প্রজন্ম ডেস্ক:
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার কয়েক দিন বাকি। নির্বাচন কমিশন বলেছে, ৮ থেকে ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে তফসিল ঘোষণা করা হবে। ঘোষণার আগমুহূর্তে দেশের রাজনীতিতে দেখা দিয়েছে নতুন সমীকরণ। জোটগঠনে বড় দলগুলো বেশ তৎপর, ছোট দলগুলোও পিছিয়ে নেই।
রাজনৈতিক মাঠের বড় শক্তি বিএনপি ইতিমধ্যে দুই দফায় ২৭২টি আসনে প্রার্থী ঘোষণা করেছে। ২৮টি আসন বাকি রেখে যুগপৎ আন্দোলনের শরিকদের ক্ষোভ প্রশমনের চেষ্টা করলেও উল্টো সমালোচনার মুখে পড়তে হচ্ছে দলটিকে। শরিক জোট-নেতাদের কারও কারও আসনে বিএনপি প্রার্থী দেওয়ায় তাদের অসন্তোষ চরমে পৌঁছেছে। অনেকেই প্রকাশ্যে ক্ষোভ ঝেড়ে বলছেন, পরামর্শ না করে নেওয়া এ সিদ্ধান্ত ঐক্যের পথকে সংকীর্ণ করে দিচ্ছে।
ইসলামী রাজনৈতিক বলয়ের চিত্রটিও একই রকম। জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বে আটদলীয় ইসলামী জোট গঠিত হলেও আসন বণ্টন নিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানো যায়নি। জামায়াত ৩০০ আসনেই প্রার্থী চূড়ান্ত করে প্রচার শুরু করায় জোটসঙ্গীদের সঙ্গে সমঝোতার পথ সংকুচিত হয়েছে। এর মধ্যেই গত রবিবার তিন দলের সমন্বয়ে আত্মপ্রকাশ করেছে ‘গণতান্ত্রিক সংস্কার জোট’। এতে রয়েছে এবি পার্টি, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। গতকাল সোমবার আনিসুল ইসলাম মাহমুদের জাতীয় পার্টি (একাংশ) ও আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর নেতৃত্বাধীন জেপির উদ্যোগে গঠিত হয়েছে ২০ দলের নতুন জোট জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট (এনডিএফ)।
এই জোটের অন্য দলগুলো হলো জনতা পার্টি বাংলাদেশ, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি, তৃণমূল বিএনপি, বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তিজোট, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন (বিএনএম), বাংলাদেশ মুসলিম লীগ, জাতীয় ইসলামিক মহাজোট, জাতীয় সংস্কার জোট, বাংলাদেশ লেবার পার্টি (একাংশ), জাতীয় স্বাধীনতা পার্টি, বাংলাদেশ মানবাধিকার পার্টি, বাংলাদেশ সর্বজনীন দল, বাংলাদেশ জনকল্যাণ পার্টি, অ্যাপ্লায়েড ডেমোক্রেটিক পার্টি, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক আন্দোলন, ডেমোক্রেটিক পার্টি, বাংলাদেশ জাতীয় লীগ। জোট গঠনের এ তৎপরতা রাজনৈতিক অঙ্গনে বেশ আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
বামপন্থি দলগুলোও নিজেদের অবস্থান রক্ষায় নতুন জোট গঠনের চেষ্টা চালাচ্ছে। বাম গণতান্ত্রিক জোট তাদের পরিধি বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে। রাজনৈতিক অবস্থান ধরে রাখা ও সংগঠনের ভবিষ্যৎ টিকিয়ে রাখাই তাদের মূল লক্ষ্য।
রবিবার ইসির দশম সভা শেষে নির্বাচন কমিশনার আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ জানিয়েছেন, চলতি সপ্তাহের (৮ থেকে ১৫ ডিসেম্বর) যেকোনো দিন তফসিল ঘোষণা করা হবে। এর আগে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করা হবে।’
নির্বাচনের আগে আগে এ নতুন জোটগুলোর উদ্দেশ্য কী? জোটের সংখ্যা বাড়লেও এদের প্রভাব ও কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। ভোটের মাঠে এসব জোট কতটুকু ভূমিকা রাখতে পারবে তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করছেন বিশ্লেষকরা। যদিও সদ্য গড়া জোট নেতারা বলছেন, ভোটের রাজনীতিতে প্রভাব কম হলেও জোটের রাজনৈতিক তাৎপর্য গভীর।
