প্রকাশনার ১৬ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

১৮ই ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
৩রা পৌষ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
২৭শে জমাদিউস সানি, ১৪৪৭ হিজরি

মানহীন চালে বাজার সয়লাব

editor
প্রকাশিত মে ৪, ২০২৫, ১০:৩২ পূর্বাহ্ণ
মানহীন চালে বাজার সয়লাব

Manual5 Ad Code

 

প্রজন্ম ডেস্ক:

বাজারে নজর কাড়া বাহারি নাম ও ব্র্যান্ডের চাল পাওয়া যায়। কিন্তু এসব চালের ভাত খেতে স্বাদহীন। আগের মতো আর ঘ্রাণও মেলে না। বেশিরভাগ ব্র্যান্ডের চাল রান্নার ২/৩ ঘণ্টার মধ্যে ভাত নষ্ট হয়ে যাওয়া বা ভাত ভিজে ওঠার অভিযোগ রয়েছে। চালের ঊর্ধ্বমূল্যের সঙ্গে ক্রেতাদের এসব অভিযোগের কোনও জবাব পাওয়া যায় না বিক্রেতাদের কাছে। রাজধানীর কয়েকটি চালের বাজার ঘুরে ক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে এসব অভিযোগ মিলেছে।

জানা গেছে, রাজধানীতে উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারের কাছে বেশিদামের মিনিকেট ও নাজির শাইল চালের কদর বরাবরই ছিল, এখনও আছে। সরু ধরনের এই চালের ভাত সাধারণত ঝরঝরে হয়ে থাকে। কিন্তু এই দুটি ব্র্যান্ডের চাল নিয়েও এখন অভিযোগের শেষ নেই।

ক্রেতারা বলছেন, মিনিকেট চাল দেখতে যতটা সরু এই চালের ভাত এখন ততটা সরু হয় না। এছাড়া এ চালের ভাতে এখন আর কোনও ঘ্রাণও নেই। বেশি দাম দিয়ে কিনেও এর কোনও বৈশিষ্ট্য খুঁজে পান না ক্রেতারা। অনেকেই মনে করেন, এখনকার মিনিকেট চালের ভাত স্বাদে অনেকটাই ইরি চালের ভাতের মতো। রান্না করার ২/৩ ঘণ্টার মধ্যেই ভাতে ভেজা ভেজা ভাব চলে আসে।

অপরদিকে নাজির শাইল চাল উচ্চমধ্যবিত্ত পরিবারের কাছে সব সময়ই কদর পেয়ে আসছে। এ কারণেই বেশি দাম হলেও এই চাল নিয়ে ক্রেতাদের তেমন কোনও আপত্তির কথা শোনা যায়নি। ইদানিং ক্রেতারা নাজির শাইল নিয়েও অভিযোগ তুলছেন। তারা বলছেন, এখনকার নাজির শাইল চালের ভাতের রঙ কালচে, আগের মতো ধবধবে সাদা হয় না। বরং রান্নার ২/৩ ঘণ্টার মধ্যে বাজে গন্ধ ছড়ায় এবং খাওয়ার অযোগ্য হয়ে পড়ে। অর্থাৎ ভাত নষ্ট হয়ে যায়।

Manual3 Ad Code

বাজারে নানা নামে নানা ব্র্যান্ডের চাল পাওয়া গেলেও এখন আর আউশ, আমন, ইরি, বোরো চালের সচারচর দেখা মেলে না। তবে কোনও কোনও সুপারসপে আউশ-আমন চাল বিক্রি হলেও দাম কেজিপ্রতি ১০০ টাকার ওপরে। বাজারে বেশি পাওয়া যায়, মিনিকেট, নাজির শাইল, পাইজাম আর বিআর ২৮। এসব জাতের চালের উৎপাদন নিয়ে আছে নানা বিতর্ক। সরকারি তরফে বহুদিন আগে থেকেই বলা হচ্ছে যে, মিনিকেট নামে দেশে ধানের কোনও জাত নেই। মিনিকেট আসলে ইরি চাল, যা মেশিনে কেটে চিকন করে ক্রেতাদের আগ্রহ বাড়িয়ে বেশি দামে বিক্রি করা হচ্ছে।

