নামে ২৫টি ব্যাংক হিসাব পর্যালোচনা করে দুদক বলছে, এসব হিসাবে ২৪৭ কোটি ৮৫ লাখ টাকা জমা এবং ১৯১ কোটি ২১ লাখ টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। অর্থাৎ মোট ৪৩৯ কোটি টাকার ‘অস্বাভাবিক’ লেনদেন হয়েছে।
‘মিথ্যা তথ্যে’ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় পুতুলের নিয়োগ
‘প্রতারণা ও জালিয়াতির’ মাধ্যমে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক পদে নিয়োগ লাভ করার অভিযেগে গেল মার্চে পুতুলের বিরুদ্ধে একটি মামলা করে দুদক।
মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, তিনি এ পদে নিয়োগ লাভের উদ্দেশ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় ২০২৩ সালে জীবন বৃত্তান্ত (সিভি) পাঠান।
সিভিতে পুতুল তখনকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়-বিএসএমএমইউ’র শিক্ষকতা বা শিক্ষা ম্যানুয়েল রিভিউ সম্পর্কিত কার্যক্রমে অংশগ্রহণ, অটিজম এবং মানসিক সমস্যা সংক্রান্ত কারিগরি বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করার কথা তুলে ধরেন। দায়িত্ব পালনের এই যোগ্যতা অন্তর্ভুক্ত করায় তার সিভি সমৃদ্ধ হয়, যার ফলে আঞ্চলিক পরিচালক পদে ‘নিয়োগের পথ সুগম’ হয়।
কিন্তু অনুসন্ধানে ‘জালিয়াতির মাধ্যমে’ পুতুল সিভিতে ‘মিথ্যা ও ভুয়া যোগ্যতা’ অন্তর্ভুক্ত করেছেন, এমন প্রমাণ পাওয়ার কথা বলেছে দুদক।
তার আগে অনুসন্ধানের বরাতে দুদক বলেছে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় মনোনয়নকালে পুতুল কানাডার পাসপোর্টধারী তথা কানাডার নাগরিক ছিলেন।
ভারতে সংস্থার আঞ্চলিক দপ্তরে কর্মরত থাকা পুতুলকে সরানোর পদক্ষেপ নিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছিল দুদক।
গেল ১২ জুলাই দেশের বেশির ভাগ সংবাদমাধ্যম স্বাস্থ্য খাতের সাংবাদিকদের নেটওয়ার্ক—হেলথ পলিসি ওয়াচের বরাতে পুতুলকে ‘অনির্দিষ্টকালের ছুটিতে’ পাঠানোর খবর দেয়।
তবে এ খবরের সত্যতা নিজেরা যাচাই করতে পারেনি।
রেহানা পরিবারের বিরুদ্ধে আরও মামলা
পূর্বাচলে প্লট দুর্নীতির তিন মামলা ছাড়া শেখ রেহানা পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে আরও কয়েকটি মামলা হয়েছে।
তার ছেলে ববির বিরুদ্ধে সিআরআই দুর্নীতি মামলা ছাড়াও গেল ২৭ জুলাই ‘অবৈধ সম্পদ’ অর্জনের একটি মামলা করেছে দুদক।
দুদকের অভিযোগে বলা হয়েছে, ববির নামে উল্লেখযোগ্য ব্যবসা বা বৈধ আয়ের উৎস ‘না থাকলেও’ তার বিপুল পরিমাণ সম্পদ ও ‘সন্দেহজনক’ ব্যাংক লেনদেন পাওয়া গেছে।
দুদকের মতে, এসব লেনদেনের উৎস অস্পষ্ট এবং বৈধতার প্রমাণ নেই।
মামলায় বলা হয়েছে, ববি নিজের নামে ২ কোটি ৮৯ লাখ ৩ হাজার ৩৫৫ টাকার জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জন করেছেন এবং সেগুলো দখলে রেখেছেন। এর বাইরে ঢাকার নিকেতন এলাকায় চাচা তারিক আহমেদ সিদ্দিকের কাছ থেকে দানসূত্রে পাওয়া তার ফ্ল্যাটের মূল্য ১ কোটি ৭৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা।
