প্রজন্ম ডেস্ক:
রাজধানীর ঘনবসতিপূর্ণ এলাকার মধ্যেই পরিচালিত হচ্ছে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্যক্রম। গত সোমবারের বিমান দুর্ঘটনার পর রাজধানীর কেন্দ্রস্থলে বড় মাপের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাজ পরিচালনা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় অবস্থিত এই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটি দিয়ে প্রতিদিন শতাধিক বিমান উড্ডয়ন ও অবতরণ করে, যা নাগরিকদের জন্য একটি স্থায়ী ঝুঁকি তৈরি করছে।
বিমান নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও এভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমন এলাকায় বিমান চলাচলের সময় অল্প কোনো যান্ত্রিক ত্রুটি বা বৈমানিকের ভুল সিদ্ধান্তে বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটতে পারে। বিশেষ করে বিমান টেকঅফ বা ল্যান্ডিংয়ের সময় যদি কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে, তাহলে তা সরাসরি প্রভাব ফেলতে পারে নিচের ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাগুলোর ওপর।
এ বিষয়ে এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ এ টি এম নজরুল ইসলাম বলেন, ঢাকার উত্তরার মতো আবাসিক ও বাণিজ্যিক এলাকাগুলো এখন শাহজালালের রানওয়ের খুব কাছাকাছি চলে এসেছে। পাশাপাশি মিরপুর, তেজগাঁও, বনানী, খিলক্ষেত, আশকোনা, টঙ্গী- এসব এলাকাও উড্ডয়ন পথের মধ্যে পড়ে। এ কারণে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ ঝুঁকির মধ্যে বসবাস করছে।
তিনি বলেন, ‘একটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের আইডিয়াল অবস্থান হওয়া উচিত জনবহুল এলাকা থেকে অনেক দূরে। শাহজালালের ক্ষেত্রে উল্টোটা ঘটেছে- ঢাকা যত বড় হয়েছে, বিমানবন্দর ঘিরে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা গড়ে উঠেছে। এতে শুধু যাত্রী নয়, সাধারণ নাগরিকদের নিরাপত্তাও প্রশ্নের মুখে পড়ছে। কিন্তু অতীতে যখন এই বিমানবন্দরটি হয়েছিল তখন এর আশপাশে কোনো বসতি ছিল না। ফলে এটি ছিল বিমান উড্ডয়ন ও অবতরণের জন্য নিরাপদ। কিন্তু তা ধরে রাখা হয়নি। সময় যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রথমে উত্তরার এক ও দুই নম্বর সেক্টর এবং পরে ক্রমান্বয়ে ঘনবসতি গড়ে ওঠে বিমানবন্দরের সীমানাঘেঁষে যা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এবং এটি কেবল বিমানবন্দরের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে তাই নয় ঝুঁকি বাড়ছে ওই এলাকায় বসবাস করতে আসা মানুষের জীবনেরও।’
কেবল ঘনবসতি বেড়েছে এমন নয়, নিয়ম ভেঙে বিমানবন্দরটির সীমানাঘেঁষে তৈরি হয়েছে বহুতল ভবন। বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) নিয়ম অনুযায়ী হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সীমানা ঘেষ ৫০০ ফুটের বেশি উঁচু ভবন তৈরি করা যাবে না।
এ নিয়ে বেবিচকের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আকাশপথে নিরাপদে একটি উড়োজাহাজের উড্ডয়নের জন্য ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের শেষ সীমানায় সর্বোচ্চ ৫০০ ফুট উচ্চতার ভবন নির্মাণ করার অনুমোদন আছে। কিন্তু সে নিয়ম না মেনে অনেকেই এখানে ভবন নির্মাণ করেছে। বেবিচক থেকে এরই মধ্যে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রানওয়ের কাছাকাছি ছয়টি ‘অধিক উচ্চতার’ ভবন চিহ্নিত করেছে। অনুমোদনের চেয়েও প্রায় দ্বিগুণ উচ্চতার ভবন নির্মাণ করায় এগুলো ফ্লাইট ওঠানামায় ঝুঁকি তৈরি করছে। এসব ভবন উত্তরায় প্রিয়াংকা রানওয়ে সিটি নামের আবাসন প্রকল্পের ১ নম্বর রোডে অবস্থিত।
এ অবস্থায় আবারও সামনে আসছে বিমানবন্দরটিকে ঢাকার ঘনবসতি থেকে আরও দূরে সরিয়ে নেওয়ার দাবি।
