প্রকাশনার ১৬ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

১৯শে ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
৪ঠা পৌষ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
২৮শে জমাদিউস সানি, ১৪৪৭ হিজরি

পাসপোর্ট সেবায় কমছে ভোগান্তি

editor
প্রকাশিত মার্চ ৬, ২০২৫, ১০:০২ পূর্বাহ্ণ
পাসপোর্ট সেবায় কমছে ভোগান্তি

Manual5 Ad Code

 

প্রজন্ম ডেস্ক:

রাজধানীর আগারগাঁওয়ের পাসপোর্ট ভবন। গতকাল বুধবার (৫ মার্চ) যাই সেখানে। দুপুর তখন ১২টা। আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের ভেতরে যেতেই দেখা মেলে নারী ও পুরুষের আলাদা লাইন। কেউ এসেছেন নতুন পাসপোর্টের আবেদন নিয়ে, কেউবা নবায়নের জন্য, আবার কেউ লাইনে ছিলেন ফিঙ্গারপ্রিন্ট ও ছবি তোলার জন্য। কিন্তু কোনো লাইনেই তেমন ভিড় ছিল না। বেশ সাবলীলভাবেই এগোচ্ছে সেবাগ্রহীতাদের সেবা দেওয়ার কাজ। প্রায় দুই ঘণ্টা অবস্থান করেও পাসপোর্ট অফিসের সেই চিরচেনা বিড়ম্বনা ও ভোগান্তির চিত্র দেখা যায়নি।

এ সময় সেবা নিতে আসা ব্যক্তিরাও বলেছেন, পাসপোর্ট অফিসের ভোগান্তি আগের চেয়ে বহুলাংশে কমেছে। সেবা ও আন্তরিকতার ক্ষেত্রেও পরিস্থিতির অনেক উন্নতি হয়েছে। বিশেষ করে পাসপোর্ট পেতে পুলিশ ভেরিফিকেশন বাতিল হওয়ার পর বিড়ম্বনামুক্ত হয়েছেন সেবাপ্রত্যাশীরা।

তারা বলেছেন, ‘পাসপোর্ট করার জন্য নাগরিকদের নানাবিধ তিক্ত অভিজ্ঞতার মধ্যে অন্যতম ছিল পুলিশ ভেরিফিকেশন। কারণ, পাসপোর্ট করতে গিয়ে আগে পুলিশ ভেরিফিকেশন বাধ্যতামূলক থাকার সুযোগে স্পেশাল ব্রাঞ্চের (এসবি) পুলিশ কর্মকর্তা বা সদস্যকে কথিত বকশিশের নামে টাকা (ঘুষ) দিতে হতো প্রায় সবাইকেই। টাকা না দিলে বা মনমতো বকশিশ না পেলে অনেক সময় তারা নানা বিড়ম্বনার সৃষ্টি করতেন। এমন বাস্তবতায় গত ১৮ ফেব্রুয়ারি পাসপোর্ট করার ক্ষেত্রে পুলিশ ভেরিফিকেশনের পদ্ধতি বাতিল করে দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।’

ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক সেলিনা বানু বলেন, ‘নতুন দায়িত্বশীল অফিসার এসেছেন। ফলে পাসপোর্ট অফিসের কাজের গতি বেড়েছে। আমরা পেশাদারত্বের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছি। এখন সেবাগ্রহীতাদের কোনো অভিযোগ নেই বললেই চলে। পুলিশ ভেরিফিকেশন বাতিলের বিষয়ে তিনি বলেন, পুলিশ ভেরিফিকেশনের কারণে অনেক জটিলতা ছিল। আমরা এমনও অভিযোগ শুনেছি, ঘুষ না দেওয়ার কারণে পাসপোর্ট ছাড়া হচ্ছে না। এখন যেহেতু পুলিশ ভেরিফিকেশন বাতিল করা হয়েছে সে ক্ষেত্রে সেবা গ্রহীতারা দ্রুত পাসপোর্ট পাবেন।’

 

Manual7 Ad Code

সেবা গ্রহীতাদের মাঝে স্বস্তি

গতকাল সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, পাসপোর্টের জন্য অনেকে এসেছেন। নারী ও পুরুষদের জন্য আলাদা লাইন। অনেকটা শৃঙ্খলভাবেই চলছে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম।

এ সময় মেয়ে ও নিজের জন্য পাসপোর্ট করতে এসেছিলেন ডা. ফাহমিদা। তিনি বলেন, ‘অল্প সময়ে পাসপোর্ট অফিসের প্রায় সব কাজ শেষ হয়েছে। এখন শুধু ছবি তোলা ও ফিঙ্গারপ্রিন্ট দেওয়া বাকি আছে। এখানে আসার আগে ভোগান্তি বা দুর্ভোগের বিষয়ে যেভাবে ভয় পেয়েছিলাম, সেটা অবশ্য হয়নি।’

