প্রকাশনার ১৫ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

৪ঠা ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
১৯শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
২রা জমাদিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি

বিদেশগামী কর্মীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার নামে বছরে লুট আড়াই হাজার কোটি!

editor
প্রকাশিত নভেম্বর ১৩, ২০২৪, ০৭:৫৫ পূর্বাহ্ণ
বিদেশগামী কর্মীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার নামে বছরে লুট আড়াই হাজার কোটি!

 

প্রজন্ম ডেস্ক:

মধ্যপ্রাচ্যগামী বাংলাদেশি কর্মীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার নামে বছরে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা লুটে নিচ্ছে বাংলাদেশ ও ভারতের সাত সদস্যের একটি চক্র। বাংলাদেশ থেকে সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো বছরে ৫ থেকে ৭ লাখ কর্মী নিলেও মেডিকেল পরীক্ষা করানো হচ্ছে অন্তত ২৫ লাখ কর্মীর। শুধুমাত্র গরিবের পকেট কাটতেই এই চক্রটি ভিসা দেওয়ার লোভ দেখিয়ে বিদেশ গমনেচ্ছু কর্মীদের দেদার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাচ্ছে।

জানা গেছে, গালফ হেলথ কাউন্সিলের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে দেশে প্রতি বছর অপ্রয়োজনে মেডিকেল সেন্টার অনুমোদনের ব্যবস্থা করছে চক্রটি। এর বিনিময়ে ঘুষ হিসেবে লাখ লাখ ডলার আদায় করছে চক্রটি। আবার এসব ঘুষের টাকা হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশেও পাচার করছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর ৮ থেকে ১০ লাখ কর্মী চাকরির উদ্দেশ্যে বিদেশ যান। এর মধ্যে শুধুমাত্র মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতেই যায় ৫ থেকে ৭ লাখ কর্মী। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে ভিসা পেতে গালফ হেলথ কাউন্সিল অনুমোদিত মেডিকেল সেন্টারগুলো থেকে কর্মীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা অর্থাৎ মেডিকেল ফিটনেস সার্টিফিকেট নেওয়া বাধ্যতামূলক।

 

সূত্র জানায়, ১৯৯৯ সালে মধ্যপ্রাচ্যগামী বিদেশি কর্মীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার সার্টিফিকেট কার্যক্রম শুরু করে গালফ হেলথ কাউন্সিল। ওই বছরেই বাংলাদেশে ২৬টি মেডিকেল সেন্টারের অনুমোদন দেয় কাউন্সিল। এরপর ২০১৮ সালে আরও ৩৭টি নতুন মেডিকেল সেন্টার অনুমোদন দেয়। দেশে ২০২২ সাল নাগাদ এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১৩৩টি। অথচ প্রতিবেশী দেশ ভারতের বিশাল আয়তন ও জনসংখ্যা থাকলেও সেদেশে এ ধরনের মেডিকেল সেন্টার রয়েছে ১২২টি, পাকিস্তানে রয়েছে ৬৮টি ও ইন্দোনেশিয়ায় মাত্র ২৩টি। সেই হিসাবে বাংলাদেশে এ ধরনের মেডিকেল সেন্টারের সংখ্যা অস্বাভাবিক বলে মনে করছেন খোদ জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকরা।

অনুসন্ধানে জানা যায়, শুধু বিদেশ যেতে ইচ্ছুক অসচ্ছল কর্মীদের পকেট কাটতেই এত বেশি সংখ্যক মেডিকেল সেন্টারের অনুমোদন দেওয়া হয়। আর এই কাজে বাংলাদেশি চক্রটি যোগ দেয় ভারতীয় একটি চক্রের সঙ্গে। অনুসন্ধানে উঠে এসেছে বাংলাদেশি চক্রের সদস্যরা বিগত আওয়ামী লীগ আমলের সাবেক অর্থমন্ত্রী লোটাস কামাল, সাবেক এমপি বিএইচ হারুন ও এইচ বি এম ইকবালের আশীর্বাদ নিয়ে জিসিসি অ্যাপ্রুভড মেডিকেল সেন্টারস অ্যাসোসিয়েশনের (গামকা) বাংলাদেশের সাবেক প্রেসিডেন্ট বিশ্বাস জাহাঙ্গীর আলম, সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট নজরুল ইসলাম এবং জেড ইউ সাইদ এই চক্রটি গড়ে তোলেন। এর মধ্যে জেড ইউ সাঈদ বর্তমানে সৌদি আরবের কারাগারে বন্দি রয়েছেন।

অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, বাংলাদেশি চক্রটির সদস্যরা গামকার ভারতীয় অংশের প্রভাবশালী নেতা শিবামকর বলরাজ মিশ্রা, রাজেশ তিওয়ারি, ভিরান তিওয়ারি ও বিপিন জইনকে তাদের সঙ্গে ভেড়ান। গালফ হেলথ কাউন্সিলের রিয়াদ অফিসের কতিপয় কর্মকর্তাকে অর্থের বিনিময়ে হাত করে মাফিয়া চক্রটি এদেশে দরিদ্র জনগোষ্ঠিকে আরও নিঃস্ব করতে নেমে পড়ে। এই চক্রটি বাংলাদেশে একটি মেডিকেল সেন্টারের অনুমোদন পাইয়ে দেওয়ার বিনিময়ে ২ থেকে ৩ লাখ ডলার অর্থাৎ কয়েক কোটি টাকা উৎকোচ নিয়ে থাকে। এভাবেই চক্রটি বাংলাদেশের একের পর এক মেডিকেল সেন্টার অনুমোদন দেওয়ার ব্যবস্থা করে। যার পুরো অর্থই হুন্ডির মাধ্যমে ভারতসহ বিভিন্ন দেশে পাচার করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। আগামী ডিসেম্বরেও আরও কিছু সেন্টারের অনুমোদন করিয়ে দেওয়ার পাঁয়তারা করছে চক্রটি।

জানা গেছে, ভারত ও বাংলাদেশের এই চক্রটিই ২০২২ সালে এক বছরেই ঢাকা ও ঢাকার বাইরে প্রায় ৭০টি নতুন মেডিকেল সেন্টারের অনুমোদন করিয়ে দেয়। নামে-বেনামে যার বেশির ভাগের মালিকানাতেও রয়েছে এই চক্রের সদস্যরা। সূত্রের দাবি, বর্তমানে দেশের মোট ১৩৩টি মেডিকেল সেন্টারের মধ্যে অন্তত একশটি সেন্টারের শেয়ার রয়েছে চক্রটির সদস্যদের। এ ছাড়া ডিসেম্বরে নতুন করে যেসব সেন্টার অনুমোদন পাবে সেখানেও চক্রটির অংশীদারত্ব রাখার গোপন চুক্তি করেছে।

সূত্র আরও জানিয়েছে, চক্রের বাংলাদেশি সদস্যদের মধ্যে অন্যতম প্রভাবশালী বিশ্বাস জাহাঙ্গীর আলমের ৩১টি, নজরুল ইসলামের ১১টি এবং জেড ইউ সাঈদ-এর ২৫টি মেডিকেল সেন্টারের মালিকানা অথবা অংশীদারত্ব রয়েছে। এসব সেন্টার থেকে আয় করা অর্থের বেশির ভাগই বিদেশে পাচার হয়ে গেছে।

সূত্র জানায়, ভারত-বাংলাদেশের ৭ সদস্যের এই চক্রটি আওয়ামী লীগ সরকারের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ছত্রচ্ছায়ায় থেকে ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে। এমনকি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমন করতেও এই চক্রটি অর্থায়ন করে, এখন তারা রাতারাতি ভোল পাল্টেছে।

জানা গেছে, চক্রের ভারতীয় অংশের চার সদস্যেরই এদেশে মেডিকেল সেন্টার রয়েছে যা বেআইনি। এদেশে তাদের ২২টি সেন্টার রয়েছে বলে সূত্র জানায়। এর মধ্যে আল বুস্তান মেডিকেল সেন্টার ও মোহাম্মদী হেলথ কেয়ার সিস্টেম ও সর্বশ্রেষ্ঠ মেডিকেল সেন্টার নামের তিনটি প্রতিষ্ঠান অবৈধভাবে অনুমোদন করিয়ে নেয়। এ ঘটনায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয় অনুমোদিত ট্রেড অর্গানাইজেশন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব গালফ মেডিকেল সেন্টারস নামের একটি সংগঠন প্রতিবাদ জানালে চক্রটি প্রভাব খাটিয়ে গালফ হেলথ কাউন্সিল থেকে চিঠি এনে উল্টো ওই সংগঠনের কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়।

ভুক্তভোগীদের কয়েকজন জানান, তাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য মাথাপিছু ১০ হাজার টাকা করে নেওয়া হয়। স্বাস্থ্যগত সমস্যা থাকলেও চক্রটির মালিকানাধীন সেন্টারগুলো কর্মীদের কাছ থেকে ফিটনেস সার্টিফিকেট দেওয়ার কথা বলে অতিরিক্তি আরও অর্থ নেয়। সেই ফিটনেস সার্টিফিকেট দিয়ে ভিসা নিয়ে সৌদি আরব পৌঁছালেও সেদেশের মেডিকেল পরীক্ষায় আনফিট বলে ধরা পড়ে। সেদেশে তাদের ভিসা থাকার পরও আনফিট রিপোর্টের কারণে তাদের দেশে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এতে হাজারও বাংলাদেশি কর্মী নিঃস্ব হয়ে দেশে ফিরছেন। গরিবের রক্ত শোষণ করতেই বছর বছর নতুন মেডিকেল সেন্টারের অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন ভুক্তভোগীরা। নতুন করে আর মেডিকেল সেন্টারের অনুমোদন না দিয়ে চক্রের ৭ সদস্যের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা। এদিকে এ ব্যাপারে অভিযুক্তদের বক্তব্য জানার চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি।

Sharing is caring!