প্রকাশনার ১৫ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

৪ঠা ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
১৯শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
২রা জমাদিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি

সড়ক পরিবহনে কতটা পরিবর্তন এলো

editor
প্রকাশিত নভেম্বর ২৭, ২০২৪, ০২:৩২ অপরাহ্ণ
সড়ক পরিবহনে কতটা পরিবর্তন এলো

 

প্রজন্ম ডেস্ক:

সড়ক পরিবহনের ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ সরকারের গত ১৫ বছরে ব্যাপক চাঁদাবাজির অভিযোগ ছিল। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান পরবর্তী অন্তর্বর্তী সরকারের সময় চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ ঘোষণা করেছে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি। গত ১০০ দিনে দুই ধরনের পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়েছে সংগঠনটি। এর মধ্যে প্রাথমিক পরিকল্পনার অংশ হিসেবে চাঁদাবাজি বন্ধ, সুশৃঙ্খল গাড়ি চলাচল, যাত্রীসেবার মান বৃদ্ধি এবং যানজট কমানোর ক্ষেত্রে অগ্রগতি হয়েছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। দ্বিতীয় ধাপের পরিকল্পনায় আন্তজেলা ও মহাসড়কে দুর্ঘটনা কমানোর উদ্যোগসহ গুচ্ছ কর্মসূচি হাতে নেওয়ার চিন্তা-ভাবনা চলছে বলে জানা গেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আওয়ামী লীগ সরকারের গত ১৫ বছরে ঢাকার সড়ক পরিবহনে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেছেন ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ খন্দকার এনায়েত উল্যাহ। তিনি বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতিরও মহাসচিব ছিলেন। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের আগেই বিদেশে পাড়ি দেন খন্দকার এনায়েত উল্যাহ। ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির নিয়ন্ত্রণ চলে যায় পরিবহন নেতা সাইফুল আলমদের হাতে। তারাই এখন পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা ফেরানোর চেষ্টা করছেন, নিচ্ছেন নানা উদ্যোগ। আর খন্দকার এনায়েত উল্যাহ অবস্থান করছেন বিদেশেই, তার সহযোগী অন্য নেতারাও আত্মগোপনে রয়েছেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল আলম বলেন, আমরা দায়িত্ব নেওয়ার পর পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা আনতে বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছি। প্রথম ধাপের উদ্যোগের সুফল মিলছে বা মিলতে শুরু করেছে। প্রথমে আমরা চাঁদাবাজি বন্ধসহ নানা পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছি। দ্বিতীয় ধাপে আরও কিছু উদ্যোগ নেওয়া হবে। আন্তজেলা ও মহাসড়কে দুর্ঘটনা কমানোসহ আরও কিছু উদ্যোগ থাকবে।

ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির একাধিক নেতা বলেছেন, পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা আনতে দুই ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এটি সরকারি প্রচেষ্টায় না হওয়ায় ঠিক সংস্কার বলা যাবে না। তবে পরিবর্তন ও পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে। প্রথম ধাপের পরিকল্পনা এখনও চলমান থাকায় তার ফলাফলের ওপর নির্ভর করছে দ্বিতীয় ধাপের সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নের বিষয়টি।

আশরাফুল নামে ট্রান্সসিলভা পরিবহনের একটি বাসের চালক বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পরিবহনে চাঁদাবাজি কমেছে। তবে একেবারে বন্ধ হয়নি। নানাভাবে চাঁদা নেওয়া হয়, তা পুরোপুরি বন্ধ করতে হলে আরও অনেক কিছু করতে হবে। তবে আগের সরকারের সময়ের চেয়ে এখন পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি হয়েছে। কিন্তু সড়কে আন্দোলন বেড়ে গেছে। তাই যানজটও বাড়ছে।

ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির নেতাদের দাবি, ঢাকার সড়ক পরিবহনে কোনও চাঁদাবাজি হচ্ছে না এখন। অ্যাসোসিয়েশনের নামে ঢাকার টার্মিনালে কোনও চাঁদা তুলতে দেবো না। কোথাও চাঁদাবাজির তথ্য পেলে সেখানে অ্যাকশনে যাচ্ছি। গত ১০০ দিনে এটা একটা বড় উন্নতি। বাস টার্মিনালে যাত্রীদের টানাহেঁচড়া বন্ধ হয়েছে, কমিউনিটি ট্রাফিকের দায়িত্বপ্রাপ্তরা সেটি নিশ্চিত করছেন। যানজট নিরসনে ট্রাফিক পুলিশের সঙ্গে কাজ করছেন কমিউনিটি ট্রাফিক। তবে নানা দাবিতে প্রায় প্রতিদিন বিভিন্ন পক্ষ সড়ক অবরোধ করে আন্দোলন করায় যানজট নিরসনের উদ্যোগেও কাঙ্ক্ষিত সুফল মিলছে না।

সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির নতুন নেতৃত্ব ট্রাফিক পুলিশ, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ), ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন, বাস কোম্পানিগুলো, শ্রমিকদের সঙ্গে ধারাবাহিকভাবে সমন্বয় সভা এবং পরিবহন সংশ্লিষ্টদের নিয়ে মোটিভেশনাল কাউন্সিলিং সভা করা হচ্ছে। এসব সভা ছোট এবং বড় আকারে করা হচ্ছে। কোম্পানিগুলোকেও মালিক ও শ্রমিকদের নিয়ে বসার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তারাও তাদের মতো করে বসছে। এমনটি আগে হতো না।

