প্রকাশনার ১৬ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

৮ই ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
২৩শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
১৭ই জমাদিউস সানি, ১৪৪৭ হিজরি

নিচুমানের পাঠ্যবই এবারও

editor
প্রকাশিত ডিসেম্বর ৭, ২০২৫, ১২:১৪ অপরাহ্ণ
নিচুমানের পাঠ্যবই এবারও

Manual1 Ad Code

 

Manual2 Ad Code

# রিসাইকলড কাগজে ছাপা হচ্ছে

 

# বেশি অভিযোগ অগ্রণী ও কর্ণফুলী প্রিন্টিং প্রেসের বিরুদ্ধে

 

# ফেব্রুয়ারির আগে শেষ হবে না মাধ্যমিকের সব বইয়ের কাজ

 

# পিয়ন জাহাঙ্গীরের চক্র সক্রিয়

 

প্রজন্ম ডেস্ক:

Manual2 Ad Code

আগের বছরগুলোর মতো এ বছরও নিম্নমানের কাগজে ছাপা হচ্ছে পাঠ্যবই। কয়েকটি প্রেসের বিরুদ্ধে উঠেছে রিসাইকলড কাগজে বই ছাপার অভিযোগ। মানদণ্ড অনুযায়ী এতে কাগজের জিএসএম ও ব্রাইটনেস পাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু মানের ব্যাপারে কঠোর হতে গেলে বাধার মুখে পড়তে হচ্ছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) এবং ইন্সপেকশন এজেন্টের কর্মকর্তাদের। এমনকি কর্মকর্তাদের ভয়ভীতিও দেখানো হচ্ছে।

২০২৬ শিক্ষাবর্ষের জন্য প্রায় ৩০ কোটি বই ছাপার কাজ চলছে। এর মধ্যে রয়েছে প্রাথমিকের ৯ কোটি বই এবং মাধ্যমিক ও ইবতেদায়ির জন্য ২১ কোটি বই। মোট বইয়ের এক-দশমাংশের বেশি কাজ পেয়েছে চারটি প্রেস।

Manual5 Ad Code

সেগুলো হলো—অগ্রণী প্রিন্টিং প্রেস, কর্ণফুলী প্রিন্টিং প্রেস, কচুয়া ও আনোয়ারা প্রিন্টিং প্রেস। এই প্রেসগুলোর মালিক পরস্পর দুই ভাই ও ভগ্নিপতি। তাঁরা ২০০ কোটি টাকার বেশি পাঠ্যবই ছাপার কাজ পেয়েছেন। বইয়ের সংখ্যা তিন কোটির বেশি।

এনসিটিবির অনুরোধ ছিল কার্যাদেশ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চুক্তি সম্পন্ন করে প্রেসগুলো যেন বই ছাপার কাজ শুরু করে। কিন্তু এই চারটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দুটি সময়ক্ষেপণ করে একেবারে শেষ সময় গত ৪ ডিসেম্বর সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির বই ছাপার চুক্তি করে। ফলে এসব বই ছাপা শেষ করতে আগামী ফেব্রুয়ারি-মার্চ পর্যন্ত লেগে যাবে। আর ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে যেহেতু জাতীয় নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করতে হবে, ফলে প্রেসগুলো মনে করছে এই সময় নিম্নমানের বই সরবরাহ শুরু করলে এ নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলবে না।

এনসিটিবির মানদণ্ড অনুযায়ী, এবার প্রাথমিক ও ইবতেদায়ির বইয়ে ৮০ জিএসএম ও ৮৫ ব্রাইটনেস থাকতে হবে। এই বইগুলোর সব চার রঙের। অন্যদিকে মাধ্যমিকের বইয়ে ৭০ জিএসএম ও ৮৫ ব্রাইটনেস থাকার কথা রয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের চাপে প্রাথমিকের বইগুলো মোটামুটি মানসম্পন্ন হলেও ইবতেদায়ি ও মাধ্যমিকের বইয়ে দেওয়া হচ্ছে নিম্নমানের কাগজ। অভিযোগের তীর সেই অগ্রণী, কর্ণফুলীসহ চারটি প্রিন্টিং প্রেসের বিরুদ্ধে।

এনসিটিবির সচিব অধ্যাপক মো. সাহতাব উদ্দিন বলেন, ‘আমরা যেখানেই সমস্যা পাচ্ছি সেখানেই ব্যবস্থা নিচ্ছি। আমাদের একাধিক টিম, মন্ত্রণালয়ের টিম ও ইন্সপেকশন এজেন্ট সবাই কাজ করছে। এর পরও আমরা যে শতভাগ সফল হব সেটা বলতে পারছি না। তবে আপনাদের কাছে যদি নিম্নমানের কাগজ ব্যবহারের তথ্য থাকে তাহলে আমাদের জানাবেন। আমরা অবশ্যই ব্যবস্থা নেব।’