অপরদিকে নাজির শাইল নামে যে চাল রাজধানীসহ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিক্রি হচ্ছে, সেটা নিয়েও আছে নানা কথা রয়েছে। এই চালের ধানের আসল জাত কী তা পরিষ্কার নয়। বিক্রেতারাও এর সঠিক উত্তর দিতে পারেন না। অভিযোগ রয়েছে, চিকন ছোট ও সাদা হওয়ার সুবাদে ক্রেতাদের কাছে এই চালের চাহিদা বেশি। তাই বেশি দামের ফাঁদে ফেলে নানা প্রজাতির ধানের চাল মেশিনে কেটে-ছেঁটে আকর্ষণীয় করা হয়। এই ভেজাল চালই বেশি দামে নাজির শাইল নামে বিক্রি করা হয়।

অভিযোগ রয়েছে, বাজারে মিনিকেটসহ বিভিন্ন চকচকে চালের মান ও পুষ্টিহীনতা নিয়েও। যেহেতু মিনিকেট নামে ধানের কোনও জাত নেই। তাই কম দামের অন্যান্য জাতের ধান মেশিনে ছাঁটাইয়ের মাধ্যমে এই চাল প্রস্তুত করা হয়। চাল যত বেশি পলিশ করা হয়, দামও তত বেশি হয়। আবার সেটা প্যাকেটজাত করলে দাম আরও বেশি পাওয়া যায়। মূলত পুরো বিষয়টি ঘটে মিলার ও বাজারজাত কোম্পানিগুলোর কারসাজিতে, এমনটি বলছেন কেউ কেউ।

 

মিনিকেট চালের বিষয়ে সরকারের সার্ভে রিপের্টে বলা হয়েছে— মিনিকেট আসলে একটি ব্র্যান্ডের নাম। পলিশ, ফাইন পলিশ, মিডিয়াম পলিশের মাধ্যমে মিলাররা এই ব্র্যান্ডের চাল তৈরি করে বাজারজাত করছে।

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বিভিন্ন জাত ও নামের চাল এবং দাম নিয়ে ক্রেতাদের বিস্তর অভিযোগের কারণে সরকারের পক্ষ থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে যে, বিক্রির উদ্দেশে তৈরি করা প্রতিটি বস্তার গায়ে চালের জাত, নাম, উৎপাদনের তারিখ এবং দাম লিখতে হবে। এই নির্দেশনা অমান্য করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলেও উল্লেখ করা হয়।

২০২৪ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি খাদ্য মন্ত্রণালয়ের জারি করা নির্দেশনায় বলা হয়— একই জাতের ধান থেকে উৎপাদিত চাল বাজারে ভিন্ন ভিন্ন নামে ও দামে বিক্রি হচ্ছে। এতে ভোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত ও প্রতারিত হচ্ছেন। তাই এখন থেকে চালের বস্তায় ধানের জাত ও মিলগেটের মূল্য লিখে বাজারে ছাড়তে হবে। একইসঙ্গে উৎপাদনের তারিখ ও প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের নাম,

প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের জেলা ও উপজেলার উল্লেখ করতে হবে। থাকতে হবে ওজনের তথ্যও।

Manual5 Ad Code

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন সচিব ইসমাইল হোসেনের সই করা ওই নির্দেশনায় আরও বলা হয়েছিল— চালের দাম অযৌক্তিক পর্যায়ে গেলে বা হঠাৎ বৃদ্ধি পেলে মিলার, পাইকারি বিক্রেতা, খুচরা বিক্রেতা একে অপরকে দোষারোপ করছেন। এতে ভোক্তারা ন্যায্যমূল্যে পছন্দমতো জাতের ধান, চাল কিনতে অসুবিধার সম্মুখীন হচ্ছেন। অনেক ক্ষেত্রে আর্থিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন তারা।

