প্রজন্ম ডেস্ক:
গ্রাম থেকে শহর- সবখানেই প্রতারক চক্রের খপ্পরে পড়ে নিঃস্ব আর নির্যাতিত হওয়ার গল্প এক। বিদেশে যাওয়ার স্বপ্নে বিভোর তরুণেরা দালালচক্রের কাছে নিজেদের ভবিষ্যৎ সমর্পণ করছেন। ইউরোপে পৌঁছালে সংসার বদলে যাবে; এ আশায় কেউ জমি বন্ধক রাখছেন, কেউ ঋণ নিচ্ছেন, কেউ মায়ের গয়না বিক্রি করে দালালকে দিচ্ছেন লাখ লাখ টাকা। কিন্তু স্বপ্নের ইউরোপ আর বাস্তবের মধ্যে রয়েছে মৃত্যুঝুঁকির এক অন্ধকার সুড়ঙ্গ। আর সেই সুড়ঙ্গের রূপকার মানব পাচারকারী চক্র। এরা নানান ছুতায় দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে যুবকদের বিদেশে চাকরি প্রলোভন দেখিয়ে হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা। শত চেষ্টাতেও থামানো যাচ্ছে না এই দালালচক্রের দৌরাত্ম্য। ফলে বাংলাদেশ থেকেও বন্ধ হচ্ছে না মানব পাচার।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সাগরপথে ইউরোপে যাওয়ার অবৈধ প্রবণতা আরও বেড়েছে। মানব পাচারকারীদের অমানবিকতা, লিবিয়ার ‘টর্চার ক্যাম্প’, মরক্কোর উপকূলে নৌকাডুবি এতকিছুর পরও যুবকেরা দালালের আশ্বাসে পথে নামছেন। এতে বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যা, দীর্ঘ হচ্ছে নিখোঁজের তালিকা।
মাদারীপুরের শিবচরের ২৪ বছরের সোহান (ছদ্মনাম) গত মার্চে ইউরোপযাত্রার স্বপ্নে লিবিয়ার উদ্দেশে রওনা হন। দালালের আশ্বাস ছিল, ইতালিতে পৌঁছার ছয় মাসের মধ্যেই ভাগ্য বদলে যাবে। সোহানের পরিবার নানা জায়গা থেকে ঋণ নিয়ে দালালের হাতে তুলে দেয় প্রায় ৮ লাখ ৫০ হাজার টাকা। কিন্তু সোহান লিবিয়ায় পৌঁছার পরই শুরু হয় বিপদ। সেখানে তাকে আটকে ফেলা হয় একটি পরিত্যক্ত ভবনে। দাবি করা হয় আরও ২-৩ লাখ টাকা। এ সময়ে প্রতিদিনই চলতে থাকে মারধর, নির্যাতন, ক্ষুধার কষ্ট দেওয়া। এরপর এক রাতে সোহানসহ প্রায় ১০০ জনকে তুলে দেওয়া হয় একটি ছোট নৌকায়। পরদিন সকালে সোহানের পরিবার খবর পায় মধ্য সমুদ্রে নৌকাডুবি হয়েছে। এখনো সোহানের খোঁজ মেলেনি। শুধু সোহান নয়, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নোয়াখালী, মাদারীপুর, কক্সবাজারসহ দেশের বহু জেলা থেকে এমন অনেক যুবক দালালদের ফাঁদে পড়ে জীবন হারাচ্ছেন।
সবচেয়ে বেশি মৃত্যু ভূমধ্যসাগরে
আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার তথ্যানুযায়ী, ২০২৪ সালে ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবিতে প্রাণ হারিয়েছেন প্রায় ৩ হাজার মানুষ। যাদের উল্লেখযোগ্য অংশই দক্ষিণ এশিয়ার নাগরিক। এ তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশও। ভাগ্য বদলাতে লিবিয়া হয়ে ভূমধ্যসাগরের বিপজ্জনক পথে বাংলাদেশি তরুণদের এই আত্মহনন নতুন নয়। গত বছরের ডিসেম্বরে নৌকা ডুবে ৮ বাংলাদেশির সলিল সমাধি হয়। অন্যদিকে ২০১৪-২০২৪ এই ১০ বছরে প্রায় ৩০ হাজার মানুষ ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপ যাত্রার পথে মারা গেছেন বা নিখোঁজ হয়েছেন। যাদের মধ্যে রয়েছেন অন্তত ২৮৩ জন বাংলাদেশি। ইউরোপযাত্রার সবচেয়ে বিপজ্জনক রুটগুলোর একটি ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেওয়া। এ ছাড়া লিবিয়ায় অভিবাসী ও শরণার্থীদের আটকে নির্যাতন, মুক্তিপণ আদায়, হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনাও নিয়মিত।