তাদের মতে, বিএনপির ও জামায়াতের জোটের বাইরে থেকে যারা সংস্কারপন্থি ও গণতান্ত্রিক রাজনীতি করতে চায়, তাদের জন্য একটি নতুন প্ল্যাটফর্ম গঠনের প্রয়োজনীয়তা ছিল। এটা রাজনৈতিক পরিবর্তনের আকাক্সক্ষা থেকেই তৈরি হচ্ছে। এ কারণে গত দুদিনে দুটি নতুন জোট আত্মপ্রকাশ করেছে, তা রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন গতির সঞ্চার করেছে।
জোটগুলোর নেতাদের বক্তব্য হলো, এসব বর্তমান নেতাদের অবস্থান এবং ভবিষ্যতে বিকল্প শক্তি হয়ে ওঠার একটা চেষ্টা। বড় দুই জোটের বাইরে দাঁড়িয়ে ভোটারদের কাছে নতুন বার্তা পৌঁছানোর প্ল্যাটফর্ম। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, সাম্প্রতিককালের অস্থির রাজনীতিতে ছোট দলগুলোর মধ্যে টিকে থাকার চাপ বাড়ায় জোটবদ্ধ হওয়াই এখন সবচেয়ে বড় কৌশল।
জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্টে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে দুই ডজনের বেশি দল। আঞ্চলিক, ধর্মভিত্তিক, নীতিনির্ধারক অবস্থান কিংবা দীর্ঘ রাজনৈতিক প্রভাব না থাকা দলগুলো একত্রিত হওয়ার চেষ্টা করছে। এনসিপি-এবি পার্টি-রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের জোটটি তরুণ ভোটার ও অনিশ্চিত ভোটব্যাংক টার্গেট করে নিজেদের অবস্থান তৈরি করতে চায়।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, বড় দুই শক্তির প্রতি অনীহা এবং নেতৃত্বে নতুনতার আকাক্সক্ষা থেকেই এ জোটগুলোর উত্থান। জাতীয় রাজনীতিতে ‘মধ্যম শক্তি’ গড়ে তোলারও আগ্রহ আছে এদের। নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার, আসন বণ্টনে দর-কষাকষি এবং আলোচনার টেবিলে নিজের অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ করে তোলাই তাদের মূল লক্ষ্য।
বড় দুই রাজনৈতিক শক্তিও নীরবে নিজেদের জোট ও মিত্রদের পুনর্গঠনে ব্যস্ত। স্থানীয় পর্যায়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগ জোরদার করছে তারা। একাধিক আসনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ও চাপের রাজনীতি নতুন সমঝোতার পথ খুঁজতে বাধ্য করছে তাদের।
আগামী নির্বাচন শুধু ক্ষমতার পালাবদলের লড়াই নয়, বিভিন্ন শক্তি ও প্ল্যাটফর্মের নতুন অবস্থান নির্ধারণের উপলক্ষও বটে। কোন জোট কতটা টিকবে, কোন দল কোন শিবিরে যাবে আর কারা শেষ সময়ে চমক দেখাবে এসবই আগামীর রাজনৈতিক সমীকরণ নির্ধারণ করবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘নির্বাচন করাটাই কিন্তু এবার সংকট থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ নয়। নির্বাচনের পরও দেশকে স্থিতিশীল রাখা, দেশের উন্নয়ন অগ্রগতি ধরে রাখা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। নির্বাচনমুখী দলগুলো সবাই আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে। আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে বাইরে রাখার ব্যাপারে এ দলগুলোর একটা মতৈক্য আছে। আমরা তাদের সঙ্গে নিয়েই ইলেকশন করব, জাতীয় সরকার গঠন করব, আপার হাউজ (জাতীয় সংসদের উচ্চকক্ষ) করব এ প্রতিশ্রুতি আছে।’