পুলিশ ভেরিফিকেশন বিষয়ে তিনি বলেন, ‘পুলিশ ভেরিফিকেশন বন্ধ হওয়াতে খুবই ভালো হয়েছে। এই জন্য আমি তো বর্তমান সরকারকে সাধুবাদ জানাব। মানুষের হয়রানি ও ঘুষবাণিজ্য বন্ধ হয়েছে। জাতীয় পরিচয়পত্র থাকলে পুলিশ ভেরিফিকেশনের প্রয়োজন কি? বরং জাতীয় পরিচয়পত্র যাতে সঠিকভাবে হয় এবং রোহিঙ্গারা যাতে চাইলেই সেটা করতে না পারে সেদিকেই নজর দেওয়া জরুরি।’

ওই দিন পাসপোর্টের নতুন আবেদন নিয়ে পুরুষ লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আরিফুর রহমান। পরিবারের সঙ্গে মিরপুর এলাকায় বসবাস করা আরিফুর রহমান আলাপকালে বলেন, ‘উচ্চশিক্ষার জন্য তিনি বিদেশে যাবেন। এ জন্য পাসপোর্টের আবেদন ফরম জমা দেওয়ার তারিখ পেয়ে সেটি জমা দিতে এসেছেন। শুরুতে বড় লাইন হলেও অল্প সময়েই দেখলাম লোকজন কমে গেল। ভেরিফিকেশন বাতিল প্রসঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, এখানে যেটা দেখলাম- জাতীয় পরিচয়পত্রের সঙ্গে ফরমের তথ্য যাচাই-বাছাই করে দেখা হচ্ছে। তথ্য সঠিক থাকলে আর কোনো সমস্যা নেই। পুলিশ ভেরিফিকেশন আরও আগেই বাতিল করা প্রয়োজন ছিল। সহজে পাসপোর্ট পাওয়া যাবে। এতে মানুষ উপকৃত হবে।

কমেছে দালালদের দৌরাত্ম্য

‘নতুন না পুরাতন, সবার আগে পাসপোর্ট পাবেন, পুলিশ ভেরিফিকেশনের সুবিধাও আছে’- এই জাতীয় নানা চটকদার কথা দিয়ে দালালরা আগে পাসপোর্ট অফিসের সামনে বা আশপাশে ভিড় করে থাকতেন। কিন্তু গতকাল দালালদের সেই দৌরাত্ম্য তেমন চোখে পড়েনি। নানাবিধ প্রশ্নে সেবাগ্রহীতাদের এক সময় অতিষ্ঠ করতেন দালালরা। সেখানে এখন প্রেক্ষাপট অনেকটাই ভিন্ন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর নজদারি ও পাসপোর্ট কর্তৃপক্ষের পদক্ষেপের কারণে দালালদের দৌরাত্ম্য আগের চেয়ে কমেছে। আগে মূল প্রবেশপথে এমন ভিড় থাকত যে গায়ে গা-ঘেঁষে ঢুকতে হতো, এখন চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। চলাফেরাতেও এখন রয়েছে স্বস্তি।

Manual3 Ad Code

মূল প্রবেশপথে দায়িত্বরত একাধিক পুলিশ সদস্য জানান, পাসপোর্ট অফিসের সেবা অনেক বদলে গেছে। এখন যারা সেবা নিতে আসেন তাদের তেমন কোনো অভিযোগ নেই বললেই চলে। সেবা গ্রহীতাদের সব ধরনের সহযোগিতা দিতে প্রস্তুত বলে মন্তব্য করে তারা বলেন, ‘দালালদের বিষয়েও আমরা সতর্ক আছি।’

Manual3 Ad Code

পাসপোর্ট অফিসের বিপরীত পাশের চায়ের দোকানদার রহিম বলেন, ‘পাসপোর্ট অফিসে এখন ভিড় আগের চেয়ে কমে গেছে। আগে প্রচণ্ড ভিড় থাকত। এ ছাড়া আগে যারা পাসপোর্টের ফরম পূরণের নামে দালালি করত তাদের সংখ্যাও এখন হাতে গোনা।