Manual1 Ad Code

এ অবস্থা উত্তরণের লক্ষ্যে চালের বাজার মূল্য সহনশীল ও যৌক্তিক পর্যায়ে রাখতে ধানের নামেই যাতে চাল বাজারজাতকরণ করা হয়, তা নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে এবং এ সংক্রান্ত কার্যক্রম মনিটরিংয়ের সুবিধার্থে নির্দেশনায় কয়েকটি বিষয় নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে— চালের উৎপাদনকারী মিলাররা গুদাম থেকে বাণিজ্যিক কাজে চাল সরবরাহের আগে চালের বস্তার ওপর উৎপাদনকারী মিলের নাম, জেলা ও উপজেলার নাম, উৎপাদনের তারিখ, মিল গেট মূল্য এবং ধান-চালের জাত উল্লেখ করতে হবে। বস্তার ওপর এসব তথ্য কালি দিয়ে লিখতে হবে।

করপোরেট প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেও একই নির্দেশনা প্রতিপালন করতে হবে। এক্ষেত্রে মিলগেট দামের পাশাপাশি প্রতিষ্ঠান চাইলে সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য উল্লেখ করতে পারবে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সরকারের পক্ষ থেকে এই নির্দেশনা জারির পরও তা শতভাগ কার্যকর করা যায়নি। কারণ, শুরু থেকেই চাল উৎপাদনকারী মিল মালিকদের পক্ষ থেকে নানা ধরনের অভিযোগ তুলে এতে আপত্তি জানানো হচ্ছিল। পরবর্তী সময়ে কোটাবিরোধী আন্দোলন এবং সরকারের পরিবর্তনের ফলে নির্দেশনাটি শতভাগ মুখ থুবড়ে পড়ে। ফলশ্রুতিতে আবারও শুরু হয় মিল মালিকদের কারিশমা। নানা নামে বাজারজাত শুরু হয় একই জাতের ধানে উৎপাদিত বিভিন্ন নামের চাল। এসব চালই এখন বাজারে দেদার বিক্রি হচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাদামতলী- বাবুবাজার চাউল আড়ৎদার সমিতির সাধারণ সম্পাদক নিজাম উদ্দিন বলেন, ‘এসব অভিযোগ আমাদের জানিয়ে কোনও লাভ নাই। কারণ বস্তা ভর্তি চাল আমরা উৎপাদন করি না। মিলারদের উৎপাদন করা ও বস্তাজাত করা চাল আমরা নির্দিষ্ট কমিশনে বিক্রি করি মাত্র।’

অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে জয়পুরহাটের চাল ব্যবসায়ী, বাংলাদেশ অটো মেজর হস্কিং মিলস ওনার্স অ্যাসোসিশেনের সাধারণ সম্পাদক লায়েক আলী বলেন, ‘আবহাওয়াজনিত ত্রুটির কারণে রান্না করা ভাত নষ্ট হতে পারে, বা গন্ধও হতে পারে। এর জন্য আমরা দায়ী নই।’ তিনি বলেন,‘ যে জাতের ধানে যে চাল উৎপান করা হয়, বস্তার গায়ে তা লেখায় কোনও ব্যতিক্রম হয় না।’

Manual6 Ad Code

খাদ্য উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার বলেন, ‘বস্তার গায়ে লেখা ধানের জাত ও চালের নাম নিয়ে কোনও অভিযোগ পেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। মন্ত্রণালয় থেকে অভিযানও পরিচালনা করা হবে। চাল নিয়ে সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণার বিরুদ্ধে সরকার সব পদক্ষেপ নেবে।’

Sharing is caring!

Manual1 Ad Code
Manual3 Ad Code