কোনো ব্যবসা-বাণিজ্য না থাকার পরও ববি তিনটি ব্যাংক হিসাবে ৭ কোটি ৪৮ লাখ ৩২ হাজার ৫৭৮ টাকা জমা করেন, যার মধ্যে ৫ কোটি ৭ হাজার ৯৭১ টাকা উত্তোলন করেন। এই লেনদেন তার বৈধ আয়ের তুলনায় অস্বাভাবিক ও সন্দেহজনক বলে এজাহারে বলা হয়েছে।
‘ঘুষ’ হিসেবে ফ্ল্যাট, টিউলিপের বিরুদ্ধে মামলা
ঢাকার গুলশানের একটি প্লট ‘অবৈধভাবে হস্তান্তরের ব্যবস্থা’ করে ইস্টার্ন হাউজিং লিমিটেডের কাছ থেকে ‘ঘুষ’ হিসেবে একটি ফ্ল্যাট নেওয়ার অভিযোগে গত এপ্রিলে রেহানাকন্যা ব্রিটিশ এমপি টিউলিপ সিদ্দিকের বিরুদ্ধে দুদক মামলা করেছে।
মামলায় বলা হয়েছে, ওই প্লটের হস্তান্তর প্রক্রিয়া ১৯৯৭ সালে শেখ হাসিনার প্রথম মেয়াদে শুরু হয়।
এজাহারে অভিযোগ করা হয়েছে, টিউলিপ ও সংশ্লিষ্টরা একে অপরের সঙ্গে যোগসাজশ করে ‘অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র, দুর্নীতি, দায়িত্বে অসদাচরণ ও ক্ষমতার অপব্যবহার’ করে কোনো অর্থ প্রদান না করেই ইস্টার্ন হাউজিং থেকে ‘অবৈধ সুবিধা’ গ্রহণ করেন। পরে রেজিস্ট্রির মাধ্যমে ফ্ল্যাটের মালিকানা নেন।
এ কাজে তার সহযোগী হিসেবে রাজউকের সাবেক সহকারী আইন উপদেষ্টা শাহ মো. খসরুজ্জামান ও সরদার মোশারফ হোসেনকে মামলার আসামি করা হয়েছে। এছাড়া সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী প্রয়াত মোহাম্মদ নাসিমের ভাই রাজউকের আইন উপদেষ্টা মো. সেলিম এবং ইস্টার্ন হাউজিংয়ের চেয়ারম্যান জহুরুল ইসলামের জড়িত থাকার প্রাথমিক প্রমাণ পাওয়া গেছে। তবে তারা মারা যাওয়ায় তাদেরকে আসামি করা যায়নি।
এজাহারে বলা হয়েছে, ১৯৬৩ সালে তৎকালীন বিচারপতি ইমাম হোসেন চৌধুরী গুলশানে ১ বিঘা ১৯ কাঠা ১৩ ছটাক আয়তনের একটি প্লট বরাদ্দ পান। সরকারি ইজারা চুক্তি অনুযায়ী, ৯৯ বছরের মধ্যে প্লট হস্তান্তর বা বিক্রি নিষিদ্ধ ছিল। তবে ১৯৭৩ সালে তিনি মো. মজিবুর রহমান ভূঁইয়াকে আমমোক্তার মাধ্যমে প্লট হস্তান্তর করেন। পরে এটি ভাগ হয়ে বিক্রি হয় এবং ইস্টার্ন হাউজিংয়ের মাধ্যমে ভবন নির্মাণ শুরু হয়।
মামলায় বলা হয়েছে, জহুরুল ইসলামের মৃত্যুর পর তার সন্তানদের মধ্যে বিরোধ শুরু হলে মামলা হয়। এই সময়ে হস্তান্তর নিষিদ্ধ থাকা সত্ত্বেও রাজউকের আইন উপদেষ্টারা ইস্টার্ন হাউজিংকে ফ্ল্যাট হস্তান্তরের অনুমোদন দেন, যা অবৈধ ছিল। তবুও আমমোক্তার মাধ্যমে ৩৬টি ফ্ল্যাট নির্মাণ ও হস্তান্তরের অনুমোদন দেওয়া হয়।
এজাহারে বলা হয়েছে, এই প্রক্রিয়ায় ইজারার শর্ত ভঙ্গ করে টিউলিপ সিদ্দিক ‘বিনামূল্যে’ ফ্ল্যাট গ্রহণ করেন এবং এতে ‘অবৈধ সুবিধা’ নেন।
লন্ডনে বিনামূল্যে ফ্ল্যাট উপহার নেওয়া এবং বাংলাদেশে দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগ ওঠার খবর আসার পর ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম লেবার পার্টির এমপি ও ব্রিটেনের আর্থিক সেবা বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী টিউলিপকে পদত্যাগের আহ্বান জানায়। পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রীকে তাকে বাদ দেওয়ার পরামর্শও দেওয়া হয়।
সমালোচনার মুখে শেষ পর্যন্ত চলতি বছর ১৪ জানুয়ারি টিউলিপের প্রতিমন্ত্রী পদ ছাড়ার খবর আসে।
তারিক সিদ্দিক পরিবারের বিরুদ্ধে মামলা