জানা গেছে, এনসিটিবির চাহিদা অনুযায়ী কাগজের বর্তমান বাজারদর প্রতি টন প্রায় এক লাখ ১৫ হাজার টাকা। কিন্তু অগ্রণী ও কর্ণফুলী প্রেস ‘ম’ এবং ‘র’ আদ্যক্ষরের দুটি মিল থেকে প্রতি টন কাগজ ৯০ হাজার টাকায় কিনছে। এই কাগজে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ ভার্জিন পাল্প এবং ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ রিসাইকলড কাগজ রয়েছে। প্রেস দুটি ইবতেদায়ির জন্য যেসব বই এরই মধ্যে সরবরাহ করেছে, সেগুলো ৮০ জিএসএমের বদলে পাওয়া যাচ্ছে ৬৫ থেকে ৭০ জিএসএম। ব্রাইটনেসও ৮০-এর বেশি উঠছে না। অন্যদিকে মাধ্যমিকের জন্য যেসব বই প্রস্তুত করা হয়েছে সেগুলোতে ৭০ জিএসএমের পরিবর্তে পাওয়া যাচ্ছে ৬০ থেকে ৬৩ জিএসএম।

সূত্র মতে, ইবতেদায়ির চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির ২০৩২, ২০৩৪ ও ২০৩৫ লটের প্রায় ২০ লাখ বই ছাপার কাজ পায় অগ্রণী প্রেস। ২০৩২ লটের বই যায় ঝালকাঠি, বরিশাল ও ভোলা জেলার ২১টি উপজেলায়। আর ২০৩৪ লটের বই যায় চট্টগ্রাম জেলার ২২টি উপজেলায়। অন্যদিকে কর্ণফুলী প্রেস ইবতেদায়ির চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির ২০২৮ ও ২০৩১ লটের ১৫ লাখ বই ছাপার কাজ পায়। ২০২৮ লটের বই যায় গাজীপুর, শরীয়তপুর, মানিকগঞ্জ, রাজবাড়ী, মাদারীপুর ও ফরিদপুর জেলার ৪১টি উপজেলায়। আর ২০৩১ লটের বই যায় কিশোরগঞ্জ, শেরপুর, জামালপুর ও নেত্রোকোনা জেলার ৩৬টি উপজেলায়। এসব বইয়ে ৮০ জিএসএমের পরিবর্তে ৬৫ জিএসএমের কাগজ ব্যবহার করা হয়েছে।

জানা যায়, অগ্রণী ও কর্ণফুলী প্রেস নোয়াখালীতে হওয়ায় সেখানে গিয়ে এনসিটিবি ও ইন্সপেকশন এজেন্টের কর্মকর্তারা হুমকির মুখে পড়েন। এই প্রেস দুটি ভালোমানের কিছু কাগজ কিনে রেখেছে। ইন্সপেকশনে গেলে ওই কাগজ থেকে স্যাম্পল নিতে বাধ্য করা হচ্ছে।

সম্প্রতি এনসিটিবির একজন কর্মকর্তা প্রেস দুটি পরিদর্শনে গিয়ে সেখান থেকে নিম্নমানের কাগজের স্যাম্পল সংগ্রহ করেন। তিনি যখন ফিরে আসছিলেন তখন নোয়াখালীতেই তাঁর ব্যাগ কেড়ে নেয় কিছু লোক। ওই ব্যাগেই কাগজের স্যাম্পল ও কিছু কাগজপত্র ছিল। এরপর এনসিটিবির অন্য কর্মকর্তারা ওই দুটি প্রেস পরিদর্শনে যেতে অনীহা প্রকাশ করছেন।

মাধ্যমিকের ইন্সপেকশন এজেন্ট কন্ট্রোল ইউনিয়ন বিডির প্রজেক্ট হেড রাফি মাহমুদ বিপ্লব বলেন, ‘এত দিন মূলত প্রাথমিকের কাজ হয়েছে। এখন মাধ্যমিক ও ইবতেদায়ির কাজ চলছে। আমরা মানের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের আপস করছি না। কিন্তু কাগজের বর্তমান বাজারদর যেখানে এক লাখ ১৫ হাজার টাকা, সেখানে কেউ যদি ৯০ হাজার টাকার কাগজ ব্যবহার করে, তার বইয়ের মান তো খারাপ হবেই। তবে নিম্নমানের কোনো বই ধরা পড়লে আমরা সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেব।’

সূত্র বলছে, এনসিটিবির অ্যাকাউন্টস এবং পাঠ্যপুস্তক শাখার কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন যাঁরা নিম্নমানের বই ছাপা সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত। তাঁরা ওই দুটি প্রেসের পক্ষে কাজ করেন। নিম্নমানের বইয়ের ক্ষেত্রেও ভালো রিপোর্ট দিতে বাধ্য করেন। এমনকি তাঁরা একজন রাজনৈতিক নেতার কথা বলে ভয়ভীতিও দেখান।

