প্রজন্ম ডেস্ক:
উড়োজাহাজ সংকট এবং একের পর এক যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে ফ্লাইট পরিচালনায় হিমশিম খাচ্ছে রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী সংস্থা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস। বহরে থাকা ২১টি উড়োজাহাজের মধ্যে ৩টি বর্তমানে হ্যাঙ্গারে পড়ে আছে এবং ২টি ফেরত দেওয়ার প্রক্রিয়ায় রয়েছে। ফলে মাত্র ১৬টি উড়োজাহাজ দিয়ে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক রুটের চাহিদা মেটাতে গিয়ে বেগ পেতে হচ্ছে বিমান কর্তৃপক্ষকে। এদিকে গত শনিবার একই দিনে এই সংস্থার দুটি বিমানে যান্ত্রিক ত্রুটি এবং গত দুই মাসে একাধিক ত্রুটি ও ফ্লাইট বিলম্বের ঘটনায় যাত্রীদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিচ্ছে। প্রশ্ন উঠছে রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী সংস্থাটির রক্ষণাবেক্ষণ ব্যবস্থা নিয়ে।
সর্বশেষ গত শনিবার রাতে সংযুক্ত আরব আমিরাতের শারজাহগামী ফ্লাইট যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় ফিরে আসে। ফ্লাইটটিতে সমস্যার বিষয়টি শনাক্ত হওয়ায় মাঝ আকাশ থেকেই ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেন পাইলট।
বাংলাদেশ বিমানের এক সূত্রে জানা যায়, রাত সোয়া ৮টার দিকে বোয়িং ৭৩৭ মডেলের উড়োজাহাজটি হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে প্রথমে চট্টগ্রামের উদ্দেশে উড্ডয়ন করে। পরে চট্টগ্রাম থেকে যাত্রী নিয়ে শারজাহর পথে যাত্রা শুরুর পরপরই পাইলট এয়ারক্রাফটের টেকনিক্যাল সমস্যার বিষয়টি অনুভব করেন এবং সঙ্গে সঙ্গে কন্ট্রোল টাওয়ারের সঙ্গে যোগাযোগ করে ঢাকায় ফেরার সিদ্ধান্ত নেন। পরে রাত ১০টা ১০ মিনিটে এটি নিরাপদে ঢাকায় অবতরণ করে।
সংস্থাটির প্রকৌশল বিভাগের সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, উড়োজাহাজটির ফুয়েল ব্যালান্সিং সিস্টেমে সমস্যা দেখা দিয়েছিল।
এদিকে, একই দিন সকাল বেলায় আরেকটি যান্ত্রিক ত্রুটির ঘটনা ঘটে। কক্সবাজার থেকে সৈয়দপুর হয়ে ঢাকায় ফেরার পথে বিমানের একটি ড্যাশ-৮ উড়োজাহাজে সমস্যা দেখা দিলে পাইলট সৈয়দপুর না গিয়ে সরাসরি ঢাকায় ফিরে আসেন।
এ বিষয়ে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের জনসংযোগ বিভাগের মহাব্যবস্থাপক এবিএম রওশন কবীর বলেন, ঢাকায় ফেরার পর দুটি ফ্লাইটেরই যান্ত্রিক ত্রুটি চেক করা হয়। এর এক ঘণ্টা পরই ফ্লাইটগুলো আবার তাদের নির্ধারিত গন্তব্যে রওনা দেয়।
এর আগে গত ১৬ জুলাই দুবাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিমানের বিজি-১৪৮ ফ্লাইটের চাকা ফেটে যাওয়ায় উড্ডয়ন বিলম্বিত (ফ্লাইট ডিলে) হয় এবং যাত্রীদের হোটেলে থাকতে হয়। কার্যকর বিকল্প ব্যবস্থা না থাকায় যাত্রী ভোগান্তি চরমে পৌঁছায়।
গত জুন ও চলতি জুলাই মাসে বিমানের উড়োজাহাজে ঘটেছে একাধিক যান্ত্রিক ত্রুটির ঘটনা। গত ২৭ জুন ঢাকা-ব্যাংকক ফ্লাইট বিজি-৩৮৮ যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে পাঁচ ঘণ্টা দেরিতে ছাড়ে। এরপর ৫ জুলাই ব্যাংকক থেকে ঢাকাগামী বিজি-৩৮৯ ফ্লাইট হঠাৎ বাতিল করা হয়, যাত্রীদের পরদিন আসতে বলা হয়। ওই একই দিন মদিনা থেকে চট্টগ্রামগামী বিজি-১৩৮ ফ্লাইট শাহ আমানত বিমানবন্দরে অবতরণের পর রানওয়েতে আটকা পড়ে। এ ছাড়া ৩ জুলাই কক্সবাজার বিমানবন্দরে অবতরণের পর একটি ড্যাশ-৮ উড়োজাহাজ রানওয়েতে আটকে যায়। ঢাকায় ফেরত আনার পর নোজ গিয়ারসহ অন্যান্য ত্রুটি ধরা পড়ে। আর তার আগে কক্সবাজার থেকে উড্ডয়নের পর উড়োজাহাজের চাকা খসে পড়ে- যা ছিল গুরুতর নিরাপত্তা সংকেত।