দুদক শেখ রেহানার দেবর এবং সাবেক প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা, শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ সহযোগী তারিক আহমেদ সিদ্দিক, তার স্ত্রী এবং দুই মেয়ের বিরুদ্ধে চারটি মামলা করেছে।
মামলায় তাদের ‘অবৈধ সম্পদ’ ও ‘সন্দেহজনক’ ব্যাংক লেনদেন থাকার অভিযোগ করা হয়েছে। এছাড়া, বিমানবন্দরের বিভিন্ন প্রকল্পে তারিক আহমেদ সিদ্দিকের সম্পৃক্ততা সংক্রান্তও মামলাও করেছে দুদক।
অনুসন্ধান পর্যায়ে আছে যেসব অভিযোগ
আওয়ামী লীগ সরকারের বিশেষ অগ্রাধিকারের আট প্রকল্পে শেখ হাসিনাসহ অন্যান্যদের বিরুদ্ধে ওঠা ২১ হাজার কোটি টাকা ‘দুর্নীতির’ একটি অভিযোগ অনুসন্ধান করছে দুদক। এসব ‘দুর্নীতিতে’ শেখ হাসিনা, তার ছেলে জয়, বোন রেহানার সম্পৃক্ততা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
আশ্রয়ণ প্রকল্প, বেজা ও বেপজার আট প্রকল্প বাস্তবায়নের আড়ালে ‘২১ হাজার কোটি টাকা লোপাটের’ অভিযোগটি এসেছে সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পে ৫৯ হাজার কোটি টাকার ‘দুর্নীতির’ অভিযোগও দুদক হাতে পেয়েছে। এই প্রকল্প থেকে মালয়েশিয়ার ব্যাংকের মাধ্যমে শেখ হাসিনা, তার ছেলে জয় ও ভাগ্নি টিউলিপ সিদ্দিকের ৫ বিলিয়ন ডলার লোপাটের অভিযোগ অনুসন্ধানে দুদকের নিষ্ক্রিয়তা কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে গত ১৫ ডিসেম্বর রুল জারি করেছিল হাই কোর্টের একটি বেঞ্চ।
দুদিন পর অভিযোগ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত জানায় দুদক। বিভিন্ন ‘উন্মুক্ত সূত্র’ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, রূপপুরে দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলারের ‘আর্থিক অনিয়ম’ হয়েছে, বলছে দুদক।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার বোন শেখ রেহানা এবং অন্যান্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে যে, মুজিববর্ষ উদযাপন ও সারাদেশে ১০ হাজারের বেশি শেখ মুজিবুর রহমানের ম্যুরাল ও ভাস্কর্য নির্মাণের নামে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে, যা দুদকের তদন্তে ‘অপ্রয়োজনীয় ও অপচয়’ হিসেবে মূল্যায়িত হচ্ছে।
আওয়ামী লীগ সরকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে ২০২১ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত মুজিববর্ষ পালন ঘোষণা করেছিল। করোনাভাইরাসের কারণে নির্ধারিত কর্মসূচি যথাযথভাবে সম্পন্ন না হওয়ায় মুজিববর্ষের মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত করা হয়।
এ সময়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার সারা দেশে ম্যুরাল ও ভাস্কর্য নির্মাণ কার্যক্রম শুরু করেছিল।
এছাড়া প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের বিশেষ বরাদ্দের অর্থের ব্যবহার, বিদেশ সফরের ব্যয়ের অনিয়ম, বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন সেক্টরের কয়েকটি চুক্তিতে অনিয়ম, সরকারি তহবিল দিয়ে দলীয়–ব্যক্তিগত প্রকল্প চালানো নিয়েও অনুসন্ধান করছে দুদক।
