প্রজন্ম ডেস্ক:
ভারতে বাংলাদেশের হাইকমিশনার এম রিয়াজ হামিদুল্লাহকে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছে। দেশটির চরমপন্থি সংগঠন অখন্ড হিন্দু রাষ্ট্রসেনার সদস্যরা গত শনিবার রাতে দিল্লির কূটনৈতিক এলাকা চাণক্যপুরীর রাধাকৃষ্ণ মার্গে অবস্থিত তার বাসভবন ও হাইকমিশনের সামনে বিক্ষোভ করে ও হুমকি দেয়।
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন দিল্লিতে হাইকমিশনারকে হত্যার হুমকি দেওয়ার বিষয়টি গতকাল রবিবার ঢাকায় সাংবাদিকদের জানান। উপদেষ্টা বলেন, শনিবার রাতের ঘটনাটির পর ‘হাইকমিশনারের পরিবার’ ঝুঁকিতে আছে, এমন অনুভূতির কথা জানিয়েছে।
কূটনীতিকরা জানান, ২০ থেকে ২৫ জন বিক্ষোভকারী শনিবার রাতে কয়েকটি গাড়িতে মিশন চত্বরে অবস্থিত ‘বাংলাদেশ হাউজের’ গেটে এসে ব্যানারসহ বিক্ষোভ করে। তারা বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের নাগরিকদের ওপর ‘নির্যাতন’ বন্ধের দাবি জানায়। অন্যথায়, হাইকমিশনারসহ দূতালয় কর্মীদের নিয়ে নানান হুমকি দেয়। ভারতে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার ‘বাংলাদেশ হাউজে’ সপরিবারে বসবাস করেন। সংগঠনটির কর্মীরা পরে মিশনের প্রধান গেটে গিয়ে বিক্ষোভ করে কিছুক্ষণ পর চলে যায়।
চরমপন্থি একটি সংগঠনের সদস্যরা গতকাল রাতেও দিল্লির বাংলাদেশ হাইকমিশনের সামনে এসে বিক্ষোভ করে। তবে উভয় বিক্ষোভ একই সংগঠনের কর্মীরা করেছে কি না, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
তৌহিদ হোসেন গতকাল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা শুনেছি যে, তাকে (হাইকমিশনার) হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছে। সেখানে এসে তাকে হুমকি দেবে কেন! এ ঘটনার পর থেকে দিল্লিতে হাইকমিশনারের পরিবার ঝুঁকি বোধ করছে এবং হুমকি অনুভব করছে।’
দিল্লির কূটনৈতিক সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, অখ- হিন্দু রাষ্ট্রসেনার কর্মীরা সেখানকার সময় রাত ৮টা ৩৫ মিনিট থেকে ৮টা ৫৫ মিনিট পর্যন্ত ‘বাংলাদেশ হাউজের’ সামনে অবস্থান করে সেøাগান দেয়। তারা বাংলা ও হিন্দি মিলিয়ে কথা বলছিল। এ সময় ‘হিন্দুদের নিরাপত্তা দিতে হবে’ ও ‘হাইকমিশনারকে ধর’ ইত্যাদি স্লোগান দেওয়া হয়।
কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ঢাকায় শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি, গত দেড় বছরের বিভিন্ন ঘটনা, বাংলাদেশে দলটির ‘কার্যক্রম নিষিদ্ধ’ করে আগামী জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের তোড়জোড় ও অন্যান্য ঘটনাবলির সঙ্গে চাণক্যপুরীর মতো কড়া নিরাপত্তাবেষ্টিত কূটনৈতিক এলাকায় পরপর দুদিন উগ্রবাদীদের বিক্ষোভকে মিলিয়ে দেখলে এটা পরিষ্কার হাইকমিশনারকে দেওয়া হুমকি ‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’।
বিভিন্ন বিদেশি দূতাবাস ও ভারতের গুরুত্বপূর্ণ কিছু সরকারি কার্যালয়ের অবস্থান চাণক্যপুরীতে। রাতে এলাকাটি নীরব হয়ে যায়। তখন এ ধরনের বিক্ষোভ প্রদর্শন ও হুমকি দেওয়া এক ধরনের ‘উসকানি’ হিসেবে দেখছে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ।
পেশাদার কূটনীতিকরা মনে করেন, মোটামুটি তিনটি উদ্দেশে উসকানি দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ মিশন ও হাইকমিশনারকে কেন্দ্র করে ‘কূটনৈতিক উপদ্রব’ তৈরি করা হয়ে থাকতে পারে।
