প্রকাশনার ১৬ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

৭ই ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
২২শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
১৬ই জমাদিউস সানি, ১৪৪৭ হিজরি

রাখাইন ঘিরে সংকট বাড়ছে বাংলাদেশে

editor
প্রকাশিত জানুয়ারি ৫, ২০২৫, ০৯:২৮ পূর্বাহ্ণ
রাখাইন ঘিরে সংকট বাড়ছে বাংলাদেশে

Manual7 Ad Code

প্রজন্ম ডেস্ক:

গৃহযুদ্ধবিধ্বস্ত মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যের বিস্তীর্ণ অঞ্চল এখন বিদ্রোহী আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে। বাংলাদেশ সীমান্তসংলগ্ন সে দেশের বিশাল এলাকা এখন তাদেরই দখলে। এদিকে ওই রাজ্য থেকে উচ্ছেদ হওয়া রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকার নিয়ে এখনো অবস্থান জানায়নি আরাকান আর্মি। অন্যদিকে শরণার্থী সমস্যা শুরু হওয়ার পর গত প্রায় আট বছর ধরে নানা বাহানায় নেপিডো কর্তৃপক্ষ রোহিঙ্গা পুনর্বাসনে কোনো উদ্যোগই গ্রহণ করেনি। রাখাইনের নিয়ন্ত্রণ ও রোহিঙ্গা শরণার্থী প্রত্যাবাসন ইস্যুতে নতুন করে সংকটের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

প্রায় সাড়ে ১২ লাখ রোহিঙ্গার স্বদেশে প্রত্যাবাসন ইস্যু এখন একেবারেই থমকে গেছে। এরই মাঝে নতুন করে অনুপ্রবেশ করেছে আরও ৮০ হাজার রোহিঙ্গা, যা নিয়ে নতুন করে ভাবতে হচ্ছে বাংলাদেশকে।

সম্প্রতি জান্তা বাহিনীকে হটিয়ে মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে সশস্ত্র সংগঠন আরাকান আর্মি (এএ)। রাখাইন রাজ্যের ৮০ শতাংশ নিজেদের দখলে রয়েছে বলে দাবি করছে সংগঠনটি। রাখাইনে আরাকান আর্মির এই ক্রমবর্ধমান নিয়ন্ত্রণ ও নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা বাংলাদেশের জন্য বহুমাত্রিক ভূ-রাজনৈতিক সংকট তৈরি করতে পারে বলেও মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

Manual6 Ad Code

নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর (অব.) এমদাদুল ইসলাম বলেন, ‘সামরিক বাহিনীর বাইরেও চীনের প্রভাব বলয় প্রবল। মায়ানমার প্রশ্নে চীন তার অবস্থান থেকে একটুও বদলায়নি। বরং পশ্চিমাদের চীন ভালোভাবেই বার্তা দিয়েছে যে মায়ানমারে তারাই নিয়ামক শক্তি।’

অতীতে কখনো কি মায়ানমারের সামরিক বাহিনীর সদস্যরা পালিয়ে বাংলাদেশে এসেছেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মায়ানমার তার জন্মলগ্ন থেকেই বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠীর লড়াই সামলে এসেছে। শান স্টেটে শান ন্যাশনাল আর্মি, কারেন স্টেটে কারেন ইনডিপেনডেন্ট আর্মি, চিন স্টেটে চিন ন্যাশনাল আর্মি, মন স্টেটে মন আর্মি, কাচিন স্টেটে কাচিন ইনডিপেনডেন্ট আর্মি, ওয়া আর্মি, আরাকান স্টেটে আরাকান আর্মি দীর্ঘ সময় ধরে লড়াই করে আসছে।’

এমদাদুল ইসলাম আরও বলেন, ‘মায়ানমার সেনাবাহিনী এসব সশস্ত্র গোষ্ঠীর লড়াই বরাবরই দমন করেছে। এটি তারা করেছে কখনো অস্ত্রবলে, কখনো আলোচনার টেবিলে। কিন্তু মায়ানমার সামরিক বাহিনীতে কখনো নিজেদের মাঝে রক্তক্ষয়ী কোনো বিদ্রোহের ঘটনা ঘটেনি। জেনারেল নে উইন থেকে জেনারেল শ মং, এরপর জেনারেল থা শোয়ে, জেনারেল মিন অং হ্লাইং যেন রাজা-বাদশাহদের বংশপরম্পরা। কিন্তু এবারের লড়াইয়ে সবচেয়ে লক্ষণীয় বিষয় হলো, অন্য কোনো সময় মায়ানমার সেনাবাহিনী বা তাদের সেকেন্ড লাইন ফোর্সের কেউ যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে আসেনি। এবার তারা পালাচ্ছে এবং আমাদের কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছে।’

