প্রকাশনার ১৫ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

৪ঠা ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
১৯শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
২রা জমাদিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি

বন্ধ শ্রমবাজারগুলোর কী হবে?

editor
প্রকাশিত নভেম্বর ২৭, ২০২৪, ০২:২৯ অপরাহ্ণ
বন্ধ শ্রমবাজারগুলোর কী হবে?

 

প্রজন্ম ডেস্ক:

 

ভাগ্য বদলের আশায় গত দুই বছর ধরে বিদেশ যাওয়ার চেষ্টা করছেন মানিকগঞ্জের আলতাফ। প্রথমে চেষ্টা করেন ওমান যেতে। সেখানে যাওয়ার জন্য সব কাগজপত্র তৈরি হলো। পরে খবর এলো— সব ধরনের ভিসা ইস্যু বন্ধ করেছে ওমান সরকার। পরে তিনি চেষ্টা করলেন মালয়েশিয়া যেতে। তাও বন্ধ হয়ে গেলো। বিদেশ যাওয়া আর হলো না আলতাফের।

 

জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর দেওয়া তথ্য মতে, গত ১২ বছরে বন্ধ হয়েছে বেশ কয়েকটি বড় শ্রমবাজার। বাংলাদেশ থেকে ওমান, বাহরাইন, ইরাক, লিবিয়া, সুদান, মালয়েশিয়া, মিশর, রোমানিয়া, ব্রুনাই ও মালদ্বীপে শ্রমিক রফতানি স্থগিত রয়েছে। এর বাইরে ইতালির শ্রমবাজারে ওয়ার্ক পারমিট যাচাইয়ের কাজে ধীরগতি চলছে। সংযুক্ত আরব আমিরাতেও ভিসা ইস্যু বন্ধের কারণে কর্মী যাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। লিবিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের চুক্তি হলেও আনুষ্ঠানিকভাবে কর্মী যাওয়া শুরু হয়নি। এছাড়া মরিশাস বাংলাদেশিদের খুব কম সংখ্যক ভিসা দিচ্ছে।

ইরাকের শ্রমবাজার বন্ধ হয় ২০১১ সালে

 

জনশক্তি রফতানির ব্যাপক চাহিদার ভিত্তিতে ২০০৯ সালের অক্টোবরে ইরাকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ও শ্রম কাউন্সিলর নিয়োগ দেওয়া হয়। ২০০৯ সালের শেষ দিকে এসে আনুষ্ঠানিকভাবে ইরাকে বাংলাদেশের লোক পাঠানো শুরু হয়। এরপর ২০১০ সাল পর্যন্ত ২ হাজারের কিছু বেশি লোক সেখানে গেলেও ২০১১ সালে বন্ধ হয়ে যায়। এরপর আবার ২০১৩ সালে অধিক হারে কর্মী যাওয়া শুরু হয়। ২০১৮ সালের শেষের দিকে বাংলাদেশি কর্মী নিয়োগ কার্যক্রমে নিষেধাজ্ঞা জারি করে ইরাক সরকার। ফলে বৈধ পথে দেশটিতে জনশক্তি রফতানি বন্ধ রয়েছে।

 

২০১৮ সাল থেকে বন্ধ বাহরাইনের শ্রমবাজার

 

২০১৮ সালের ৪ আগস্ট এক বাংলাদেশি বাহরাইনের এক ইমামকে হত্যা করে। এরপর থেকে বাংলাদেশিদের জন্য বন্ধ হয়ে যায় বাহরাইনের শ্রমবাজার। ওই ঘটনার পর উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাংলাদেশিকে দেশে ফেরত পাঠিয়েছে বাহরাইন সরকার।

বাংলাদেশিদের জন্য অন্যতম একটি শ্রমবাজার ছিল বাহরাইন। ১৩ বছরের প্রায় ৩ লাখ কর্মী গেছে দেশটিতে।

 

আরব আমিরাতের শ্রমবাজারে অনিশ্চয়তা

 

সংযুক্ত আরব আমিরাতের শ্রমবাজার বন্ধ না হলেও অনানুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশি কর্মীদের ভিসা দেওয়া বন্ধ রেখেছে আমিরাত সরকার। জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর তথ্য বলছে, গত সেপ্টেম্বর মাসে এই দেশটিতে মাত্র ৬৭৬ জন কর্মী গেছেন। গত জুলাই-আগস্ট মাসে যেসব কর্মী সংযুক্ত আরব আমিরাতে যেতে পারেননি তারাই সেপ্টেম্বরে গেছেন। সেপ্টেম্বরে কোনও ভিসা দেয়নি দেশটি।