প্রথমত, দিল্লির আশ্রয় থেকে শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের কাছে প্রত্যর্পণের জন্য বাংলাদেশ থেকে ভারত সরকারের ওপর চাপ আছে। সীমান্ত অতিক্রম করে ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদির খুনি ভারতে গেছে এমন প্রচার আছে। এমন অবস্থায় মানুষের দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিতে দিল্লিতে হুমকি দেওয়া হয়ে থাকতে পারে।
দ্বিতীয়ত, ভারতের ক্ষমতাসীন মহল চায়, বাংলাদেশে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অংশ নেওয়ার সুযোগ থাকুক। এ উদ্দেশে নানা উপায়ে চাপ তৈরির পথে গেছে দেশটির সরকার।
তৃতীয়ত, শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশ নিতে না পারলে ভোটের পর যে সরকারই ঢাকায় ক্ষমতায় আসুক, তার জন্য আগেভাগে যতটা সম্ভব বাজে পরিস্থিতি তৈরি করে রাখা, যাতে নতুন সরকার ভারতের সঙ্গে বিভিন্ন ইস্যুতে দরকষাকষির ক্ষেত্রে কিছুটা দুর্বল অবস্থানে থাকে।
বাংলাদেশের কূটনীতিকরা মনে করেন, হাইকমিশনার হিসেবে ভারতে নতুন হলেও রিয়াজ হামিদুল্লাহ নানা কর্মসূচির মাধ্যমে এরই মধ্যে দিল্লি, পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরায় রাষ্ট্র এবং সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ে সংযোগ তৈরি করতে সক্ষম হন। তার চলাচল ও কার্যক্রম সীমিত রাখতে মানসিক চাপ তৈরির জন্যও হত্যার হুমকি দেওয়া হয়ে থাকতে পারে।
দিল্লিতে শনিবার রাতে হাইকমিশনের সামনে উগ্রবাদীদের তৎপরতার বিষয়ে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গতকাল একটি ব্যাখ্যা দিয়েছে। বাংলাদেশ সরকার দিল্লির এ ব্যাখ্যা প্রত্যাখ্যান করেছে।
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বলেন, ভারতীয় প্রেস নোটে যা বলা হয়েছে, সেটা বাংলাদেশ সরকার সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যান করছে। প্রত্যাখ্যান এজন্য যে, বিষয়টি ভারত সরকার যত সহজভাবে উত্থাপন করেছে, অত সহজ নয়।
তিনি বলেন, ‘দিল্লিতে কূটনৈতিক এলাকার ভেতরে বাংলাদেশ মিশনের অবস্থান খুবই নিরাপদ স্থানে। হিন্দু চরমপন্থিরা ওই এলাকার মধ্যে আসতে পারবে কেন? তাহলে তাদের আসতে দেওয়া হয়েছে, এমন ঘটনা প্রত্যাশিত নয়।’
এর আগে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল দিল্লির সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ময়মনসিংহে দীপু চন্দ্র দাসের নৃশংস হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে ২০-২৫ তরুণ শনিবার বাংলাদেশ হাইকমিশনের সামনে জড়ো হয়ে স্লোগান দেয় এবং বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের সুরক্ষার দাবি তোলে। তবে কোনো সময়ই হাইকমিশনের নিরাপত্তা বেষ্টনী ভাঙার চেষ্টা বা নিরাপত্তাজনিত পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। তিনি বলেন, পুলিশ কয়েক মিনিটের মধ্যে বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। তিনি দাবি করেন, ভিয়েনা কনভেনশন অনুযায়ী, ভারতে অবস্থিত সব বিদেশি মিশন ও কূটনৈতিক স্থাপনার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
রণধীর জয়সওয়াল আরও বলেন, বাংলাদেশের চলমান পরিস্থিতির ওপর ভারত নিবিড়ভাবে নজর রাখছে। সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ঘটনায় ভারতের গভীর উদ্বেগ বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। দীপু চন্দ্র দাসের হত্যাকা-ে জড়িতদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনার আহ্বান জানানো হয়েছে।
কূটনীতিকরা মনে করেন, দীপু চন্দ্রের নৃশংস হত্যাকা-কে সাধারণ প্রবণতা হিসেবে তুলে ধরে বাংলাদেশের ওপর চাপ তৈরির জন্য ভারতে বিভিন্ন মিশনের সামনে বিক্ষোভের আয়োজন করা হচ্ছে।
বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার দাবিতে শনিবার বিকেলে ভারতের কলকাতায় বাংলাদেশ উপদূতাবাসের সামনেও বিক্ষোভ হয়েছে। ‘বাংলা পক্ষ’ নামে একটি সংগঠনের শতাধিক কর্মী মিছিল নিয়ে উপদূতাবাসের দিকে যেতে থাকলে পুলিশ তাদের প্রায় ২০০ মিটার দূরে আটকে দেয়।
সংগঠনটির কর্মীরা, বাংলাদেশ পরিস্থিতিতে ‘হস্তক্ষেপের’ জন্য ভারত সরকারের প্রতি দাবি জানায়।
পশ্চিমবঙ্গের ‘স্থানীয়’ রাজনৈতিক চাহিদা মেটাতে এ বিক্ষোভ হয়ে থাকতে পারে এমনটা জানিয়ে এক কূটনীতিক বলেন, ভবিষ্যতেও উপদূতাবাসের দিকে আরও মিছিল হতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে উপদূতাবাসের নিরাপত্তা জোরদার করতে স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করা হয়েছে। মিশনের নিরাপত্তা এরই মধ্যে বাড়ানো হয়েছে। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে এমন পরিস্থিতি সাম্প্রতিককালে যে এবারই হলো এমন নয়।
বাংলাদেশে ‘নিরাপত্তা পরিস্থিতি’ ও স্থানীয় কিছু রাজনীতিকের বক্তব্য নিয়ে ভারতের উদ্বেগের কথা জানাতে গত ১৭ ডিসেম্বর নয়াদিল্লির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করা হয় হাইকমিশনার রিয়াজ হামিদুল্লাহকে। কূটনৈতিক সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, ইনকিলাব মঞ্চ আয়োজিত এক কর্মসূচিতে দেওয়া বক্তব্যে এনসিপি নেতা হাসনাত আবদুল্লাহ ভারতের উত্তরাঞ্চলের সাতটি রাজ্যকে দেশটি থেকে ‘বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার’ কথা বলে করা মন্তব্যের প্রতি বাংলাদেশ সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়।
এর তিন দিন আগে ১৪ ডিসেম্বর ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করা হয় ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মাকে। দিল্লিতে অবস্থানরত শেখ হাসিনার বিভিন্ন উপায়ে দেওয়া অব্যাহত উসকানিমূলক বক্তব্যের বিষয়ে উদ্বেগ জানাতে ও ইনকিলাব মঞ্চের নেতা শরিফ ওসমান হাদির খুনি ভারতে গেলে তাকে বাংলাদেশ কর্র্তৃপক্ষের হস্তান্তরের জন্য অনুরোধ করতে প্রণয় ভার্মাকে ডাকা হয়।
জুলাই যোদ্ধা ও ঢাকা-৮ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী হাদি গত ১২ ডিসেম্বর নির্বাচনী প্রচার চালানোর সময় খুব কাছে থেকে দুর্বৃত্তরা মাথায় গুলি করে। তিনি চিকিৎসাধীন থাকাবস্থায় ১৮ ডিসেম্বর রাতে সিঙ্গাপুরে মৃত্যুবরণ করেন।
হাদির মৃত্যুর পর ঢাকা ও চট্টগ্রামে ‘ভারতবিরোধী’ বিক্ষোভের সময় নিরাপত্তার অজুহাতে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ দুই মহানগরে অবস্থিত দেশটির ভিসা কেন্দ্র বন্ধ করে দেয়।
বাংলাদেশের কূটনীতিকরা বলছেন, ভারতের উগ্রবাদী সংগঠনগুলো বাংলাদেশ মিশন ও কূটনীতিকদের প্রতি এবারই প্রথম হুমকি তৈরি করেছে, বিষয়টি এমন নয়। এর আগে ২০২৪ সালের ২ ডিসেম্বর ভারতের আগরতলায় বাংলাদেশ সহকারী হাইকমিশনে ঢুকে হিন্দু সংগ্রাম সমিতি নামে একটি সংগঠনের কর্মীরা ভাঙচুর চালায়। তারা মিশন চত্বরে উড়তে থাকা বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা নামিয়ে তাতে আগুন ধরিয়ে দেয়। বাংলাদেশ এ ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ জানায়।
সম্পাদক মন্ডলীর সভাপতিঃ মোহাম্মদ আফছার খান সাদেক
সম্পাদক ও প্রকাশকঃ মিলাদ মোঃ জয়নুল ইসলাম
প্রকাশনালয়ঃ রিপোর্টার লজ, কসবা, বিয়ানীবাজার, সিলেট ।
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ উত্তর বাজার কেন্দ্রিয় মসজিদ মার্কেট (২য় তলা), বিয়ানীবাজার, সিলেট ।
মোবাঃ ০১৮১৯-৬৫৬০৭৭, ০১৭৩৮-১১ ৬৫ ১২
ইমেইলঃ agamiprojonma@gmail.com, milad.jaynul@gmail.com