উল্লেখ্য, ২০১১ সালে মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম সমৃদ্ধ দেশ লিবিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা জোটের হস্তক্ষেপে মুয়াম্মার গাদ্দাফির পতন হলে দেশটি দারিদ্র্য ও গৃহযুদ্ধে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। একই সঙ্গে লিবিয়া হয়ে ওঠে বিশ্বের সংঘাতকবলিত ও দারিদ্র্যপীড়িত দেশগুলো থেকে ইউরোপমুখী অভিবাসী ও আশ্রয়প্রার্থীদের অন্যতম ট্রানজিট রুট। লিবিয়ার উপকূল থেকে ইতালির ল্যাম্পেদুসার দিকে যাত্রা করা নৌকাগুলো সাধারণত ছোট, ইঞ্জিনচালিত কাঠের বা রাবার নৌকা। সামান্য ঢেউ উঠলেই এগুলো নিয়ন্ত্রণ হারায়। অনেক নৌকায় লাইফ জ্যাকেট থাকে না, থাকে না নেভিগেশন যন্ত্র বা পর্যাপ্ত খাবার পানি। মাঝসমুদ্রে ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে গেলে নৌকাগুলো হয়ে ওঠে মৃত্যুকূপ।
দেশি-বিদেশি সিন্ডিকেটের অদৃশ্য নেটওয়ার্ক
মানব পাচার চক্র বহুস্তরবিশিষ্ট একটি আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক। বাংলাদেশে ‘লোয়ার লেভেল’ দালালরা সাধারণত গ্রামের পরিচিত ব্যক্তি। তাদের কাজ যুবকদের প্রলুব্ধ করা, টাকা নেওয়া এবং তাদের ঢাকায় বা চট্টগ্রামে পৌঁছে দেওয়া। ঢাকায় রয়েছে- ‘মিড লেভেল’ নেটওয়ার্ক। কামরাঙ্গীরচর, জুরাইন, মিরপুর, সায়েদাবাদ, নারায়ণগঞ্জ এসব অঞ্চলে দালালরা ভিসা, নথি, পাসপোর্ট, টিকিটের ব্যবস্থাসহ ‘প্যাকেজ’ পরিচালনা করে। এদের অনেকেই দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে এই চক্রের কেউ কেউ ধরা পড়লেও মূল গডফাদাররা অধরাই রয়ে যায়। মানব পাচারকারীদের লিবিয়া-মরক্কোতে রয়েছে সবচেয়ে ভয়ংকর চক্র। এদের পরিচালিত টর্চার ক্যাম্পে বাংলাদেশিসহ বিভিন্ন দেশের যুবকদের আটকে রেখে নির্যাতন করে আরও টাকা আদায় করা হয়। মানবাধিকার সংস্থার মতে, এই ক্যাম্পগুলো আধুনিক দাসশালা।
মানব পাচার যেন কমছে না
উচ্চ শিক্ষার ডিগ্রি আছে কিন্তু কাজ নেই। তাই বেকারত্বের বোঝা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, এমন অসংখ্য তরুণের কাছে বিদেশে যাওয়া যেন একমাত্র পথ। শুধু তাই নয়, থাকতে পারে মহাজনী ঋণ, পারিবারিক দায়, ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা। তারপরও তারা যেকোনো ঝুঁকি নিতে রাজি। অন্যদিকে বিদেশ সাফল্যের গল্পের জন্য ঝুঁকি জেনেও তাদের অনেকেই যেতে চান। কারণ এক-দুজন প্রবাসী বাড়ি বানালে সেই গল্প গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে। তারপর দালালরা এটাকেই হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। এ ছাড়াও মালয়েশিয়া বা সৌদি আরবে শ্রমভিসার প্রক্রিয়া জটিল হওয়ায় অনেকে শর্টকাটে ইউরোপ যাওয়ার পথ খোঁজেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দালালচক্রের প্রভাবশালীরা একই ছাতার নিচে কাজ করে। এদের অনেকে স্থানীয় প্রভাবশালীদের ছত্রছায়া পায়। কেউ কেউ বিদেশে বসে পরিচালনা করে পুরো নেটওয়ার্ক, ফলে তাদের ধরাই দুষ্কর। পাচারকারীরা হুমকি দেয়, মামলা করলে ছেলের খবরই পাবেন না। তাই অনেকে চুপ থাকেন।
