প্রজন্ম ডেস্ক:
আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ব্যবহার করে ভুয়া তথ্য ছড়িয়ে রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবেশকে অস্থিতিশীল করার একটি নতুন হুমকি দেখা দিয়েছে।
এআই ব্যবহার করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে ভুয়া ভিডিও, জাল অডিও, নকল সংবাদ শিরোনাম ও বিভ্রান্তিকর ছবি, যা অনেক সময় রাজনৈতিক-সামাজিক পরিবেশকে অস্থিতিশীল করে তুলছে। যদিও নির্বাচনি আচরণবিধিতে এআই ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তারপরও এআইর ব্যবহার হতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
নির্বাচনের আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভ্রান্তিকর কনটেন্ট ছড়িয়ে পড়ার প্রবণতা উদ্বেগজনক। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, এটি নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে সংঘাত সৃষ্টি হতে পারে। ভুয়া খবর ও ভিডিওগুলো এতটাই বাস্তবসম্মত যে সাধারণ মানুষের পক্ষে আসল-নকল বোঝা কঠিন হয়ে পড়ছে। নির্বাচনের আগে এই প্রবণতা কয়েকগুণ বেড়ে যাওয়ায় আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এতে ভোটারদের মধ্যে আতঙ্ক, অবিশ্বাস এবং সন্দেহের পরিবেশ তৈরি হচ্ছে, যা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য অত্যন্ত উদ্বেগজনক।
নির্বাচন ইস্যুতে বাড়ছে ঝুঁকি:
বিভিন্ন দেশে নির্বাচন কাভার ও পর্যবেক্ষণ করছেন দক্ষিণ আফ্রিকার বিশিষ্ট সাংবাদিক রোয়ান ফিলিপ। তিনি গ্লোবাল ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম নেটওয়ার্ক (GIJN)-এর একজন সিনিয়র রিপোর্টার। ২০২৫ ও ২০২৬ সালে যেসব দেশে নির্বাচন হচ্ছে বা হবে সেসব দেশে ‘এআই’ ব্যবহারের মাধ্যমে ভুল তথ্যের কারণে সংঘাতের শঙ্কা করছেন তিনি। বাংলাদেশসহ বেশ কিছু দেশের নির্বাচনের আগে ও পরে ‘এআই’র ব্যবহার নিয়ে তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেছের। তার মতে, তিনটি পর্যায়ে এই ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। প্রথমত, মনোনয়ন ও প্রার্থী ঘোষণার সময়। দ্বিতীয়ত, প্রচারের শেষ সপ্তাহগুলোতে। তৃতীয়ত, ভোটের দিন ও ফলাফল ঘোষণার পরপরই। এই সময়গুলোতে ভুয়া ভিডিও, ফলাফল সংক্রান্ত আগাম তথ্যে মানুষ বিভ্রান্ত হতে পারে। উত্তেজিত জনতা সহিংস হয়ে উঠতে পারে।
দেশের রাজনীতিতে ভোটের মাঠে স্বাভাবিকভাবেই রাজনৈতিক দলগুলো বিভক্ত থাকে। তখন সামান্য একটি ভুল তথ্যও বড় উত্তেজনা তৈরি করতে পারে। এআই-জেনারেটেড কনটেন্ট সেই উত্তেজনাকে কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিতে পারে। ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটকসহ বড় প্ল্যাটফর্মগুলো ভুয়া তথ্য বেশি ছড়ায়। অনেক সময় দেখা যায়, একটি ভুয়া ভিডিও কয়েক লাখ মানুষ দেখে ফেলার পর সেটি সরানো হয়। ততক্ষণে অনেক ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে।
কীভাবে কাজ করছে এআই?
