প্রকাশনার ১৬ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

২০শে ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
৫ই পৌষ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
২৯শে জমাদিউস সানি, ১৪৪৭ হিজরি

পোড়া হাতের ইশারাই ভরসা তাদের

editor
প্রকাশিত জুলাই ২৩, ২০২৫, ০৬:৫৮ পূর্বাহ্ণ
পোড়া হাতের ইশারাই ভরসা তাদের

Manual3 Ad Code

 

প্রজন্ম ডেস্ক:

‘মেয়েটার হাত-পা-মুখ সব পুড়ে গেছে। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শ্বাসনালি। পুরো শরীরে ব্যান্ডেজ। ডাক্তার বলেছেন ৪৮ ঘণ্টা না গেলে কিছুই বোঝা যাবে না। এ অবস্থায় মেয়েকে কী বলে সান্ত¦না দেব। কথা বলতে পারছে না। কাছে গেলে পোড়া হাতের দিকে তাকিয়ে আঙুল নাড়ানোর চেষ্টা করে। ইশারায় শরীরের যন্ত্রণা বোঝায়, অপলক তাকিয়ে থাকে। প্রাণচঞ্চল মেয়েটা একটু নড়তেও পারছে না। বাবা হিসেবে এ দৃশ্য দেখার মতো না। জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের এফএইচডিইউ ইউনিটের সামনে কান্না করতে করতে কথাগুলো বলছিলেন মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী তাসনিয়া হকের বাবা মো. হাফিজ উদ্দিন।

 

আর নিবিড় পরিচর্চা কেন্দ্রের (আইসিইউ) সামনে বিলাপ করছিলেন সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী মাহতাবুর রহমান ভূঁইয়ার বড় বোন নাবিলা। তিনি বলেন, ও বুঝতে পারছে না শরীরে কী হইছে? সকালে একটু জুস খাইয়ে দিছি। আমাকে বলে, আমি কি বাঁচব আপু? কথাগুলো বলতে বলতে আবার কান্নায় ভেঙে পড়েন নাবিলা।

Manual3 Ad Code

 

শুধু হাফিজ উদ্দিন ও নাবিলাই নয়Ñবার্ন ইনস্টিটিউটের সব স্বজনের একই অবস্থা। দুর্ঘটনার পর থেকেই আর্তনাদ আর আহাজারিতে কাটছে তাদের। যাদের শ্বাসনালি পুড়েছে তাদের সবাই চোখের অথবা হাতের ইশারায় নিজের যন্ত্রণা বোঝানোর চেষ্টা করছে। যারা কথা বলতে পারছে, মা মা আর পারছি না, অনেক কষ্ট হচ্ছে, বাবা আমাকে হাসপাতাল থেকে নিয়ে যাও এমন সব কথা বলে পোড়া যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে আর বাঁচার আকুতি জানাচ্ছে। স্বজনরাও কোমলমতি শিশুদের এমন পরিণতি মানতে পারছেন না। আল্লাহর কাছে চোখের মনি সন্তানের প্রাণ ভিক্ষা চেয়ে কেউ নফল নামাজ পড়েই যাচ্ছেন। কেউ তসবি পড়তে পড়তে চোখের পানি ফেলছেন, আবার কেউ লুটিয়ে পড়ে বিলাপ করছেন। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে বার্ন ইনস্টিটিউটে এমন হৃদয়বিদারক ঘটনা দেখা যায়। আইসিইউ, এফএইচডিইউ ও সাধারণ ওয়ার্ডগুলোর সামনে স্বজনদের বুকফাটা আহাজারি থামছে না কিছুতেই। অন্তত যেন প্রাণে বেঁচে থাকে আদরের সন্তান- এই প্রার্থনা সবার। এর মধ্যে সন্তানের মৃত্যুর খবর আসার আতঙ্ক তো আছেই। কোনো প্রয়োজনে ওয়ার্ড নাম্বার উল্লেখ করে স্বজন খুঁজলেই আতঙ্কে আঁতকে উঠছেন তারা।

 

তাসনিয়ার বাবা মো. হাফিজ উদ্দিন বলেন, আমি গার্মেন্টসে চাকরি করি। গ্রামের বাড়ি ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলায়। বাসা মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের পাশেই। আমার ছেলে তাসিন আবদুল্লাহ স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে ও মেয়ে তাসনিয়া পড়ে অষ্টম শ্রেণিতে। ঘটনার সময় তাসিন স্কুল থেকে বাসায় ফিরছিল। আর তাসনিয়া অতিরিক্ত ক্লাস করার জন্য স্কুলেই অবস্থান করছিল। আমরা তারে উত্তরার বাংলাদেশ মেডিকেলে পাই। এরপর দ্রুত বার্ন ইউনিটে নিয়ে আসি। এখন তো পর্যায়ক্রমে অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছে। ওর জন্য, অন্য সবার জন্য আপনারা সবাই দোয়া করবেন। তিনি আরও বলেন, মেয়েটা ইশারায় যন্ত্রণা বোঝানোর চেষ্টা করছে। পুরো শরীর পুড়ে গেছে। বাবা হয়ে মেয়ের এ ভয়াবহ পরিণতি সহ্য করি কীভাবে? বলতে বলতে আবার বিলাপ শুরু করেন হাফিজ উদ্দিন।