প্রেস দুটির বিরুদ্ধে প্রাথমিকেও নিম্নমানের বই দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। গত ৮ অক্টোবর হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা এস এম জাকিরুল হাসান প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর ও এনসিটিবিতে একটি চিঠি পাঠান। সেখানে তিনি বলেন, ‘গত ৭ অক্টোবর অগ্রণী প্রিন্টিং প্রেস থেকে প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণির সাত হাজার ওয়ার্ক বুক (আমার বই) ও সাত হাজার এক্সারসাইজ বুক (খাতা) সরবরাহের জন্য উপজেলা শিক্ষা অফিস, মাধবপুর, হবিগঞ্জে আনা হয়। যার চালান নম্বর ১০১১১৯০৫, আইডি নম্বর ১১১১২৮৬ ও লট নম্বর ১১৯। সরবরাহ করা বইগুলো বুঝে নিতে গেলে নিম্নমানের বলে প্রতীয়মান হয়। পরে সেসব বই ওই উপজেলা থেকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। এ ছাড়া সম্প্রতি নিম্নমানের বই ধরা পড়ায় আনোয়ারা ও কচুয়া প্রেসের নবম শ্রেণির ছাপানো বই কেটে দেয় এনসিটিবি।

জানা গেছে, নিম্নমানের পাঠ্যবই ছাপার যাত্রা শুরু হয় অগ্রণী ও কর্ণফুলী প্রেসের হাত ধরে। অগ্রণী প্রেসের মালিক কাউসার-উজ-জামান রুবেল ও কর্ণফুলী প্রেসের মালিক হাসান-উজ-জামান রবিন আপন দুই ভাই। তাঁদের ভগ্নিপতি এস এম হুমায়ুন কচুয়া ও আনোয়ারা প্রেসের মালিক। তাঁরা মূলত ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পিয়ন জাহাঙ্গীরের প্রত্যক্ষ মদদে নিম্নমানের বই ছাপা শুরু করেন। পরে সেখান থেকে ভাগ বসান সাবেক শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি ও মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। গত আট বছরে এই প্রতিষ্ঠানগুলো অন্তত দুই ৪০০ কোটি টাকার বই ছাপার কাজ করেছে। নিম্নমানের ছাপা বই সরবরাহ করে এই টাকার অর্ধেকই লোপাট করেছে চক্রটি।

নিম্নমানের বইয়ের ব্যাপারে বক্তব্য জানতে গতকাল কর্ণফুলী প্রেসের মালিক হাসান-উজ-জামান বলেন, ‘আমরা স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী কাগজে পাঠ্যবই ছাপছি। এ ছাড়া বই ছাপার আগে কাগজের টেস্ট হয়। সেখানেও কাগজের মানে কোনো সমস্যা পাওয়া যায়নি।’

Manual4 Ad Code

কচুয়া ও আনোয়ারা প্রেসের মালিক এস এম হুমায়ুন বলেন, ‘আমরা সঠিক মানের কাগজেই বই ছাপছি।’

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কাগজের জিএসএম কম দিলে তা শিক্ষার্থীদের পক্ষে এক বছর পড়া কষ্টকর হবে। বিশেষ করে ৬০ জিএসএমের কাগজ ছয় মাস পর ছিঁড়ে যায়। অন্যদিকে ব্রাইটনেস কম হলে শিক্ষার্থীদের চোখের ওপর চাপ পড়ে। এতে চোখের নানা ধরনের সমস্যা তৈরি হয়। ফলে জিএসএম ও ব্রাইটনেসের ক্ষেত্রে এনসিটিবির মানদণ্ডের বাইরে যাওয়া কোনোভাবেই ঠিক নয়।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ২০২৫ শিক্ষাবর্ষে ওই দুটি প্রেসের ৮০ শতাংশ ছাপা বই-ই ছিল নিম্নমানের। কিন্তু বই সরবরাহের পর এনসিটিবি তদন্ত শুরু করলেও অজ্ঞাত কারণে তা থেমে যায়। ফলে তাঁরা পার পেয়ে যান। ফলে ২০২৬ শিক্ষাবর্ষের বইয়ের ক্ষেত্রে এখনই ব্যবস্থা না নিলে এ বছরও তাঁরা পার পেয়ে যাবেন।

বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতির সাবেক সভাপতি তোফায়েল খান বলেন, ‘প্রাথমিকের বই ছাপা আগের চেয়ে ভালো হয়েছে। তবে এখন মাধ্যমিক ও ইবতেদায়ির বই ছাপার কাজ চলছে। যেসব মিল খারাপ কাগজ তৈরি করে সেখান থেকে কয়েকটি প্রেস কাগজ কিনছে বলে আমরা জেনেছি। ওই প্রেসগুলো আগেও নিম্নমানের বই সরবরাহ করেছে। কিন্তু কোনো শাস্তি না হওয়ায় তারা আবারও একই কাজ করছে। মান নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও এনসিটিবির। তাদের এ ব্যাপারে কঠোর হওয়া উচিত। যারা নিম্নমানের বই সরবরাহ করবে তাদের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।’

Sharing is caring!

Manual1 Ad Code
Manual2 Ad Code