জনশক্তি রফতানিকারক ব্যবসায়ীরা বলছেন, কয়েক বছর ধরে কর্মী নেওয়া বন্ধ রয়েছে আমিরাতে। এ ছাড়া জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে প্রবাসীরা অংশ নেওয়ায় এক ধরনের চাপ তৈরি হয়েছে। তবে এই শ্রমবাজার অনানুষ্ঠানিকভাবেই ভিসা বন্ধ রেখেছে। আনুষ্ঠানিক কোনও ঘোষণা আসেনি।

 

মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার বন্ধ হয় একাধিকবার

 

দুর্নীতির অভিযোগে ২০১৮ সালে বাংলাদেশের জন্য বন্ধ হয়ে যায় মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার। এরপর ২০২১ সালের ১৮ ডিসেম্বরে নতুন সমঝোতা চুক্তির মাধ্যমে সেই বাজার খুলতে সময় লেগেছিল ৩ বছর। ২০২২ সালের আগস্টে দেশটিতে আবারও বাংলাদেশি কর্মী যাওয়া শুরু হয়।

বাংলাদেশি কর্মীদের জন্য সৌদি আরবের পর সবচেয়ে জনপ্রিয় শ্রমবাজার হিসেবে পরিচিত ছিল মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার। ২০২২ সালের আগস্ট থেকে ২০২৪ সালের মে পর্যন্ত ৪ লাখ ৯৪ হাজার ১৮০ জন কর্মী মালয়েশিয়ায় গেছেন। কিন্তু সিন্ডিকেটের দুর্নীতি ও অনিয়মের কারণে এই বছরের ৩১ মে বন্ধ হয়ে যায় মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার। এতে বিএমইটির ছাড়পত্র হওয়ার পরও ১৬ হাজার ৯৯০ জন কর্মী যেতে পারেননি। তবে শুধু প্লান্টেশন সেক্টরে কর্মী নিচ্ছে মালয়েশিয়া। এই সেক্টরে কর্মী যাওয়ার হার খুবই কম।

 

চালুর ৩ মাস পর আবার বন্ধ মালদ্বীপের শ্রমবাজার

 

দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে চালু হয় মালদ্বীপের শ্রমবাজার। কিন্তু চালু হওয়ার তিন মাস পরই বন্ধ হয়ে যায় শ্রমিক নেওয়া। এতে ভোগান্তিতে পড়েন দালালের হাতে টাকা দেওয়া কর্মীরা।

গত ২২ মে একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করে মালদ্বীপের বাংলাদেশ হাইকমিশন। এতে বলা হয়, মালদ্বীপ সরকার বাংলাদেশি কর্মীদের জন্য ভিসা দেওয়া বন্ধ রেখেছে। তবে কোটা বাড়ানো ও ভিসা চালু করতে হাইকমিশন চেষ্টা করছে।

 

ভুয়া ওয়ার্ক পারমিট ইস্যুতে ইতালির ভিসা জটিলতা

 

চলতি বছরের ১৭ অক্টোবর বাংলাদেশি কর্মীদের জন্য বন্ধ হয়ে যায় ইতালির শ্রমবাজার। গত ১৭ অক্টোবর ঢাকায় ইতালি দূতাবাস থেকে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে বন্ধের কথা জানানো হয়।

এতে বলা হয়, বিপুলসংখ্যক জাল নথি বা ডকুমেন্টের কারণে ইতালি সরকার এই বছরের ১১ অক্টোবর পর্যন্ত বাংলাদেশসহ কয়েকটি দেশের নাগরিকদের অনুকূলে ইস্যুকৃত সব কর্ম অনুমোদনের (ওয়ার্ক পারমিট) বৈধতা স্থগিত করেছে, যা যথাযথ যাচাইকরণ সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত বলবৎ থাকবে।

ইতালির ভিসাপ্রত্যাশী পারভেজ জানান, ওয়ার্ক পারমিট পাওয়ার পর তিন মাস চেষ্টা করে ফাইল জমা দিতে পেরেছি। ৭ মাস হয়ে গেছে। ভিসা হবে কিনা, ফলাফল কবে পাবো তা জানি না।