Manual1 Ad Code

 

জীবন বাজি রাখলাম তাও মেয়েটা বাঁচত না :

Manual5 Ad Code

মাইলস্টোনের চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী সামিয়া আক্তারের বাবা আবদুর রহিম আইসিইউর সামনে অশ্রুসিক্ত অবস্থায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। কান্নাবিজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ঘটনার সময় সামিয়াকে নিতে আমি স্কুলের বাইরেই অপেক্ষা করছিলাম। হঠাৎ বিকট শব্দে বিস্ফোরণের পর আগুন দেখে আতঙ্কিত হয়ে পড়ি। যেখানে আগুন ওখানেই তো আমার মেয়ে এটি দেখে আমি ভেতরে প্রবেশ করি। নিচ তলা থেকেই আমার মেয়েকে দেখতে পাই। দেয়াল বেয়ে ওপরে উঠি। মেয়েকে খুঁজে পাচ্ছিলাম না। গ্রিল ভেঙে মেয়েকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিই। তখনও বুঝিনি ওর শ্বাসনালি পুড়ে গেছে। এখন কী হবে জানি না? তাপে ওর ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হইছে। মেয়েকে বাঁচাতে নিজের জীবন বাজি রাখলাম, এখন বুঝতিছি, মেয়ে আমার বাঁচত না। আক্ষেপ করে আবদুর রহিম বলেন, কোনো ঘটনা ঘটলে সবাই ভিডিও করতে ব্যস্ত হয়ে যায়। শুরুতে বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার পর সবাই চিল্লাচিল্লি শুরু করলে সবাই দৌড়ে নিরাপদ স্থানে সরে যায়। অনেকে ভিডিও করতে ব্যস্ত হয়ে যায়। কিন্তু আহতদের দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে- এই বোধ শুরুতেই সবার মধ্যে কাজ করা উচিত।

ফারাবির ব্যাংকার মা-বাবা পাগলপ্রায় :

স্কুলটির ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী ফারাবি আয়ানের বাবা জুনায়েদ আহমেদ ও মা তামান্না আক্তার দুজনই অগ্রণী ব্যাংকের কর্মকর্তা। আইসিইউর ১৫ নম্বর বেডে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে সে। সন্তানের এমন পরিণতিতে পাগলপ্রায় মা-বাবা। কোনো কথা না বললেও পাশেই নীরবে চোখের পানি ফেলছিলেন ফারাবির মামা জায়িদী রায়হান। তিনি বলেন, ফারাবিদের বাসা মিরপুর ১০ নম্বরে। প্রতিদিন মেট্রোরেলে স্কুলে আসা-যাওয়া করে ফারাবি। জুনাইনা নামে ফারাবির ছোট একটি বোন আছে। ফারাবির এই করুণ পরিণতি মানতে পারছেন না ওর মা-বাবা। দুজনই কান্না করে যাচ্ছেন অবিরত। পঞ্চম তলায় দেখা যায় সায়মা নামে তৃতীয় শ্রেণির এক শিক্ষার্থীকে হুইলচেয়ারে করে অন্য বেডে নিয়ে যাওয়ার সময় চিৎকার করে বলছে, মা-মা আমি আর পারতেছি না, আমার অনেক কষ্ট হচ্ছে। এ সময় হুইলচেয়ার ধরে নিতে নিতেই বিলাপ করতে থাকে শিশুটির মা।

 

Manual3 Ad Code

আতঙ্কে ঘুমাতে পারছে না মুনতাহা :

পোস্ট অপারেটিভ ওয়ার্ডে ভর্তি মুনতাহা তোয়া কর্ন’র (১০) শরীর পুড়েছে ৫ শতাংশ। তুলনামূলক ভালো আছে সে। কাদামাখা প্যান্ট, শার্ট ঘামে ভিজে আবার শুকিয়েছে বহুবার। ঘটনার পর থেকে হাসপাতালে এভাবেই অপেক্ষা করছেন তার বাবা আবুল কালাম আজাদ। কর্ন স্কুলটির পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। তার বাবা জমি বেচাকেনা করেন। থাকেন সাভার বিরুলিয়া আকড়ান এলাকায়। ২ ছেলে ও ১ মেয়ের মধ্যে মেজ কর্ন। বড় ছেলে প্রানন একই স্কুল থেকে এবার এসএসসি পাস করেছে।

বাবা আবুল কালাম বলেন, ঘটনার দিন সকালে আমিই মেয়েকে স্কুলে দিয়ে এসেছি। যেখানে বিমান পড়েছে, ওই স্থানের পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল মুনতাহা। বিমান পড়ার সঙ্গে সঙ্গে অন্যদিকে দৌড় দেয় সে। তবে বিস্ফোরণের তাপ এসে লাগে তার দুই হাতে। কাঁধের স্কুল ব্যাগেও আগুন ধরে গিয়েছিল। পরে সেনাবাহিনী তাকে উদ্ধার করেছে। এরপর বার্ন ইনস্টিটিউটে আনা হয়। কয়েক হাসপাতাল ঘুরে বার্ন ইনস্টিটিউটে এসে মেয়েকে দেখতে পাই। খুব ভয় পেয়েছে আমার মেয়েটা। সারা রাতে ঘুমাতেও পারেনি।

Sharing is caring!

Manual1 Ad Code
Manual3 Ad Code