সাইফুল আলম বলেন, ঢাকার সব বাস টার্মিনাল সংশ্লিষ্টদের নিয়ে কেন্দ্রীয়ভাবে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে সভা করা হয়। মাসে দুবার করে এমন মিটিং করছে কোম্পানিগুলো। ফুলবাড়িয়া, গুলিস্তান, সায়েদাবাদ, মহাখালী, মিরপুর টার্মিনালে ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন ধরনের সভা করা হচ্ছে এবং হবে। পুলিশের ট্রাফিকের লোকজন, সিটি করপোরেশনের লোকজন, বাস মালিক ও শ্রমিকসহ সব অংশীজনের অংশগ্রহণে এসব সভা হয়।

সমিতির পক্ষ থেকে নেওয়া প্রাথমিক পরিকল্পনায় জোর দেওয়া হয়েছে—নির্দিষ্ট স্থানে গাড়ি দাঁড় করিয়ে যাত্রী ওঠানামা করানো, সড়কের মোড়গুলোতে গাড়ি দাঁড় করিয়ে যাত্রী ওঠানামা না করানো, যাত্রী তুলতে বা নামানোর সময় সড়কের মাঝখানে গাড়ি দাঁড় না করানো, যাত্রী না থাকার পরও সড়কে গাড়ি দাঁড় করিয়ে না রাখা, আগে যাওয়ার অসুস্থ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত না হওয়া, যাত্রীদের সঙ্গে হেলপার-কন্ডাক্টরের ভালো ব্যবহার করা, শ্রমিকদের সঙ্গে বাস মালিকদের ভালো ব্যবহার।

সাইফুল আলম বলেন, বাস কোথায় দাঁড়াবে, সেটি নির্ধারণ করা নেই। স্টপেজ ঠিক করে সাইনবোর্ড লাগিয়ে দিতে বলা হয়েছে তিন মাস আগে, এখনও সেটি করা হয়নি। এ কারণে বাস চলাচল ও যাত্রীসেবায় সমস্যা হচ্ছে। আমরা সিটি করপোরেশনকে এও বলেছি, তারা না পারলে আমরা বিভিন্ন কোম্পানির পক্ষ থেকে সাইনবোর্ড লাগিয়ে দেবো।

ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা প্রয়োজনের চেয়ে বেশি রয়েছে উল্লেখ করে একাধিক পরিবহন নেতা বলেন, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার সংখ্যা কমানো এবং প্রধান প্রধান সড়ক থেকে তুলে দেওয়ার অনুরোধ করা হয়েছে। এটি নিয়ে ট্রাফিক পুলিশ চেষ্টা করছে। কিন্তু সিটি করপোরেশন বলছে, প্রয়োজনের চেয়ে অনেক গুণ বেশি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চলছে। তবে সেই সংখ্যাটা বলা যাচ্ছে না।

ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির তথ্য বলছে, বাস টার্মিনাল ও এর আশপাশের এলাকায় ট্রাফিক পুলিশের সঙ্গে সমন্বয় করে দায়িত্ব পালনের জন্য সমিতির পক্ষ থেকে কমিউনিটি ট্রাফিক হিসেবে লোকবল দেওয়া হয়েছে। মালিকদের প্রতিনিধিও থাকছে, যাতে ট্রাফিক আইন ভালোভাবে পালন করা হয়। মিরপুর ১ ও ১০ নম্বরে ৪০ জন, ফুলবাড়িয়ায় ৫০ জন, গুলিস্তানে ৩০ জন, যাত্রাবাড়ীতে ৩০ জন, মহাখালীতে ৩০ জন, সায়েদাবাদে ৪০ জন কমিউনিটি ট্রাফিক কাজ করছেন। দুই মাসের জন্য নিয়োগ দেওয়ায় কোথাও কোথাও মেয়াদ শেষ হওয়ায় আবার নতুন করে নিয়োগ দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

কমিউনিটি ট্রাফিকের খাওয়া ও বেতন বাস মালিকদের পক্ষ থেকে বহন করা হচ্ছে জানিয়ে সাইফুল আলম বলেন, কোম্পানিগুলোকে সম্পৃক্ত করে যাত্রাবাড়ী থেকে উত্তরা পর্যন্ত সব পয়েন্টে কমিউনিটি ট্রাফিক দেওয়া হবে। তারা ট্রাফিক পুলিশের সঙ্গে সমন্বয় করে দায়িত্ব পালন করবেন।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) খোন্দকার নাজমুল হাসান বলেন, ‘ঢাকায় সাড়ে ৪ হাজার বাস চলাচল করে। ২৩ হাজার মামলা হলে ভাগে কয়টা পড়ে বলুন। আগে এক মাসে মামলা হয়েছে ১৪১টা, আর ১০০ দিন পর মাসে হচ্ছে ৩৬ হাজার। এই মাসে হয়তো আরও বেশি হবে মামলা। অর্থাৎ ট্রাফিক এনফোর্সমেন্টে একটা বড় পরিবর্তন এসেছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘যানজট নিরসনে আমরা সচেষ্ট আছি। মানুষ যাতে কিছুটা স্বস্তিতে গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে, সেজন্য আমরা আমাদের কাজ করছি। পুলিশের ইঞ্জিনিয়ারিং কাজ যেটুকু থাকে, সেটা করছি। আমাদের হাতে যে সরঞ্জাম ছিল, সেগুলো দিয়ে যে পরিবর্তন করা যায় সেটি করেছি। ফলে কিছু পরির্বন তো আছেই, সুফল তো মানুষ পাচ্ছে।’

Sharing is caring!