প্রকাশনার ১৬ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

৭ই ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
২২শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
১৬ই জমাদিউস সানি, ১৪৪৭ হিজরি

কী আছে রাজসাক্ষী সুনামগঞ্জের মামুনের ভাগ্যে

editor
প্রকাশিত নভেম্বর ১১, ২০২৫, ০৮:৩১ পূর্বাহ্ণ
কী আছে রাজসাক্ষী সুনামগঞ্জের মামুনের ভাগ্যে

Manual6 Ad Code

স্টাফ রিপোর্টার:
পুলিশের সর্বোচ্চ পদে ছিলেন চৌধুরী সুনামগঞ্জের আবদুল্লাহ আল-মামুন। তার আমলেই সংঘটিত হয়েছিল চব্বিশের জুলাই গণহত্যা। ছাত্র-জনতার এ আন্দোলন ঘিরে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ, নির্বিচার গুলি কিংবা নৃশংসতার যেন কোনো ইয়াত্তা ছিল না। আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটতেই কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে আসে তৎকালীন এই আইজিপির নাম। তবে, মানবতাবিরোধী অপরাধের একটি মামলায় আসামি হিসেবে থাকলেও দায় কাঁধে নিয়ে তিনি রাজসাক্ষী হয়ে যান।

আদালতে দাঁড়িয়ে সাক্ষ্য দিয়েছেন নিজেরই একসময়ের কর্তা শেখ হাসিনা আর আসাদুজ্জামান খান কামালের বিরুদ্ধে। সামনে এনেছেন বহু অজানা তথ্য। সত্য উদঘাটনের বিনিময়ে কি তিনি খালাস পাচ্ছেন, নাকি পূর্ণ সাজা পাচ্ছেন— এমন জল্পনা অনেকের মনে উঁকি দিচ্ছে।

Manual4 Ad Code

১৯৬৪ সালের ১২ জানুয়ারি সুনামগঞ্জের শ্রীহেলা গ্রামের মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন আবদুল্লাহ আল মামুন। তার গ্রামের বাড়ি সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার শ্রীহাইলে।

Manual1 Ad Code

তথ্য বলছে, জুলাই-আগস্টে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বেশ কয়েকটি মামলা চলছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে। এর মধ্যে একটি মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের বিচারকাজ সম্পন্ন হয়েছে। অর্থাৎ যুক্তিতর্ক শেষে এখন মামলাটি রায়ের অপেক্ষায়। সেই দিনক্ষণ ঠিক হবে আগামী ১৩ নভেম্বর। এর সপ্তাহখানেকের মধ্যেই পাওয়া যেতে পারে চূড়ান্ত ফলাফল। এ মামলায় হাসিনা-কামালের চরম দণ্ড বা সর্বোচ্চ সাজা চাইলেও, মামুনের শাস্তি নিয়ে ট্রাইব্যুনালের সিদ্ধান্তের ওপর ছেড়ে দিয়েছে প্রসিকিউশন। এমনকি তার অ্যাকুইটাল (খালাস) চেয়েছেন নিজের অর্থে নিয়োগ করা আইনজীবী যায়েদ বিন আমজাদ।

ট্রাইব্যুনাল সূত্র জানায়, চলতি বছরের ১০ জুলাই হাসিনা-কামাল-মামুনের বিচার শুরুর আদেশ দেওয়া হয়। আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করে এ আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেল। ওই দিন তাদের বিরুদ্ধে আনা পাঁচটি অভিযোগ পড়েন বিচারক মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী। তখন অনেকটা অনুতপ্তের ছাপ দেখা যায় আসামির কাঠগড়ায় থাকা মামুনের কপালে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ‘দোষী নাকি নির্দোষ’— এমন কথা জানতে চাওয়া হয়। আদালতকে জবাব দিতে পকেটে রাখা এক টুকরো কাগজ দেখে বেশ জোরালো কণ্ঠে দায় স্বীকার করে নেন পুলিশের সাবেক এই মহাপরিদর্শক। যুক্তিতর্ক শেষে এখন মামলাটি রায়ের অপেক্ষায়। সেই দিনক্ষণ ঠিক হবে আগামী ১৩ নভেম্বর। এর সপ্তাহখানেকের মধ্যেই পাওয়া যেতে পারে চূড়ান্ত ফলাফল।

‘অ্যাপ্রুভার’ বা রাজসাক্ষী হয়ে সবকিছু প্রকাশ করার কথাও তিনি ট্রাইব্যুনালকে জানান। ইংরেজিতে তিনি বলেছিলেন, ‘আই প্লিড গিল্টি। আই অ্যাম উইলিং টু ভলান্টারি ডিসক্লোজ ট্রু অ্যান্ড ফুল ডিসক্লোজার অব দ্য হোল অব দ্য সারকামস্ট্যান্সেস উইদিন মাই নলেজ রিলেটিং টু দ্য ইনস্ট্যান্স কেস।’ যার বাংলায় অনেকটা এমন দাঁড়ায়— ‘আমি দোষ স্বীকার করছি। আমি স্বেচ্ছায় সত্য প্রকাশ করব। এ মামলার সঙ্গে সম্পর্কিত আমার জানা সব পরিস্থিতির কথা তুলে ধরব।’ এরই পরিপ্রেক্ষিতে ২ সেপ্টেম্বর ট্রাইব্যুনালে সাক্ষীর ডায়াসে দাঁড়িয়ে সব ফাঁস করে দেন চৌধুরী মামুন। জুলাই-আগস্ট গণহত্যাযজ্ঞ ঘিরে শেখ হাসিনার সরকারের নীলনকশা, আন্দোলন দমনে ছক কষতে প্রতি রাতে আসাদুজ্জামান খান কামালের বাসায় হওয়া বৈঠক, গ্যাং অব ফোরের সদস্যদের নামসহ অনেক অজানা তথ্যের ঝাঁপি খোলেন তিনি। মারণাস্ত্র ব্যবহারে অতি-উৎসাহী ডিএমপির তৎকালীন কমিশনার হাবিবুর রহমান ও ডিবিপ্রধান হারুন অর রশীদকে নিয়েও দেন বিস্ফোরক তথ্য।

