প্রকাশনার ১৬ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

৭ই ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
২২শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
১৬ই জমাদিউস সানি, ১৪৪৭ হিজরি

কর্মসংস্থান নেই, বাড়ছে বেকারত্ব

editor
প্রকাশিত ডিসেম্বর ৬, ২০২৫, ০৩:১৭ অপরাহ্ণ
কর্মসংস্থান নেই, বাড়ছে বেকারত্ব

Manual2 Ad Code

 

Manual2 Ad Code

প্রজন্ম ডেস্ক:

দেশে বিনিয়োগে খরা চলছে। শিল্প খাতে গতি নেই। নতুন শিল্প গড়ে উঠছে না, পুরোনো শিল্পগুলোর বেশিরভাগ বেকায়দায় আছে। টিকে থাকার কৌশল হিসেবে অনেকে খরচ কমাতে কর্মকর্তা-কর্মচারী-শ্রমিক ছাঁটাইয়ের মতো সহজ পথ বেছে নিয়েছে। সরকারি খাতেও নতুন কাজের খোঁজ নেই। অন্যদিকে বিগত সরকারের সময়ের প্রভাবশালীদের মালিকানাধীন অনেক কারখানা বন্ধ হয়েছে। সবকিছু মিলিয়ে দেশে কর্মসংস্থানে গতি নেই। ফলে বাড়ছে বেকারত্ব । যা সমগ্র অর্থনীতির ওপর চাপ বাড়াচ্ছে বলে জানিয়েছেন অর্থনীতির বিশ্লেষক ও শিল্প খাতের সংশ্লিষ্টরা।

Manual6 Ad Code

বেসরকারি গবেষণা ও নীতি বিশ্লেষণমূলক প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেছেন, সরকারি-বেসরকারি কোনো খাতেই কর্মসংস্থান হচ্ছে না। দেশে বেকারত্ব বাড়ার মূল কারণ, বিনিয়োগ নেই। বিনিয়োগের সহায়ক পরিবেশ তৈরি করতে হবে।

বিনিয়োগকারীদের এই নিশ্চয়তা দিতে হবে যে তাদের বিনিয়োগের অর্থ ফেরত আসবে। তাহলে দ্রুত শিল্পায়ন হবে। এতে কর্মসংস্থান হবে। বেকারত্ব কমবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক মুস্তফা কে. মুজেরী বলেছেন, বেকারত্ব কমাতে বেসরকারি খাতকে গতিশীল করতে হবে। এর জন্য তরুণ-তরুণীদের কম সুদে ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে। এসব ঋণ যাতে সহজে তারা পায় তার দিকে নজর দিতে হবে। কর্মমুখী প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষাব্যবস্থা চালু করতে হবে। এসএমই খাতের সুবিধা বাড়াতে হবে। এসব নিয়ে অনেক আগে থেকেই আলোচনা হচ্ছে। কিন্তু সমাধান করতে পারেনি কোনো সরকার।

Manual2 Ad Code

গত এক বছরে বিগত সরকারের সময়ের প্রভাবশালীদের বড় মাপের শতাধিক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এতে কাজ হারিয়েছেন এক লাখের বেশি শ্রমিক-কর্মচরী-কর্মকর্তা। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর এসব কারখানার মালিকদের আইনের আওতায় আনা হয়। এরই মধ্যে অনেকে গ্রেপ্তার হয়েছেন। অনেকে পরিবার নিয়ে আত্মগোপনে আছেন। সরকারি উদ্যোগে এসব কারখানা নতুনভাবে চালু করার চেষ্টা করা হচ্ছে। কয়েকটিতে প্রশাসক বসানো হলেও বাকিগুলো এখনো বন্ধ রয়েছে। প্রশাসকের কাছে কয়েকটি কারখানা পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়ার পরও বেশির ভাগ আগের মতো গতিশীল হয়নি। এখন বন্ধ কারখানা কবে নাগাদ চালু করা সম্ভব হবে তা অনিশ্চিত। তাই প্রভাবশালীদের কারখানার কাজ হারানো শ্রমিক-কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আবারও কবে কাজে ফিরবেন তার সময়সীমা জানাতে পারেননি কেউ।

সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেছেন, কেউ দুর্নীতিবাজ হলে তার বিচার হবে। কিন্তু প্রতিষ্ঠান বন্ধ করা যাবে না। কারণ মালিকের দুর্নীতির দায় তো কর্মকর্তা-কর্মচারী-শ্রমিকদের না। তারা কেন কাজ হারিয়ে বেকার হবেন? বেকারত্বের কারণে সমগ্র অর্থনীতি চাপে পড়ছে।

একই মত জানিয়ে বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘গত তিন বছরে ৩২৫টি কারখানা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এতে তিন লাখের বেশি শ্রমিক-কর্মকর্তা-কর্মচারী কাজ হারিয়েছেন। বেকারত্ব কমাতে হলে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে। শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে। বিনিয়োগ না হলে নতুন শিল্প গড়ে উঠবে না। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই দেশে অনেক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, হচ্ছে। এতে দেশে ব্যবসার খরচ দিন দিন বাড়ছে। এত খরচ করে কেউ বিনিয়োগে আগ্রহী হচ্ছেন না। রাজনৈতিক অস্থিরতা কমছে না। নির্বাচিত সরকার ছাড়া বিনিয়োগ বাড়বে না। ফলে বেকারত্বের বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব হবে না।’