আধুনিক এআই প্রযুক্তির মাধ্যমে এখন খুব সহজেই বাস্তবসম্মত ভুয়া ছবি, ভিডিও ও অডিও তৈরি করা সম্ভব হচ্ছে। চ্যাটবট, ইমেজ জেনারেটর, ভয়েস ক্লোনিং এবং ডিপফেক টুলের মতো প্রযুক্তি ব্যবহার করে রাজনৈতিক নেতাদের বক্তব্যের নকল তৈরি, সাজানো ভিডিও, উসকানিমূলক ছবি বা কাল্পনিক সহিংসতার দৃশ্য তৈরি খুবই সহজ হয়েছে। এই ধরনের কনটেন্ট মানুষকে বিভ্রান্ত করার পাশাপাশি তাদের আবেগকে উত্তেজিত করে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় প্ররোচিত করে, যা দ্রুত উত্তেজনাকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে। এই প্রযুক্তিগুলো সনাতন পদ্ধতির চেয়ে অনেক দ্রুত এবং কম পরিশ্রমে গুজব ছড়াতে সক্ষম।
নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এআইর অপব্যবহার ক্রমাগত বাড়ছে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক ও তথ্যপ্রযুক্তি গবেষক ড. সাইফুল হক। তিনি বলেন, আমাদের দেশের মানুষ তথ্যপ্রযুক্তিতে যতটুকু সচেতন? আমরা সেই অনুযায়ী সচেতন হতে পারিনি। প্রতি মিনিটে কোটির ওপরে এআই ব্যবহার করে ভুল নিউজ বা বিভ্রান্তিকর-উসকানিমূলক তথ্য ছড়ানো হচ্ছে। আসলে এর সংখ্যা এত বেশি যে তা গুনেও শেষ করা যায় না। অবস্থা এমন যে মাঝে মধ্যে সাংবাদিকরাও বুঝে উঠতে পারছেন না। এখন এআই জেনারেটেড কনটেন্টের কারণে তাদের তিনভাবে নিউজ চেক করে নিতে হচ্ছে।
তিনি বলেন, ‘ছবি-ভিডিও-ফটোকার্ড’ এর মাধ্যমে গুজব বা বিভ্রান্তিকর তথ্য বেশি ছড়ানো হচ্ছে। ফেসবুকে ছড়ালে হয়তো নির্দিষ্ট করে ব্যবস্থা নেওয়া যায়। কিন্তু হোয়াটসঅ্যাপ, ইমো, ভাইভার মতো প্ল্যাটফর্মে ভুল তথ্য ছড়ালে কীভাবে ঠেকাবেন? যা আমাদের দেশে নিয়মিত হচ্ছে।
পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রস্তুতি কোন পর্যায়ে
রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল সংস্থাগুলো বিষয়টি ‘হালকাভাবে’ নিচ্ছে না। নির্বাচন কমিশন ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্ট গবেষক ও বিশ্লেষকদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করছেন। বিভিন্ন সূত্র ধরে তথ্য পরামর্শ দিচ্ছে এবং নিচ্ছে। গত কয়েকদিন ধরে ইসি সাংবাদিকসহ বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তি ও সংগঠনের সঙ্গে সেমিনার করছেন। ট্রেনিং দিচ্ছেন। সংস্থাটির সভা-সেমিনারে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারে সতর্কতার বিষয়ে গুরুত্ব দিতে দেখা যাচ্ছে। দেশের সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-গবেষকরা সেমিনারে পরামর্শ দিচ্ছেন।
এ ছাড়াও পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইউনিট, র্যাব, ডিবি এবং এনটিএমসি (ন্যাশনাল টেলিকম মনিটরিং সেন্টার) সক্রিয়ভাবে নজরদারি চালাচ্ছে। বিশেষ সফটওয়্যারের মাধ্যমে সন্দেহজনক কনটেন্ট শনাক্ত করার চেষ্টা চলছে।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গণমাধ্যম শাখার উপকমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান বলেন, ‘এআই বা যেকোনো ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহার করে যেসব অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ঘটানো হয়ে থাকে সেগুলোর বিরুদ্ধে ডিএমপির বিশেষায়িত ইউনিটগুলোর পাশাপাশি বিভিন্ন বিভাগ সবসময় নজরদারি কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। তা ছাড়া সাইবার অপরাধ বিষয়ে থানায় কোনো জিডি বা মামলা হলে সেগুলোও গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়। এসব বিষয়ে পুলিশ সব সময় তৎপর রয়েছে।’
Sharing is caring!