ডিএমপির এই সাবেক কমিশনার ও এসবিপ্রধান মনিরুল ইসলামের নেতৃত্বে পুলিশ বাহিনীতে দুটি গ্রুপ গড়ে উঠেছিল বলেও জবানবন্দিতে জানিয়েছেন মামুন। এছাড়া, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের তুলে আনার প্রস্তাবদাতাদের নাম, হেলিকপ্টার-ড্রোন ওড়ানো, র‌্যাবের টাস্কফোর্স ইন্টারোগেশন (টিএফআই) সেল কিংবা আয়নাঘরখ্যাত গোপন বন্দিশালায় বিরোধী মতাদর্শের লোকদের তুলে নিয়ে নির্মমতার বিবরণও তুলে ধরেন ট্রাইব্যুনালের সামনে। এমনকি গোপালগঞ্জ বলয় দ্বন্দ্ব ঢাকতে আইজিপি পদে নিজের মেয়াদ পরপর দুবার বাড়ানো হয় বলেও জানান তিনি। সবশেষ পুলিশে ৩৬ বছরের কর্মজীবনের কথা টেনে গণহত্যার শিকার প্রত্যেক পরিবার-আহতসহ ট্রাইব্যুনালের কাছে ক্ষমা চান এই রাজসাক্ষী।

Manual8 Ad Code

সূত্রমতে, ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট আন্দোলন ঘিরে দেশের ৪১ জেলার ৪৩৮ স্থানে হত্যাকাণ্ড ঘটে। ৫০-এরও বেশি জেলায় ব্যবহৃত হয় মারণাস্ত্র। গুলি ছোড়া হয়েছিল ৩ লাখ ৫ হাজার ৩১১ রাউন্ড। শুধুমাত্র ৯৫ হাজার ৩১৩ রাউন্ড গুলি ছোড়া হয়েছিল ঢাকায়। মানুষের প্রাণ কাড়তে ব্যবহৃত হয়েছিল এলএমজি, এসএমজি, চাইনিজ রাইফেল, শটগান, রিভলভারসহ অন্যান্য অস্ত্র। এর মধ্যে ছাত্র-জনতার ওপর নির্বিচারে সবচেয়ে বেশি গুলি চালানোর অভিযোগ পুলিশের দিকে। নিজের মেয়াদকালে হওয়ায় এমন দায় কোনোভাবেই এড়াতে পারেন না সাবেক আইজিপি মামুন। কারণ, আন্দোলন দমনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কামালের বাসায় নিয়মিত হওয়া সব ধরনের ষড়যন্ত্র-পরিকল্পনার বৈঠকে তিনিও অংশ নিতেন। সেক্ষেত্রে বাকি অপরাধীদের মতোই তার সাজা হওয়া উচিত বলে মনে করেন কেউ কেউ।

Manual4 Ad Code

পেশাগত জীবনে আওয়ামী লীগ সরকারের অন্য আইজিপিদের চেয়ে চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন কিছুটা ব্যতিক্রম ছিলেন। নিষ্ঠাবান হওয়ায় বাহিনীর অনেকে ব্যক্তিগতভাবে তাকে পছন্দ করতেন। তবে জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে চাইলেই তিনি কিছু একটা করতে পারতেন। কারণ, পুরো বাহিনী তার অধীনে ছিল। কিন্তু তিনি সেটা করেননি। বরং প্রধান হিসেবে তার প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ নির্দেশেই ছাত্র-জনতার ওপর গুলি ছুড়তে অতি-উৎসাহী হয়ে ওঠেন অধস্তনরা। এখন মানবতাবিরোধী অপরাধের মতো জঘন্য অপরাধ করে রাজসাক্ষী হয়ে যদি নিস্তার বা কম সাজা পান, তাহলে যারা গ্রেপ্তার রয়েছেন, তাদের মাঝে এক ধরনের প্রশ্ন জাগবে।

সাবেক পুলিশপ্রধান হিসেবে রাজসাক্ষী হয়ে চৌধুরী মামুন যে জবানবন্দি দিয়েছেন, তা তার বাস্তব অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল মূল্যায়ন করবেন বলে মত দিয়েছেন আইন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, গ্রহণযোগ্য রায় এলে মানুষের সঙ্গে দূরত্ব ঘোচার পাশাপাশি পুলিশের মনোবল বৃদ্ধিসহ ভবিষ্যতে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা যাবে। তাই অভিযুক্ত ব্যক্তিদের কর্মকাণ্ডের মাত্রা অনুযায়ী সঠিক সাজার মাধ্যমে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে। এতে যেন প্রমাণ হয়, কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়।

Sharing is caring!

Manual1 Ad Code
Manual5 Ad Code