 

ভিসা বন্ধ থাকায় একক চাপ সৌদি আরবে

 

সম্ভাবনাময় বিভিন্ন শ্রমবাজারের ভিসা বন্ধ থাকায় অতিরিক্ত অর্থ খরচ করেই সৌদি আরব যাচ্ছেন বাংলাদেশি শ্রমিকরা। গত অক্টোবর মাসে ১ লাখ ৪ হাজার ৮৫৮ জনকে বিএমইটি ক্লিয়ারেন্স দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৮৩ হাজার ৫৮৪ ক্লিয়ারেন্স দেওয়া হয়েছে সৌদি আরবগামী কর্মীদের।

 

শ্রমবাজার নিয়ে গবেষণা সেল অকার্যকর

 

বিএমইটির পক্ষ থেকে ৫৩টি দেশের শ্রমবাজারে কর্মী পাঠানোর সম্ভাবনা নিয়ে একটি গবেষণা করা হয়েছে ২০১৮ সালে। এরপর আর কোনও গবেষণা হয়নি। অনেক বছর ধরে নতুন কোনও শ্রমবাজার তৈরি করা যাচ্ছে না।

গত দেড় দশকে ৯৭টি দেশ থেকে বাড়িয়ে ১৬৮টি দেশে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এর মধ্যে বেশিরভাগ দেশেই কর্মী যাচ্ছে হাতে গোনা। অভিবাসন খাত সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, নতুন সম্ভাবনাময় বাজার ধরতে না পারলে বড় ধরনের ঝুঁকিতে পড়বে দেশের অভিবাসন খাত।

বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজের যগ্ম মহাসচিব মোহাম্মদ ফকরুল ইসলাম বলেন, মন্ত্রণালয়ের শ্রমবাজার নিয়ে গবেষণা সেল অকার্যকর। তারা কোনও কাজ করছে না।

 

নতুন শ্রমবাজার ‘খোঁজা হচ্ছে’

 

প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, বন্ধ থাকা শ্রমবাজার নিয়ে মন্ত্রণালয় কাজ করছে। জর্ডান ও মরিশাসের সঙ্গে কাজ চূড়ান্ত পর্যায়ে আছে। আশা করা যাচ্ছে খুব শিগগরই ব্রুনাইয়ে কর্মী যাবে। একই সঙ্গে নতুন নতুন শ্রমবাজার খোঁজা হচ্ছে। ইতোমধ্যে কর্মী যাওয়া শুরুও হয়েছে।

 

তিনি আরও বলেন, মন্ত্রণালয়ের অনুবিভাগ থেকে শ্রমবাজারের সমস্যা নিরসনে করণীয় বিষয়ে প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে। প্রবাসী কল্যাণ উপদেষ্টা চেষ্টা করছেন এসব বাজার উন্মুক্ত করতে। তিনি ইতোমধ্যে বাজার খোলার বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে কথা বলেছেন।

 

নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর মাইগ্রেশন স্টাডিজের কো-অর্ডিনেটর ড. মো. জালাল উদ্দিন শিকদার বলেন, শ্রমবাজার নিয়ন্ত্রণে সিন্ডিকেট তৈরি হওয়ায় অভিবাসীরা শোষণের শিকার হন। ভুয়া কাগজপত্র দাখিল, নিয়োগে অনিয়ম, অতিরিক্ত অভিবাসন ব্যয়সহ নানা কারণে কয়েকটি দেশ বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিয়োগ স্থগিত করেছে। আবার যেসব দেশে খোলা আছে সেগুলোরও কোনও কোনোটিতে রফতানি কমছে।

 

তিনি আরও বলেন, সরকারি-বেসরকারি খাতে বাংলাদেশের শ্রমবাজার নিয়ে দেশে ও বিদেশে যেসব গবেষণা হয়, তা প্রয়োজনের তুলনায় সামান্য। ফলে ইউরোপে বিভিন্ন খাতে দক্ষ বাংলাদেশি শ্রমিকদের চাহিদা ঠিক কতখানি এবং ভবিষ্যতে এই চাহিদার কোনও পরিবর্তন হবে কিনা, এ সম্পর্কে আমাদের কাছে পরিষ্কার কোনও ধারণা নেই।

Sharing is caring!