গত বছর ডিসেম্বরে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার ছেলে জয়ের বিরুদ্ধে ৩০ কোটি ডলার ‘পাচারের’ অভিযোগে অনুসন্ধান শুরুর সিদ্ধান্ত জানায় দুদক।
অভিযোগ অনুসারে, অর্থ পাচারের সন্দেহভাজন হিসেবে সজীব ওয়াজেদের নাম প্রথম আসে ২০১৪ সালের যুক্তরাষ্ট্র বনাম রিজভী আহমেদ মামলায়। পরে যুক্তরাষ্ট্রের একটি গোয়েন্দা সংস্থার তদন্তে দেখা যায়, হংকং ও কেম্যান দ্বীপপুঞ্জের ‘অফশোর অ্যাকাউন্ট’ থেকে স্থানীয় একটি মানি এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে ওয়াশিংটন, নিউ ইয়র্ক ও লন্ডনের বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবে অর্থ স্থানান্তর করা হয়েছে।
সংক্ষিপ্ত তদন্ত–সারাংশে বলা হয়েছে, মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এবং যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগের সিনিয়র ট্রায়াল অ্যাটর্নি লিন্ডা স্যামুয়েলস এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন যে বাংলাদেশ থেকে ৩০ কোটি ডলার যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকগুলোতে জমা হয়েছে।
যা বলেছে শ্বেতপত্র কমিটি
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশের অর্থনীতির হালচাল জানতে অন্তর্বর্তী সরকার একটি শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি করে। গত ডিসেম্বরে এই কমিটি প্রতিবেদন দিয়েছে, সেখানে শেখ হাসিনার দীর্ঘ শাসনামলে বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর গড়ে ১৬ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে বলে পর্যবেক্ষণ এসেছে।
হাসিনা সরকারের সময়ে ছোট–বড় মিলিয়ে বহু উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। শ্বেতপত্র কমিটি এসব প্রকল্প পর্যালোচনা করে। বড় ২৯টি প্রকল্পের মধ্যে সাতটি প্রকল্প বিস্তারিতভাবে পরীক্ষা করে কমিটি দেখতে পায়—প্রতিটি বড় প্রকল্পেই ব্যয় হয়েছে ১০ হাজার কোটি টাকারও বেশি।
মোট ২৯টি প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে ৮৭ বিলিয়ন ডলার বা ৭ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। পরীক্ষা করা সাতটি প্রকল্পের প্রাথমিক ব্যয় ধরা হয়েছিল প্রায় ১ লাখ ১৪ হাজার কোটি টাকা, কিন্তু সংশোধিত ব্যয় দাঁড়ায় ১ লাখ ৯৫ হাজার কোটি টাকা। এসব প্রকল্পের ব্যয় বাড়ানোর ক্ষেত্রে জমির মূল্য অতিরিক্ত দেখানো, জমি ক্রয়ে হেরফের এবং বিভিন্ন কৃত্রিম খাত তৈরি করে ব্যয় বাড়ানো হয় বলে পর্যবেক্ষণ দিয়েছে শ্বেতপত্র কমিটি।
কমিটি বলেছে, কোথাও কোথাও প্রকল্প ব্যয় ৭০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়েছে।
সম্পাদক মন্ডলীর সভাপতিঃ মোহাম্মদ আফছার খান সাদেক
সম্পাদক ও প্রকাশকঃ মিলাদ মোঃ জয়নুল ইসলাম
প্রকাশনালয়ঃ রিপোর্টার লজ, কসবা, বিয়ানীবাজার, সিলেট ।
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ উত্তর বাজার কেন্দ্রিয় মসজিদ মার্কেট (২য় তলা), বিয়ানীবাজার, সিলেট ।
মোবাঃ ০১৮১৯-৬৫৬০৭৭, ০১৭৩৮-১১ ৬৫ ১২
ইমেইলঃ agamiprojonma@gmail.com, milad.jaynul@gmail.com