তিনি বলেন, ‘জোটবদ্ধভাবে রাজনীতি করা দলগুলোর একান্তই নিজস্ব ব্যাপার। তবে আমরা আগেই ঘোষণা করেছি, আমরা ন্যাশনাল গভর্নমেন্ট করব। আমরা বলিনি যে, বিএনপি গভর্নমেন্ট হবে। এটা আমাদের ৩১ দফার মধ্যে আছে।’
আনিসুল ইসলাম মাহমুদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘বাংলাদেশের প্রকৃত গণতান্ত্রিক রূপান্তর, বিরাজমান রাজনৈতিক সংকট উত্তরণে জাতীয় ঐকমত্য সৃষ্টি, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং চব্বিশের জুলাই গণঅভ্যুত্থানের আকাক্সক্ষার সমন্বয়ে আগামী দিনের রাষ্ট্র সংস্কার, বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ, মধ্যপন্থার উদার গণতান্ত্রিক রাজনীতি বেগবান করা, ইসলামি মূল্যবোধ এবং সর্বধর্ম সম্প্রীতিতে বিশ্বাসী, স্বাধীন বিচারব্যবস্থা প্রবর্তন, ফ্যাসিবাদের চির অবসান এবং সুশাসনকামী জনগণের কণ্ঠস্বরকে সোচ্চার করতে রাজনৈতিক জোট গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, ‘নির্বাচনের আগে গঠিত এসব জোটের ভোটের মাঠে ইম্প্যাক্ট কম হলেও বেশ রাজনৈতিক গুরুত্ব রয়েছে। এটা দলগুলোকে জনবান্ধব এবং সংস্কারপন্থি, গণতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করবে। জোটগুলো ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ, জুলাই সনদে যে প্রস্তাবগুলো আছে তার বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।’
এনসিপির কেন্দ্রীয় যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক এবং নির্বাচনকালীন মিডিয়া উপকমিটির সাধারণ সম্পাদক খান মুহাম্মদ মুরসালীন বলেন, ‘গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্ব ছিল বিচ্ছিন্ন তরুণদের হাতে। সেখান থেকেই এসেছে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের দাবি। সেই বাস্তবতার প্রতিফলনই নতুন জোট গঠনের চেষ্টা। গণঅভ্যুত্থানের রাষ্ট্র সংস্কার, বিচার ও পুনর্গঠনের দাবি নিয়েই এনসিপি এগিয়ে যাচ্ছে। সেই যাত্রাকে গতিশীল করতে এ গণতান্ত্রিক সংস্কার জোট গঠন করা হয়েছে।’
তিনি আরও জানান, জোট গঠনের আরেকটি লক্ষ্য হচ্ছে নির্বাচনের পর যেই ক্ষমতায় আসুক, গণঅভ্যুত্থানের যে স্পিড, তা যেন বজায় থাকে, তার প্রেশার গ্রুপ হিসেবে কাজ করা।
সম্প্রতি জোটবদ্ধ হওয়া আরেক নেতা বলেন, জোট-রাজনীতি দলগুলোকে জনবান্ধব, গণতান্ত্রিক এবং সংস্কারমুখী সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করবে।
রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার আগমুহূর্তে জোট সমীকরণ, অসন্তোষ, দাবিদাওয়া আর কৌশলগত হিসাব-নিকাশে উত্তেজনা আরও ছড়িয়ে পড়বে রাজনৈতিক অঙ্গনে। প্রধান দলগুলো থেকে শুরু করে ক্ষুদ্র রাজনৈতিক সংগঠন সবাই নিজেদের অস্তিত্ব, অবস্থান ও প্রভাব টিকিয়ে রাখতে মরিয়া হবে। তবে প্রশ্ন হচ্ছে, এত জোটচর্চা, এত সমীকরণ শেষ পর্যন্ত ভোটের রাজনীতিতে কতটুকু প্রভাব ফেলবে? নাকি তফসিল ঘোষণার পরই আবার নতুন সমীকরণে সব ভেঙে পড়বে?’
তার মতে, জোটের রাজনীতি বাংলাদেশে বিশেষ করে উপমহাদেশে নতুন নয়। এখন যারা ছোট জোট করছেন, দেখা যাবে জাতীয় নির্বাচনের আগের দিনও বড় দল বা জোটের সঙ্গে তারা বোঝাপড়া করে নেবে। জোটের প্রকৃত রাজনৈতিক হিসাব বুঝতে হলে আরও কিছু সময় অপেক্ষা করতে হবে।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, সৎ উদ্দেশ্যে জোটগুলো হয়ে থাকলে ভালোই হবে। সময়ের সঙ্গে তাদের উদ্দেশ্য স্পষ্ট হবে।
Sharing is caring!