প্রজন্ম ডেস্ক:
মায়ানমারের রাখাইনের ৮০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণকারী সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মি তাদের সামরিক ব্যয় মেটাতে এখন ঝুঁকেছে মাদক-বাণিজ্যের দিকে। আর এই মাদক-বাণিজ্যের প্রধান টার্গেট ও বাজার হয়ে উঠেছে প্রতিবেশী বাংলাদেশ। এ পরিপ্রেক্ষিতে মায়ানমারের সীমান্তবর্তী দেশগুলোকে নিয়ে মাদক ও সন্ত্রাস নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এ জন্য ওই দেশগুলোর সঙ্গে কয়েক মাসের মধ্যে আলোচনার উদ্যোগ নেওয়া হবে।
মায়ানমারের জান্তা বাহিনীর সঙ্গে সংঘাতে এখন আরাকান আর্মির আয়ের দুটি প্রধান ধারা তৈরি হয়েছে। এক. আন্তর্জাতিক মাদক চোরাচালান গ্রুপগুলোকে বাংলাদেশ সীমান্তে তাদের নিয়ন্ত্রিত রুট ব্যবহারের অনুমতি দিয়ে বিপুল অঙ্কের কমিশন আদায় করা। দুই. নিজস্ব সক্রিয় সিন্ডিকেটের মাধ্যমে স্থল ও সমুদ্রপথে সরাসরি বাংলাদেশে মাদক পাচার করা। মায়ানমার থেকে ইয়াবা আসছে অনেক আগে থেকেই। এখন ইয়াবার সঙ্গে আসছে আফিম, হেরোইন, ইয়াবা, আইসের মতো নতুন নতুন মাদক। সেখানে পপি ফুলের ক্রমবর্ধমান চাষ বাংলাদেশের জন্য নতুন দুশ্চিন্তা তৈরি করেছে। এই পপি ফুল থেকে তৈরি হয় আফিম। আর আফিম থেকে হয় হেরোইন, ইয়াবা ও আইসের মতো ভয়ংকর সব মাদক। আন্তর্জাতিক মাদক চোরাকারবারিরা ইয়াবা, হেরোইন ও আইসের মতো বাংলাদেশে আফিমেরও বাজার তৈরির পাশাপাশি অন্য দেশে পাচারের রুট বানানোর চেষ্টায় নেমেছে। এই কাজে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের সম্পৃক্ত করা হচ্ছে।
গত ১২ ডিসেম্বর জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধসংক্রান্ত কার্যালয় (ইউএনওডিসি) মায়ানমারের পপি চাষ ও আফিম উৎপাদনের ওপর একটি সমীক্ষা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বে আফিম উৎপাদনে মায়ানমার এখন শীর্ষে। দেশটিতে ২০২১ সাল থেকে আবার আফিম উৎপাদন বেড়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মায়ানমারে পপি চাষের এলাকাগুলো বর্তমানে জান্তাবিরোধী সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে। গোষ্ঠীগুলো অস্ত্র কেনা ও নগদ অর্থ সংগ্রহের জন্য মাদক চোরাচালানে বেপরোয়া হয়ে উঠবে। এটিই বাংলাদেশের জন্য বড় উদ্বেগের। মাদক পাচারকারীদের নতুন এই চেষ্টা বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্য ও সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্য বড় হুমকি হয়ে দেখা দিতে পারে। বাংলাদেশে একটি অংশ ইতোমধ্যে ইয়াবা, হেরোইন ও আইসে আসক্ত। আফিম ঢুকলে কেউ কেউ এতে আসক্ত হবে। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, আগামী এক দশকে বাংলাদেশ সামাজিক, অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তাজনিত এক দীর্ঘমেয়াদি বিপর্যয়ের মুখে পড়তে যাচ্ছে। এ ছাড়া আরাকান আর্মির ক্রমবর্ধমান তৎপরতা সীমান্তে চরম অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করেছে। সীমান্তে গোলাগুলি, বাংলাদেশি জেলেদের অপহরণ এবং অনুপ্রবেশের ঘটনা বাড়ছে।
এদিকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, মায়ানমারে মাদক ও সন্ত্রাস নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এ জন্য মায়ানমারের সীমান্তবর্তী দেশগুলোর সঙ্গে কয়েক মাসের মধ্যে আলোচনার উদ্যোগ নেওয়া হবে। কারণ সীমান্তবর্তী দেশগুলোতেই সবচেয়ে বেশি মাদক পাচার করছে মায়ানমার। সে দেশের এই মাদক-সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যৌথভাবে উদ্যোগ না নিলে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। এ ছাড়া দেশটির মাদক-সন্ত্রাস নিয়ন্ত্রণে জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধসংক্রান্ত কার্যালয়ের সহায়তা নেওয়ারও চেষ্টা করবে বাংলাদেশ। সূত্র জানায়, মায়ানমারের মাদক-সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনেক আগেই পদক্ষেপ নেওয়ার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু সমন্বিত উদ্যোগ না নেওয়ায় এখন দেশটি সবচেয়ে বড় মাদক উৎপাদনকারী দেশে পরিণত হয়েছে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, আরাকান আর্মির এই মাদক-সন্ত্রাস বাংলাদেশের ওপর চারটি প্রধান নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। দেশের বিশাল যুবগোষ্ঠী মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে, যা ভবিষ্যৎ মানবসম্পদকে পঙ্গু করে দিচ্ছে। বাড়ছে পারিবারিক সহিংসতা, চুরি, ছিনতাই ও খুনের মতো অপরাধ। মাদক কেনার মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ পুঁজি মায়ানমারে পাচার হচ্ছে। তৈরি হচ্ছে কালোটাকার বিশাল অর্থনীতি, যা দেশের অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর। মাদক বিক্রির টাকায় আরাকান আর্মি অত্যাধুনিক অস্ত্র কিনছে। সীমান্তে তাদের শক্তি বৃদ্ধি মানেই বাংলাদেশের জন্য ঝুঁকি। এ ছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামের কিছু বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর সঙ্গে তাদের যোগাযোগের খবর অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় বাংলাদেশকে ‘মাদক ট্রানজিট নেশন’ হিসেবে চিহ্নিত করার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে, যা বহির্বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতে পারে।
মায়ানমার থেকে আসা ইয়াবার প্রধান গেটওয়ে হচ্ছে টেকনাফ-কক্সবাজার রুট। বাংলাদেশে যেসব রুট দিয়ে ইয়াবা প্রবেশ করে, তার মধ্যে অন্যতম হলো নাফ নদী ও সামুদ্রিক রুট, টেকনাফ-হ্নীলা-হোয়াইক্যং সীমান্তঘেঁষা পাহাড়ি রুট এবং মেরিন রুট (সেন্ট মার্টিন-চট্টগ্রাম উপকূলঘেঁষা পথ)। এই রুটগুলো আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রিত অঞ্চল থেকে পরিচালিত সিন্ডিকেটগুলোর কাছে অত্যন্ত লাভজনক। সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো এখানে স্থানীয় যোগাযোগ, বংশানুক্রমিক পাচার নেটওয়ার্ক ও দুর্নীতিপ্রবণ কিছু উপাদানকে ব্যবহার করে নিয়ন্ত্রণ বিস্তার করে। আরাকান আর্মি সরাসরি রোহিঙ্গা ক্যাম্পকে ‘লজিস্টিক হাব’ হিসেবে ব্যবহার করে। কারণ ক্যাম্পের ভেতর দারিদ্র্য ও বেকারত্ব, যুবকদের সহজে মাদক পরিবহনে যুক্ত করা এবং ভৌগোলিক কারণে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো মাদক পরিবহনের নিরাপদ জায়গা হয়ে উঠেছে।
সম্পাদক মন্ডলীর সভাপতিঃ মোহাম্মদ আফছার খান সাদেক
সম্পাদক ও প্রকাশকঃ মিলাদ মোঃ জয়নুল ইসলাম
প্রকাশনালয়ঃ রিপোর্টার লজ, কসবা, বিয়ানীবাজার, সিলেট ।
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ উত্তর বাজার কেন্দ্রিয় মসজিদ মার্কেট (২য় তলা), বিয়ানীবাজার, সিলেট ।
মোবাঃ ০১৮১৯-৬৫৬০৭৭, ০১৭৩৮-১১ ৬৫ ১২
ইমেইলঃ agamiprojonma@gmail.com, milad.jaynul@gmail.com