রোহিঙ্গা ও অপরাধীদের ঠেকাতে বায়োমেট্রিক্স নিশ্চিত করা জরুরি

বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ১২ লাখের বেশি রোহিঙ্গা নাগরিক (মায়ানমারের বাস্তুচ্যুত) বসবাস করছেন। তাদের ভাষা ও সংস্কৃতি চট্টগ্রাম-কক্সবাজার অঞ্চলের সঙ্গে অনেকখানি সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়ায় খুব সহজেই তারা বাংলাদেশি হিসেবে প্রতারণা করতে পারছেন। এ কারণে রোহিঙ্গাদের জাতীয়তা শনাক্ত করাও মাঝে মধ্যে কঠিন হয়ে যায়। অভিযোগ আছে, এই সুযোগ নিয়ে বাংলাদেশি নাগরিক হিসেবে জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়েছেন লাখো রোহিঙ্গা। শুধু কক্সবাজার নয়, অনেক দূরবর্তী জেলায় গিয়েও তারা নানা উপায়ে জাতীয় পরিচয়পত্র সংগ্রহ করছেন বলে অভিযোগ আছে। তারা দেশের দূরবর্তী বিভিন্ন জেলায় গিয়ে জন্ম নিবন্ধন, ইউনিয়ন চেয়ারম্যানের সিল-স্বাক্ষর বানিয়ে বা জাল করে অনেক রোহিঙ্গা নাগরিক বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়েছেন।

সম্প্রতি কোস্ট গার্ডের একটি অনুষ্ঠানে গিয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, জনগণকে ভোগান্তি থেকে রক্ষা করতে পাসপোর্টের ভেরিফিকেশন তুলে দেওয়া হয়েছে। অনেক দিনের চিন্তাভাবনা থেকেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তিনি বলেন, ‘যাদের জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) আছে, তাদের জন্য পুলিশ ভেরিফিকেশন দরকার হবে না। রোহিঙ্গারা যেন এনআইডি না পায় সে ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

তবে রোহিঙ্গা ও পেশাদার বা চিহ্নিত অপরাধীরা যেন অবৈধভাবে পাসপোর্ট বানাতে না পারেন সে জন্য বায়োমেট্রিক্স পদ্ধতি বাধ্যতামূলক করার দাবি জানিয়েছেন পোসপোর্ট অধিদপ্তর, পুলিশসহ সংশ্লিষ্টরা। আঙুলের ছাপ, চোখের আইরিশ ডেটাবেজে সংরক্ষণের মাধ্যমে এ ধরনের অপরাধীদের ঠেকানো সম্ভব বলেও মত দিয়েছেন তারা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে পরিচালক পদমর্যাদার পাসপোর্ট অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘পাসপোর্টে পুলিশে ভেরিফিকেশনের কোনো প্রয়োজন নেই। ভেরিফিকেশন থাকার পরেও তো কয়েক লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশি পাসপোর্ট বানিয়েছেন।’ ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের ঠেকাতে যে কাজটি আমাদের প্রথম করা প্রয়োজন তা হলো- যখন তারা সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশি এলাকায় প্রবেশ করছে, তখনই সেনাবাহিনীর ক্যাম্প বা যারাই দায়িত্বে আছেন তাদের সেখানকার ক্যাম্পেই সর্বপ্রথমে আঙুলের ছাপ, চোখের আইরিশের ছবিসহ একটি ডেটাবেজ তৈরি করতে হবে। হয়তো এ কাজ কিছুটা হয়, কিন্তু সেটা যথাযথ বা নিশ্চিত করতে হবে।’

চিহ্নিত অপরাধী প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘কোনো এলাকায় অপরাধী ধরা পড়লে সংশ্লিষ্ট থানায় তার আঙুলের ছাপসহ একটি ডেটাবেজ তৈরি করতে হবে। পরে পাসপোর্ট অফিস ও নির্বাচন কমিশনের অফিসের সঙ্গে ওই ডেটাবেজের একটি লিংক তৈরি করা জরুরি। এই কাজটি করতে পারলে সহজে রোহিঙ্গা বা চিহ্নিত অপরাধী শনাক্ত করা সম্ভব হবে। ফলে আলাদা করে ভেরিফিকেশনের প্রয়োজন নেই।’

এ বিষয়ে পুলিশের বিশেষ শাখার একজন কর্মকর্তা (বিশেষ পুলিশ সুপার) বলেন, ‘পাসপোর্টে ভেরিফিকেশনের কোনো প্রয়োজন নেই। বিগত সরকারগুলো এই সিদ্ধান্ত নিতে না পারলেও অন্তর্বর্তী সরকার নিয়েছে। এতে একদিকে যেমন মাঠপর্যায়ে এক শ্রেণির পুলিশ সদস্যের ঘুষবাণিজ্য বন্ধ হয়েছে, তেমনি মানুষও হয়রানি-বিড়ম্বনামুক্ত হয়েছে।’

Manual7 Ad Code

Sharing is caring!

Manual1 Ad Code
Manual7 Ad Code