কথায় সরকারি উদ্যোগ কঠোর, কাজে দুর্বল
মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন-২০১২ এ পাচারে জড়িতদের জন্য মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত সাজা রাখা হয়েছে। পুলিশ, র্যাব, ডিবি, কোস্ট গার্ড নিয়মিত অভিযানও চালায়। কিন্তু বাস্তবে সাফল্য সীমিত। কারণ এক্ষেত্রে রয়েছে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা। প্রথমত মামলার বিচারপ্রক্রিয়া দীর্ঘ হওয়ায় অপরাধীরা অনেক সময় জামিনে বেরিয়ে আবার একই অপরাধে জড়ায়। বিদেশে আটক বাংলাদেশিদের সুরক্ষাও দুর্বল। ফলে বিদেশে আটক থাকা যুবকদের উদ্ধারে প্রক্রিয়াতেও দেখা যায় ধীরগতি। তা ছাড়া দালালদের বিরুদ্ধে স্থানীয় প্রশাসনের নেই কঠোর নজরদারি। অভিযোগ রয়েছে, প্রশাসনের একশ্রেণির কর্তাব্যক্তির সঙ্গে যোগসাজশে অনেকেই বছরের পর বছর এলাকায় থেকে মানব পাচার করছে। অথচ তারা পুলিশের নজর এড়ায় কীভাবে তা নিয়েও রয়েছে নানান প্রশ্ন।
স্বপ্ন নয়, বাঁচাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ
মানুষ স্বপ্ন দেখবে, এটাই স্বাভাবিক। বিদেশে গিয়ে কাজ করে পরিবারকে সুখে রাখার আকাঙ্ক্ষা ভুল নয়। ভুল হলো সেই স্বপ্নকে কাজে লাগিয়ে যারা নিরপরাধ তরুণদের ঠেলে দিচ্ছে মৃত্যুর পথে। দিন দিন দীর্ঘ হচ্ছে নিখোঁজের তালিকা, বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যা, আর নৌকার তলিয়ে যাওয়ার সঙ্গে তলিয়ে যাচ্ছে শত শত পরিবার। তাই সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মানব পাচার রোধে এখনই সমন্বিত উদ্যোগ জরুরি। সরকার, পরিবার, প্রশাসন, স্থানীয় সমাজ, আন্তর্জাতিক সংস্থা সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। নইলে ইউরোপে যাওয়ার স্বপ্নের গল্প লিখতে গিয়ে আরও কত মা-বাবাকে শুকনো চোখে সন্তান হারানোর কান্না আটকাতে হবে তার হিসাব থাকবে না।
এ বিষয়ে অভিবাসন-বিষয়ক গবেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. ওবায়দুল হক বলেন, ‘মানব পাচার একটি বৈশ্বিক অপরাধ। শুধু দালাল ধরলেই সমস্যার সমাধান হবে না। গ্রামের যুবকদের কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়াতে হবে। পরিবারগুলোকে সচেতন করতে হবে। বৈধ অভিবাসন প্রক্রিয়া সহজ করতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘ইউরোপের দেশগুলো তাদের সীমান্ত নিয়ন্ত্রণে আরও কঠোর হচ্ছে। ফলে অবৈধভাবে গেলে মৃত্যুঝুঁকি বাড়বে। তাই রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা বাড়ানো জরুরি। বিশেষত লিবিয়া ও ভূমধ্যসাগর সংলগ্ন দেশগুলোতে।’
Sharing is caring!