গতকাল উত্তরার মাইলস্টোন স্কুলে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে জড়ো হয়েছেন বহু মানুষ। এই ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় কেন এমন বিমান ওঠানামা বা প্রশিক্ষণ বিমান উড়বে তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তারা। রবিউল হক নামের এক ব্যক্তি বলেন, আমি এখানে দেখতে এসেছিলাম। প্রায় ১ ঘন্টা হলো এখানে দাঁড়িয়ে আছি। এরই মধ্যে এই স্কুলটির ওপর দিয়ে প্রতি ২০ মিনিট পরপর একটি করে বিমান অনেক নিচ দিয়ে উড়ে যেতে দেখেছি। এগুলো যে কোনোদিন কোনো দুর্ঘটনায় পড়বে না এর কি নিশ্চয়তা আছে? তাই এখান থেকে বিমানবন্দরটি দ্রুত সরানো প্রয়োজন।
সেখানে আসা ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরাও একই কথা বলেন। তারা বলেন, এখানে এত স্কুল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, এখানে কেন প্রশিক্ষণ বিমান বা বেসামরিক বিমান উড়বে ও ল্যান্ড করবে।
আন্তর্জাতিক বেসামরিক বিমান চলাচল সংস্থা (আইকাও)-এর অ্যানেক্স-১৪ নির্দেশনায় স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, প্রশিক্ষণ ফ্লাইট পরিচালনার জন্য এমন এলাকা নির্বাচন করতে হবে যা জনবসতি থেকে দূরে, শব্দদূষণ কম এবং নিরাপত্তাজনিত ঝুঁকি হ্রাসে উপযোগী। বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)-এর নিজস্ব নীতিমালাতেও এই নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে এসব নির্দেশনা উপেক্ষা করে জনবহুল এলাকায় প্রতিনিয়ত প্রশিক্ষণ ফ্লাইট পরিচালনা করা হচ্ছে, যা সাধারণ মানুষের জীবনে বিপদের আশঙ্কা তৈরি করছে।
এ বিষয়ে আকাশ পরিবহন বিশ্লেষক কাজী ওয়াহিদুল আলম বলেন, ‘এ ক্ষেত্রে দেশের অন্য যে অব্যবহৃত এয়ার ফিল্ডগুলো আছে যেখানে আশপাশে তেমন বসতি নেই তেমন জায়গা তাদের প্রশিক্ষণে ব্যবহার হওয়া উচিত।’
কাজী ওয়াহিদুল আলম আরও বলেন, ‘আমরা বহুবার বলেছি, ঢাকার মতো ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় একটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর রাখা উচিত নয়। আগে শাহজালাল বিমানবন্দরের চারপাশে তেমন জনবসতি ছিল না, কিন্তু এখন পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। প্রতিনিয়ত বিমান উঠানামার ফলে এই এলাকায় যেকোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। বিশেষ করে বিমান টেকঅফ ও ল্যান্ডিংয়ের সময়টা বেশি ঝুকিঁপূর্ণ। ফলে বিমানবন্দর ও এর আশপাশের এলাকা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বিশ্বের অনেক দেশ- যেমন ব্যাংকক, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়া- তাদের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর শহরের বাইরে সরিয়ে নিয়েছে। বাংলাদেশেও এই বিষয়ে এখনই জাতীয় পর্যায়ে চিন্তাভাবনা শুরু করা উচিত। কারণ একটি নতুন বিমানবন্দর তৈরি ও চালু করতে কমপক্ষে ১০ বছর সময় লাগে।’
বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) এ বিষয়ে এখনো কোনো আনুষ্ঠানিক পরিকল্পনা বা বিকল্প স্থানের প্রস্তাব উপস্থাপন করেনি। তবে বিভিন্ন মহল থেকে রাজধানীর জন্য দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর স্থাপনের দাবি জোরালো হচ্ছে।
এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ এ টি এম নজরুল ইসলাম বলেন, সরকারের উচিত ছিল বিমানবন্দর এলাকায় বসতি উঠতে না দেওয়া। তা হলে হয়তো এমন প্রাণহানি হতো না। তাই অতীতের কোনো সরকারই এ দায় এড়াতে পারে না।
তিনি আরও বলেন,‘এই নগর নিয়ে স্বাধীনতা পরবর্তী কোনো সরকারই একটি সামগ্রিক পরিকল্পনা করেনি এবং কোনো বড় প্রকল্প নেওয়া হলেও যেসব নিয়ম মানার কথা তা মানা হচ্ছে কি না তা নিয়েও নজরদারি করেনি। তাই এখন এমন ঘটনা ঘটল। ভবিষ্যতে যদি বেসামরিক কোনো বড় বিমান বিধ্বস্ত হয় তখন এর থেকেও বড় ট্র্যাজেডি তৈরি হবে। ক্ষয়ক্ষতি আরও অনেক বাড়বে।’
Sharing is caring!