প্রজন্ম ডেস্ক:
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে চলছে নানা আলোচনা। আগামী ফেব্রুয়ারির মধ্যভাগে নির্বাচন হবেএমন সম্ভাবনা নিয়ে প্রস্তুতি শুরু করেছে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো। অন্যদিকে জুলাই-আগস্টে গণঅভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধে দল হিসেবে আওয়ামী লীগ ও এর শীর্ষ নেতাদের বিচার এবং সংস্কারের আগে নির্বাচন সমীচীন হবে না এমন অবস্থান নিয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ও জামায়াতে ইসলামীসহ আরও কয়েকটি দল। এমন পরিস্থিতিতে আগামী সাত মাসে বিচার, সংস্কারসহ রাজনৈতিক অঙ্গনে কী কী হতে পারে, তা নিয়ে কৌতূহল রয়েছে জনমনে।
ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনাসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে জুলাইয়ের শেষদিকে আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু হতে পারে বলে ধারণা পাওয়া গেছে। তবে রায় কবে নাগাদ হতে পারে, সে বিষয়ে আগাম কোনো ধারণা দিতে চান না আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন শাখার আইনজীবীরা।
গত ১০ মে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ হয়। একই সঙ্গে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস (ট্রাইব্যুনালস) অ্যাক্ট, ১৯৭৩-এর সংশোধনী প্রস্তাবে অনুমোদন হয়; এতে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত রাজনৈতিক দল, এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন বা সমর্থক গোষ্ঠীর বিচার করা যাবে এ আইনে। তবে দল হিসেবে আওয়ামী লীগের বিচারের বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের তরফে এখনো আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত হয়নি।
এমন পরিস্থিতিতে নির্বাচনের আগে বিচার ও মৌলিক সংস্কার নিয়ে দৃঢ় অবস্থানের কথা জানিয়েছেন এনসিপি নেতারা। বিচার ও সংস্কার সøথগতি হচ্ছে বলেও অভিযোগ তাদের। তারা বলছেন, বিচার ও সংস্কারের বিষয়ে দৃশ্যমান অগ্রগতির ঘোষণা না এলে জুলাই সনদে এনসিপি স্বাক্ষর করবে কি না সেটি নেতারা ভেবে দেখবেন।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের টানা সাড়ে ১৫ বছরের শাসনের অবসান হয়। শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে ভারতে গিয়ে আশ্রয় নেন। আন্দোলন দমাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ব্যবহার করে হাজারের বেশি মানুষ হত্যার অভিযোগ উঠে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে। এ ছাড়া গুলি ও নির্যাতনে ২০ হাজারের বেশি মানুষ আহত হন বলে বিভিন্ন মাধ্যমে জানা যায়। দায়িত্ব নেওয়ার পর অন্তর্বর্তী সরকার এসব হত্যাকা- ও নির্যাতনকে মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে বিচার শুরুর উদ্যোগ নেয়।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সব মহলে আলোচনা শুরু হয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন কবে হচ্ছে। একই সঙ্গে শেখ হাসিনাসহ তার ঘনিষ্ঠজনদের বিচার দাবিও জোরালোভাবে ওঠে। এর মধ্যে আগে বিচার ও পরে নির্বাচনএমন দাবিতে এখন পর্যন্ত তাদের অবস্থান বিভিন্নভাবে জানান দিয়েছে এনসিপি ও জামায়াতে ইসলামী। দল দুটির নেতাদের ভাষ্য, বিচার ও সংস্কার নিয়ে বিএনপি রাজনৈতিক কৌশল নিয়েছে।
এরই মধ্যে গত ১৩ জুন লন্ডনে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মধ্যে বহুল আলোচিত বৈঠক হয়। ওই বৈঠকে নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ, এর শীর্ষ নেতাদের বিচার, সংস্কারসহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা হয়। এর আগে রোজার ঈদের আগের দিন গত ৬ জুন সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা ড. অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস আগামী বছরের এপ্রিল মাসের প্রথমার্ধের যেকোনো দিন আগামী সংসদ নির্বাচন হবে বলে ঘোষণা দেন। তবে ড. ইউনূস ও তারেক রহমানের ওই বৈঠকের পর যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করা গেলে আগামী বছরের রমজানের আগের সপ্তাহে (ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে) নির্বাচনের আয়োজন করা যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে এ সময়ের মধ্যে সংস্কার ও বিচারের বিষয়ে পর্যাপ্ত অগ্রগতি অর্জন করা প্রয়োজন হবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘জুলাই-আগস্টে মানবতাবিরোধী অপরাধে যেসব আওয়ামী লীগ নেতা জড়িত, আমরা অবশ্যই তাদের দ্রুত বিচার দেখতে চাই। পাশাপাশি দেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াটা ফিরিয়ে আনতে হবে। এজন্য নির্বাচনটাও জরুরি। এখানে আর অপেক্ষা করার অবকাশ নেই। বিচারের বিষয়টি দেখবে বিচার বিভাগ। আর সংস্কারের বিষয়টিও তো চলমান রয়েছে। এটিও হয়ে যাবে। কারও ব্যক্তিগত চিন্তাভাবনার কারণে গণতন্ত্র ও নির্বাচন অনিশ্চয়তায় পড়তে পারে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘জুলাই অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ নেতাদের বিচারের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। যেসব আসামি বিচারের আওতায় এসেছেন, তাদের বিচার করবে বিচার বিভাগ। যাদের আনতে পারবে না, তাদের পরবর্তী নির্বাচিত সরকার বিচারের আওতায় আনবে।’
এনসিপির যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আরিফুর রহমান তুহিন বলেন, ‘আগে বিচার ও মৌলিক সংস্কার নিশ্চিত করতে হবে। এর আগে এ দেশে কোনো নির্বাচন হবে না। নির্বাচন আমরা করতে দেব না। বিচার এবং সংস্কারের পরই নির্বাচন হবে। এটি না হলে জুলাই সনদে স্বাক্ষর করবে কি না সেটি নিয়ে এনসিপি ভাবছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের একটা অংশ এবং বিএনপি নির্বাচনটাকে সামনে এনে বিচার এবং সংস্কারটাকে অগুরুত্বপূর্ণ করার চেষ্টা করছে। বিএনপি নির্বাচনটাকেই মুখ্য হিসেবে মনে করছে।’
আরিফুর রহমান তুহিন আরও বলেন, ‘বিএনপি অবশ্যই ১৬-১৭ বছরের ভুক্তভোগী। এর অন্যতম কারণ ছিল ভারত। এখন ভারতের সুরে যদি বিএনপি কথা বলে, তাহলে তাদের নিয়ে সন্দেহ তো হওয়াই স্বাভাবিক, তারা ষড়যন্ত্রে পা দিচ্ছে কি না।’
বিচারের সবশেষ পরিস্থিতি
গত ১২ মে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। পরে ১ জুন তাদের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের দাখিল করা অভিযোগ আমলে নেয় ট্রাইব্যুনাল। অন্য দুই আসামি হলেন শেখ হাসিনা সরকারের সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান ও পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন। ওইদিন শেখ হাসিনাকে প্রধান আসামি করে ১৩টি ভলিউমে সাড়ে ৮ হাজার পৃষ্ঠার অভিযোগপত্র ট্রাইব্যুনালে দাখিল করা হয়। পাঁচ অভিযোগের মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে সাক্ষী করা হয় ৮১ জনকে। শুনানির পর ওইদিন শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খানের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে ট্রাইব্যুনাল। দুজন গ্রেপ্তার বা হাজির না হওয়ায় তাদের আত্মসমর্পণ করতে দুটি পত্রিকায় ইতিমধ্যে বিজ্ঞপ্তি জারি হলেও তারা হাজির বা আত্মসমর্পণ করেননি। ইতিমধ্যে পলাতক এ দুজনের বিরুদ্ধে শুনানি করতে আইনজীবী (স্টেট ডিফেন্স কাউন্সিল) নিযুক্ত করেছে ট্রাইব্যুনাল।
গত ২৫ জুন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এক আদেশে শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের শুনানির জন্য ১ জুলাই দিন ধার্য করেছে। সংশ্লিষ্ট প্রসিকিউটররা বলেন, ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস (ট্রাইব্যুনালস) অ্যাক্ট, ১৯৭৩-এর বিধান অনুযায়ী, অভিযোগ গঠনের পর আসামিদের প্রস্তুতি বা আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য তিন সপ্তাহের সময় দেওয়া হবে। অবস্থাদৃষ্টে নাম না প্রকাশের অনুরোধ জানিয়ে একাধিক প্রসিকিউটর বলেন, জুলাইয়ের শেষদিকে আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু হতে পারে। তবে, কবে নাগাদ রায় হবে, সে বিষয়ে আগাম কোনো ধারণা দিতে চায় না প্রসিকিউশন শাখা। যদিও অন্তর্বর্তী সরকারের আইন ও বিচার উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল কয়েক মাস আগে বলেছিলেন, আগামী ডিসেম্বরের আগেই দু-একটা রায়ের প্রত্যাশা করছেন তারা।
গতকাল এ বিষয়ে জানতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলামের মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করেও তার বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি। প্রসিকিউটর মো. মিজানুল ইসলাম বলেন, ‘আইনের বিধান অনুসরণ করে অভিযোগ গঠনের শুনানির আগে যৌক্তিক সময় দেওয়া হচ্ছে। অভিযোগ গঠন হলে আরও তিন সপ্তাহ সময় দেওয়া হবে।’ বিচার কবে শুরু হতে পারে, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘যেদিন অভিযোগ গঠন হবে, সেদিন সম্ভাব্য সময় বলা যাবে।’ সে ক্ষেত্রে কবে নাগাদ রায় হতে পারে, এমন প্রশ্নে অ্যাডভোকেট মিজানুল ইসলাম বলেন, ‘কবে রায় হবে, সে বিষয়ে আমরা বলব না। নিয়ম অনুযায়ী মামলা প্রসিড হবে ও সাক্ষী দেব।’
Sharing is caring!