হা-মীম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর সাবেক সভাপতি এ. কে. আজাদ বলেছেন, শিল্পায়নের গতি থমকে যাওয়ায় দেশে কমপক্ষে ১৪ লাখ মানুষ চাকরি হারিয়েছেন। এসব বেকার রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন, তাদের চাকরি নেই। প্রতিবছর ৩০ লাখ মানুষ নতুন করে চাকরিতে আসেন। এক লাখ ২০ হাজার লোক সরকারি-আধা সরকারি প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ পান, ৮ লাখ বিদেশে এবং ১০ লাখ বেসরকারি খাতে চাকরি পান। বাকিরা বেকার থাকেন।

Manual4 Ad Code

অর্থনীতির বিশ্লেষক ও শিল্প খাতের সংশ্লিষ্টরা বলেন, বেকার জনগোষ্ঠী দেশের অর্থনীতির জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকারকে এখনই বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান- দুই জায়গাতেই গুরুত্ব দিতে হবে বলে তারা জানিয়েছেন।

সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতার তুলনায় বৈদেশিক বিনিয়োগের পরিমাণ অনেক কম। আবার মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) তুলনায় দেশে বেসরকারি বিনিয়োগের হারও সুখকর নয়। দেশ একধরনের বিনিয়োগ ফাঁদের মধ্যে পড়ে রয়েছে। কর্মসংস্থান বৃদ্ধির জন্য বেসরকারি খাতকে উৎসাহিত করতে হবে। এর জন্য বিভিন্ন প্রণোদনা দিতে হবে। বিনিয়োগ পরিবেশ, অবকাঠামো বা অর্থায়নের অসুবিধা দূর করতে হবে।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সংজ্ঞা অনুযায়ী, ‘সপ্তাহে এক ঘণ্টা কাজ করে মজুরি পেলে তাকে বেকার হিসেবে ধরা হবে না। এক মাস ধরে কাজপ্রত্যাশী এবং সর্বশেষ এক সপ্তাহে কেউ যদি এক ঘণ্টা মজুরির বিনিময়ে কাজ করার সুযোগ না পান, তাদের বেকার হিসেবে গণ্য করা হবে। এটি আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সংজ্ঞা।’

এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে মুস্তফা কে. মুজেরী বলেন, ‘আইএলও এর সংজ্ঞা অনুযায়ী বাংলাদেশের বেকারের সংখ্যা ২৫ লাখের বেশি। কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তবতায় সপ্তাহে এক ঘণ্টা কাজ করে জীবনধারণ করা অসম্ভব। সে হিসেবে বাংলাদেশে বেকারের সংখ্যা আরও বেশি। আসলে গত এক যুগের বেশি সময় ধরে বেকারের সংখ্যা বাড়ছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত এক দশক ধরেই দেশে বেকারের সংখ্যা ২৫ থেকে ২৭ লাখের মধ্যে রয়েছে। দেশের বিভাগওয়ারি হিসেবে ঢাকা বিভাগের পর চট্টগ্রাম বিভাগে ৫ লাখ ৮৪ হাজার, রাজশাহীতে ৩ লাখ ৫৭ হাজার, খুলনায় ৩ লাখ ৩১ হাজার, সিলেটে ২ লাখ ১৬ হাজার, রংপুরে ২ লাখ ৬ হাজার, বরিশালে ১ লাখ ৩৯ হাজার এবং ময়মনসিংহ বিভাগে ১ লাখ ৪ হাজার বেকার আছেন। প্রায় এক কোটি আছেন ছদ্ম বেকার।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ‘যত বেকার আছে, তাদের মধ্যে সাড়ে ১৩ শতাংশ স্নাতক ডিগ্রিধারী। ৭ দশমিক ১৩ শতাংশ বেকার উচ্চমাধ্যমিক পাস করেছেন। প্রতি ৫ জন বেকারের ১ জন ব্যক্তি স্নাতক ডিগ্রিধারী কিংবা উচ্চমাধ্যমিক সনদধারী। ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সী তরুণদের মধ্যে বেকারের সংখ্যা প্রায় ২০ লাখ। বেকারের ৭৬ শতাংশের বয়স ১৫-২৯ বছর। এই বয়সী তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার ৮ শতাংশের বেশি।’

পলিসি এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান মাসরুর রিয়াজ বলেন, ‘বেকারত্ব বাড়া আমাদের দেশের অর্থনীতির জন্য সতর্কবার্তা। কর্মসংস্থানের দরজা বন্ধ থাকে, তখন আশা পরিণত হয় ক্ষোভ আর বিভ্রান্তিতে। এসব বেকার মানুষ সমাজের জন্য, পরিবারের জন্য বোঝা হয়ে পড়ে।’

Sharing is caring!

Manual1 Ad Code
Manual8 Ad Code