প্রজন্ম ডেস্ক:
ছাত্র গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পরিত্যাগের প্রবণতা কিছুটা বেড়েছে। বিদেশি নাগরিকত্ব নিতে বাংলাদেশিদের পছন্দের শীর্ষে রয়েছে জার্মানি ও অস্ট্রিয়া। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বহিরাগমন অনুবিভাগের হিসাবে, অভ্যুত্থান-পরবর্তী গত অক্টোবর পর্যন্ত ১৫ মাসে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব ছেড়েছেন ৩৯৯ জন। এর মধ্যে ৭৫ শতাংশই নতুন নাগরিকত্ব নিয়েছেন ইউরোপের কয়েকটি দেশে। এর মধ্যে জার্মানিতে ১৭৬ জন এবং অস্ট্রিয়ায় নাগরিকত্ব নিয়েছেন ১১৪ জন। এ ছাড়া হংকংয়ে ৪০ জন, সিঙ্গাপুরে ৩০, ভারতে ৬, পাকিস্তানে ৩, নেপালে ৬, যুক্তরাজ্যে ৪, দক্ষিণ কোরিয়ায় ৩, মালয়েশিয়ায় ৩ ও বসতোয়ানায় ৪ জন নাগরিকত্ব নিয়েছেন। শ্রীলঙ্কা, এস্তোনিয়া, অস্ট্রেলিয়া ও আজারবাইজানে দুজন করে বাংলাদেশি নাগরিকত্ব নিয়েছেন। একজন করে নাগরিকত্ব নিয়েছেন রাশিয়া ও মিসরে। গণঅভ্যুত্থানের আগের সাত মাসে বাংলাদেশি নাগরিকত্ব ছেড়ে বিদেশি নাগরিকত্ব নিয়েছেন ১১৬ জন।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী গত ৯ বছরে ২ হাজার ৮৭৬ জন বাংলাদেশি নাগরিকত্ব ছেড়ে বিদেশি নাগরিকত্ব নিয়েছেন। যার মধ্যে জার্মানির নাগরিকত্ব নিয়েছেন ১ হাজার ৮৬৮ জন এবং অস্ট্রিয়ার ৪৮৩ জন ও ভারতের ১৮৫ জন। বাকিরা পাকিস্তান, হংকং, সিঙ্গাপুরসহ অন্য ২৫টি দেশের নাগরিকত্ব নিয়েছেন। এর মধ্যে ২০১৭ সালে ১৬৭ জন, ২০১৮ সালে ৪৫৮, ২০১৯ সালে ৩০৮, ২০২০ সালে ২৩৭, ২০২১ সালে ২৬২, ২০২২ সালে ৩৭৭, ২০২৩ সালে ৫৫২, ২০২৪ সালে ৩২৪ এবং ২০২৫ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ১৯১ জন বাংলাদেশের নাগরিকত্ব ছেড়ে বিদেশি নাগরিকত্ব নিয়েছেন। ২০২৩ সালের বিদেশি নাগরিকত্ব নেওয়া ৫৫২ জনের মধ্যে ৪৭০ জনই জার্মানির নাগরিকত্ব নিয়েছেন বলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টরা জানান।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা জানান, বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পরিত্যাগ করে বিদেশি নাগরিকত্ব গ্রহণকারীদের মধ্যে বেশিরভাগই অভিজাত ধনী। অনেকেই দক্ষ কর্মীর ক্যাটাগরিতে বিদেশে অভিবাসন গ্রহণকারীরা সংশ্লিষ্ট দেশের নাগরিকত্বের সুবিধা নিয়েছেন। অন্যদিকে বিগত সরকারের আমলে দেশ থেকে অর্থ পাচারসহ নানা আর্থিক অপরাধের দায়ে শাস্তি এড়াতেও কেউ কেউ বাংলাদেশের নাগরিকত্ব ত্যাগ করেছেন। বাংলাদেশের নাগরিকত্ব ত্যাগ করে সিঙ্গাপুরের নাগরিকত্ব গ্রহণকারীদের মধ্যে রয়েছেন আলোচিত সামিট গ্রুপের চেয়ারম্যান আজিজ খান। দীর্ঘদিন ধরেই সিঙ্গাপুরে স্থায়ী নিবাসী (পারমানেন্ট রেসিডেন্ট) হিসেবে বসবাস করে আসছিলেন তিনি। পরিবারের সদস্যসহ সিঙ্গাপুরের নাগরিকত্ব গ্রহণকারী আরেকজন এস আলম গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা সাইফুল আলম।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বহিরাগমন অনুবিভাগের কর্মকর্তারা জানান, বাংলাদেশি পাসপোর্ট জমা দিয়ে তারা নাগরিকত্ব পরিত্যাগের আবেদন করার পর মন্ত্রণালয় তা মঞ্জুর করে। গত ৯ বছরে ২৭টি দেশের নাগরিকত্ব নেওয়ার জন্য বাংলাদেশি নাগরিকত্ব পরিত্যাগের আবেদন এসেছিল। অস্ট্রিয়া ও জার্মানির নাগরিকত্ব নেওয়ার জন্যই সংশ্লিষ্ট দেশের বাংলাদেশ দূতাবাসের মাধ্যমে আবেদন সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায়। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, বিদেশে অবস্থানরত কোনো ব্যক্তি যদি বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পরিত্যাগ করতে চান, তা হলে তাকে নির্ধারিত ফরমে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করার পাশাপাশি নির্ধারিত ফি জমা দিতে হয়। এটি যাচাই-বাছাইয়ের পর সিদ্ধান্ত জানিয়ে প্রত্যয়ন দেওয়া হয় যে, আবেদনকারীর নাগরিকত্ব পরিত্যাগের আবেদন সরকার কর্তৃক গ্রহণ করা হয়। জার্মানি, অস্ট্রিয়া, হংকং বা সিঙ্গাপুরের মতো কোনো দেশের নাগরিকত্ব পাওয়ার শর্ত হিসেবে নিজ দেশের নাগরিকত্ব বর্জন করতে হয়। এ ছাড়া বাংলাদেশের বিদ্যমান আইন অনুযায়ী ভারতসহ সার্কভুক্ত কোনো দেশের নাগরিকত্ব নিতে চাইলেও নিজ দেশের নাগরিকত্ব পরিত্যাগ করতে হয়। এ ক্ষেত্রে কোনো ব্যক্তি যদি বাংলাদেশের নাগরিকত্ব ত্যাগ বা বর্জন করতে চান, তা হলে প্রথমেই তাকে বাংলাদেশের পাসপোর্ট সারেন্ডার করতে হবে। তবে ব্যক্তি যদি জন্মসূত্রে বাংলাদেশের নাগরিক হন, তা হলে যেকোনো সময় নিজের পাসপোর্ট পুনরায় ‘ক্লেইম-ব্যাক’ বা ফিরে পাওয়ার আবেদন করতে পারবেন।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন উপসচিব জানান, যুক্তরাজ্য বা যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব গ্রহণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশি নাগরিকত্ব পরিত্যাগের প্রয়োজন হয় না। তবে ওই দেশগুলোতে চাকরি করার ক্ষেত্রে অনেক সময় শর্ত হিসেবে নিজ দেশের নাগরিকত্ব পরিত্যাগের প্রয়োজন হয়। তিনি জানান, শুধু যে বিদেশি নাগরিক হওয়ার জন্য বাংলাদেশি নাগরিকত্ব ছাড়ে এমনটি নয়। অনেক দেশ রয়েছে যেখানে দ্বৈত নাগরিকত্বের সুযোগ থাকলেও স্থানীয় সরকার নির্বাচন বা অন্য কোনো নির্বাচনে অংশ নিতে চাইলে নাগরিকত্ব পরিত্যাগের প্রয়োজন হয়।
বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা ও দুর্নীতির কারণে আর্থিকভাবে সামর্থ্যবান ও উচ্চ দক্ষতার ব্যক্তিদের মধ্যে স্থায়ীভাবে বিদেশে বসবাস ও বিদেশি নাগরিকত্ব গ্রহণের প্রবণতা বেড়েছে। অভিবাসন বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর বলেন, বিদেশি নাগরিকত্ব গ্রহণের একাধিক কারণ থাকতে পারে। কেউ কেউ মনে করছেন বাংলাদেশে থাকা নিরাপদ না। যেহেতু বিদেশে নাগরিকত্ব নেওয়ার আইনি প্রক্রিয়ায় সুযোগ আছে, তাই তারা সে সুযোগটি নিচ্ছেন। আবার ব্যবসায়ীসহ অনেক পরিবারের সদস্যরা বিদেশে থাকে। অনেকে বিভিন্ন সময়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার করেছেন, সেখানে ব্যাংকে তাদের অনেক টাকা আছে। তাই যেকোনো সংকটের সময় সেখানে যাতে থেকে যেতে পারেন এ কারণেও অনেকে নাগরিকত্ব পরিত্যাগ করেন।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (বহিরাগমন অনুবিভাগ) ফয়সল আহমেদ জানান, বাংলাদেশের কেউ নাগরিকত্ব পরিত্যাগ করতে চাইলে তারা আবেদন করেন। বিদ্যমান আইন অনুযায়ী সবকিছু ঠিক থাকলে আবেদন মঞ্জুর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আবেদনকারীর বাংলাদেশি পাসপোর্ট বাতিল করে বিষয়টি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পাসপোর্ট অধিদফতরকে অবহিত করে অনুলিপি প্রদান করা হয়। আর আবেদনকারী বিদেশে অবস্থান করলে সংশ্লিষ্ট দেশের দূতাবাসকে বিষয়টি অবহিত করা হয়।
সম্পাদক মন্ডলীর সভাপতিঃ মোহাম্মদ আফছার খান সাদেক
সম্পাদক ও প্রকাশকঃ মিলাদ মোঃ জয়নুল ইসলাম
প্রকাশনালয়ঃ রিপোর্টার লজ, কসবা, বিয়ানীবাজার, সিলেট ।
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ উত্তর বাজার কেন্দ্রিয় মসজিদ মার্কেট (২য় তলা), বিয়ানীবাজার, সিলেট ।
মোবাঃ ০১৮১৯-৬৫৬০৭৭, ০১৭৩৮-১১ ৬৫ ১২
ইমেইলঃ agamiprojonma@gmail.com, milad.jaynul@gmail.com