আরাকান আর্মি রাখাইন রাজ্যে তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করলে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য কতটা ঝুঁকিপূর্ণ হবে প্রশ্নের উত্তরে এই নিরাপত্তা বিশ্লেষক বলেন, ‘আমাদের সীমান্তের ওপারে রাখাইন অঞ্চলের সংঘাত মায়ানমারের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এর পরও এ সংঘাত আমাদের জন্য শঙ্কার কারণ। এই সংঘাত বাংলাদেশের নিরাপত্তাঝুঁকির সৃষ্টি করছে। মায়ানমার সরকারের অত্যাচার-নির্যাতন ও জাতিগত বিদ্বেষের শিকার হয়ে অনেক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। তাদের প্রত্যাবাসনের বিষয়টি দীর্ঘদিন ধরে আটকে রয়েছে এবং এখন তা অনেকটাই অনিশ্চিত পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছে। রাখাইনে আমাদের দুই প্রতিবেশী চীন ও ভারতের ভূ-কৌশলগত স্বার্থ রয়েছে। রাখাইনকে ঘিরে দেশ দুটির যেকোনো পদক্ষেপে বাংলাদেশকে ভারসাম্য বজায় রেখে চলতে হবে। এটি বাংলাদেশের জন্য একটি জটিল সমীকরণ।’

 

রোহিঙ্গা সংকট কোন পথে..?

মায়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক কখনোই সুখকর ছিল না। পাশাপাশি বর্তমানে দুই দেশের মধ্যকার বাণিজ্যিক সম্পর্ক অত্যন্ত সীমিত। এ ছাড়া স্পর্শকাতর রোহিঙ্গা ইস্যু, সমুদ্রসীমা বিরোধ, আকাশসীমা লঙ্ঘন, বাংলাদেশের ভূখণ্ড নিজেদের বলে দাবি করাসহ আরও নানা ইস্যুতে মায়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের অত্যন্ত শীতল সম্পর্ক বিরাজ করছে। এরই মাঝে বাংলাদেশের সীমান্তজুড়ে আরাকান আর্মির ক্ষমতা গ্রহণ, বাংলাদেশের জন্য বহুমুখী সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। যার মধ্যে অন্যতম চ্যালেঞ্জ হতে পারে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন। প্রায় ১২ লাখের বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীর ভারে নুয়ে আছে বাংলাদেশ।

ইতোপূর্বে রাখাইনের রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে ২০১৭ সালেই মায়ানমারের সঙ্গে চুক্তি করেছিল বাংলাদেশ সরকার। কিন্তু নানা কারণে প্রত্যাবাসন শুরু করা সম্ভব হয়নি। বর্তমান উদ্ভূত পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রায় অনিশ্চিত। রাখাইন রাজ্যে একটি নতুন রাষ্ট্র গঠন হলে এই সংকট আরও জটিল আকার ধারণ করবে। আরাকান আর্মি রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকার ফিরিয়ে দেবে কি না বা তাদের অবস্থান কী হবে, তা এখনো সুস্পষ্ট নয়। তাই রোহিঙ্গাদের স্বদেশে প্রত্যাবাসন নতুন করে অনিশ্চয়তায় পড়ল।

Manual7 Ad Code

এই পরিস্থিতিতে নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর (অব.) এমদাদুল ইসলাম মনে করেন, কাচিন ইনডিপেনডেন্ট আর্মি, ওয়া এবং তাং আর্মির সঙ্গে ভূ-কৌশলগত সম্পর্কের বিষয়টিও বিবেচনায় রাখতে হবে বাংলাদেশকে। তবে সার্বিক বিবেচনায় মায়ানমারের বর্তমান সামরিক জান্তার সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে শীতলতা প্রদর্শন এবং বিবাদমান গ্রুপগুলোর সঙ্গে প্রকাশ্যে যোগাযোগের সময় এখনো আসেনি। কূটনৈতিকভাবে নয়, আরাকান আর্মির সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনে গোয়েন্দা মাধ্যমকে কাজে লাগানো যেতে পারে বলে মনে করছেন তিনি।

 

আরাকান আর্মি কারা…?