বিমানের একটি সূত্র জানিয়েছে, ড্রাই লিজে নেওয়া ২টি উড়োজাহাজ ফেরত পাঠানো হচ্ছে। একই সঙ্গে যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে বেশ কয়েকটি উড়োজাহাজ দীর্ঘদিন ধরেই গ্রাউন্ডেড অবস্থায় আছে। উদাহরণস্বরূপ, ড্যাশ-৮ মডেলের একটি উড়োজাহাজ ৫ মাস ধরে অকেজো পড়ে রয়েছে। আরেকটি বোয়িং ৭৩৭-৮০০ এয়ারক্রাফটের বডিতে ট্রলিব্যাগের আঘাতে ফুটো ও কাঠামোগত ক্ষতি হয়, যেটি মেরামতে খরচ হবে প্রায় ৫ কোটি টাকা এবং সময় লাগবে প্রায় এক মাস।
অ্যাভিয়েশন বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহিদুল আলম বলেন, ‘বিমানের বেশির ভাগ এয়ারক্রাফট পুরোনো হয়ে যাওয়ায় ঘন ঘন ত্রুটি দেখা দিচ্ছে। এতে যাত্রীরা বারবার বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছেন এবং ব্র্যান্ড ইমেজও সংকটে পড়ছে। এখনই বহর সম্প্রসারণ ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো জরুরি।’
এ বিষয়ে অ্যাভিয়েশন বিশেষজ্ঞ এ টি এম নজরুল ইসলাম বলেন, একটি এয়ারক্রাফট যখন পরিচালনা করা হয় তখন তার বিভিন্ন পর্যায়ে চেক হয়। কোনো কারিগরি ত্রুটি আছে কি না তাও চেক করা হয়। এগুলো আবার একটি লগ বইয়ে লিখে রাখা হয়। আমার মনে হয় এই লগ বইগুলোর গত ৩ মাস বা ৬ মাসের বিবরণী দেখা প্রয়োজন। এতে করে কোন এয়ারক্রফটের জন্য কী ধরনের মেইনটেন্যান্সের কথা বলা হয়েছে তা দেখে যদি এয়ারক্রাফটগুলোকে মেইনটেন করা হয় তাহলে এ ধরনের ত্রুটি অনেকটাই কমে আসবে।
রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী একটি এয়ারলাইনস হলেও বিমান তার ব্র্যান্ডিংয়ে তেমন কোনো উদ্যোগ দিচ্ছে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিমানের উচিত তাদের ব্র্যান্ডিংয়ে আরও জোর দেওয়া এবং যাত্রীসেবার মান বাড়ানো।
বিমান বাংলাদেশের জনসংযোগ বিভাগের মহাব্যবস্থাপক এবিএম রওশন কবীর বলেন, ‘বিলম্বিত ফ্লাইটে যাত্রীদের আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী সেবা দেওয়া হয়- যেমন হোটেল, খাবার, যাতায়াত ব্যবস্থা ইত্যাদি।’
তিনি আরও জানান, ‘নিরাপত্তাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে আমরা কোনো ঝুঁকি নিয়ে ফ্লাইট পরিচালনা করছি না। যন্ত্রাংশের ঘাটতি কিংবা রুটিন মেইনটেন্যান্সের জন্য কিছু উড়োজাহাজ হ্যাঙ্গারে আছে। দুইটি লিজে আছে এবং কয়েকটি কেনার প্রক্রিয়া চলছে। লিজের বিমান দুটি এলে সংকট অনেকটাই কেটে যাবে।’
অবশ্য বিমানের পক্ষ থেকে যাত্রী হারানোর আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া হলেও বাস্তবে ফ্লাইট বাতিল ও বিলম্বের কারণে যাত্রীদের ক্ষোভ বাড়ছে। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক রুটে আস্থার সংকট তৈরি হচ্ছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, একদিকে আধুনিক বিমান না থাকা, অপরদিকে পরিকল্পনার অভাব ও জবাবদিহির ঘাটতি- এই দুইয়ের সমন্বয়ে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস এখন বড় ধরনের অস্তিত্ব সংকটের দিকে এগোচ্ছে। সময়োপযোগী পদক্ষেপ না নিলে এই সংস্থার সেবার মান ও আর্থিক অবস্থা আরও খারাপের দিকে যেতে পারে।
Sharing is caring!