কাচিন ইনডিপেনডেন্ট আর্মির (কেআইএ) সহায়তায় ইউনাইটেড লিগ অব আরাকানের সামরিক শাখা হিসেবে আরাকান আর্মি গঠিত হয় ২০০৯ সালে। তাদের লক্ষ্য, একটি সার্বভৌম আরাকান রাজ্য প্রতিষ্ঠা করা। ধারণা করা হয়, ২০১৫ সাল থেকে পালেতোয়া টাউনশিপ এলাকায় তাদের সামরিক তৎপরতা শুরু করে আরাকান আর্মি।

সেনাবাহিনীর সঙ্গে তারা কয়েক বছর ধরে লড়াই চালিয়ে আসছে এবং এই সময়ে রাখাইন রাজ্য ও পার্শ্ববর্তী চিন রাজ্যে নিজেদের অবস্থানকে সংহত করতে সমর্থ হয়েছে। চলতি বছরের শুরুর দিকে এসে আরাকান আর্মির একের পর এক আক্রমণে কোণঠাসা হয়ে পড়ে সরকারি বাহিনী।

Manual8 Ad Code

 

নিরাপত্তাঝুঁকি বাড়বে বাংলাদেশের

রাখাইনে আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণ রোহিঙ্গা সংকটের পাশাপাশি বাংলাদেশের সীমান্ত নিরাপত্তা ও পার্বত্য অঞ্চলের নিরাপত্তাঝুঁকি সৃষ্টি করবে। বাংলাদেশের সঙ্গে মায়ানমারের প্রায় ২৭০ কিলোমিটারের সীমান্ত রয়েছে। বিবিসির তথ্যমতে, এই সীমান্তের পুরোটাই এখন আরাকান আর্মির দখলে, যা বাংলাদেশের সীমান্ত নিরাপত্তায় মারাত্মক ঝুঁকি সৃষ্টি করছে। বিশ্লেষকরা ধারণা করছেন, বাংলাদেশ-মায়ানমার সীমান্ত ব্যবহার করে অবৈধ মাদক, অস্ত্র চোরাচালান ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড আগের তুলনায় বহুগুণ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ ছাড়া পার্বত্য অঞ্চলের সন্ত্রাসী সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে আরাকান আর্মির। রাখাইনে আরাকান আর্মি ক্ষমতায় এলে বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে বলে আশঙ্কা নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের।

Manual7 Ad Code

সম্প্রতি টেকনাফ সীমান্ত পরিদর্শনে এসে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, ‘বাংলাদেশ-মায়ানমারের সীমান্ত এলাকার অনেকটা নিয়ন্ত্রণে রয়েছে আরাকান আর্মির। ফলে সীমান্ত পরিস্থিতি নিয়ে জান্তা সরকার ও এএ- উভয় পক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। সীমান্ত এলাকায় আমাদের কোনো সমস্যা নেই। বিজিবিসহ সব বাহিনীর সদস্যরা সর্বোচ্চ সতর্কতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছেন। এখানে যেন আইনশৃঙ্খলা সব সময় স্বাভাবিক থাকে তার জন্য গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।’

মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সংঘাতের জের ধরে ৬০ থেকে ৮০ হাজার নতুন রোহিঙ্গা আমাদের দেশে অনুপ্রবেশের তথ্য স্বীকার করে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ‘নতুন আসা রোহিঙ্গাদের নিবন্ধন হয়নি। তাদের নতুন করে নিবন্ধিত করা হবে কি হবে না, তা নিয়ে সরকারের উচ্চপর্যায়ের সিদ্ধান্ত জরুরি। তা নিয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। নতুন অনুপ্রবেশ করা রোহিঙ্গারা মানবিক সমস্যায় পড়ে এসেছেন। অনেকেই এসেছেন গুরুতর আহত হয়ে। ফলে তাদের ফেরত পাঠানোও খুব জটিল হয়ে পড়েছে।’

Sharing is caring!

Manual1 Ad Code
Manual3 Ad Code