প্রজন্ম ডেস্ক:
ভর্তুকি কমাতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) চাপে বিদ্যুৎ খাতে তিন বছর মেয়াদি রোডম্যাপ তৈরি করার পরিকল্পনা নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। পরিকল্পনা অনুযায়ী, ধাপে ধাপে বিদ্যুতের ওপর থেকে ভর্তুকি তুলে নেওয়া এবং বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বিদ্যুতের মূল্য নির্ধারণ করা হবে।
এই পরিকল্পনার উদ্দেশ্য হচ্ছে, বাজেটে ভর্তুকির চাপ কমানো এবং গরিব মানুষ যাতে আরও বেশি করে সামাজিক সুরক্ষা পায়, তা নিশ্চিত করা। আগামী সেপ্টেম্বরে রোডম্যাপ চূড়ান্ত করার লক্ষ্যে কাজ চলছে। অর্থ মন্ত্রণালয় ও বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
আইএমএফের একটি প্রতিনিধিদল গত মে মাসে ঢাকায় এসেছিল। বিদ্যুৎ ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করে প্রতিনিধিদলের সদস্যরা এ বিষয়ে একটি খসড়া তৈরি করে দিয়ে গেছেন। বিদ্যুৎ বিভাগ এখন ওই খসড়া নিয়ে কাজ করছে।
সংশ্লিষ্ট খাতের নীতিনির্ধারকরা বলেছেন, বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ বেশি। সরকার উৎপাদন খরচের চেয়ে কম মূল্যে বিদ্যুৎ বিক্রি করে। ফলে এ খাতে প্রতিবছর বড় অঙ্কের ভর্তুকি দিতে হচ্ছে।
জাতীয় বাজেটে বিদ্যুৎ খাতে সর্বোচ্চ ভর্তুকি দেওয়া হয়। বিদায়ী ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এই খাতে ৬২ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়। অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছরে বিদ্যুতে ভর্তুকি প্রায় ৮০ শতাংশ বেড়েছে। বাজেটে ভর্তুকিতে যে পরিমাণ বরাদ্দ দেওয়া হয়, তার বড় একটি অংশই খেয়ে ফেলছে বিদ্যুৎ খাত। এই খাতে ব্যয় বাড়ায় সামগ্রিকভাবে বাজেট বাস্তবায়নে চাপ বাড়ছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।
আইএমএফ মনে করে, বিদ্যুৎ খাতে মাত্রাতিরিক্ত ভর্তুকির কারণে সামগ্রিকভাবে দেশের বাজেটে চাপ বেড়েছে। এতে একদিকে সরকারের আর্থিক চাপ বেড়েছে। অন্যদিকে সামাজিক সুরক্ষায় কাঙ্ক্ষিত বরাদ্দ বাড়ছে না। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে, বাস্তবতার আলোকে আগামী তিন বছরের (২০২৬-২৮) জন্য বিদ্যুৎ খাতে একটি রোডম্যাপ প্রণয়নের তাগিদ দিয়েছে ওয়াশিংটনভিত্তিক বাংলাদেশের অন্যতম উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা আইএমএফ। এতে বিদ্যুতের মূল্য নির্ধারণে ‘ডায়নামিক (গতিশীল) ট্যারিফ নীতি’ প্রণয়ন এবং একই সঙ্গে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ কমিয়ে আনার কথা বলা হয়েছে।
ডায়নামিক ট্যারিফ নীতির অর্থ হলো- বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে চাহিদা ও সরবরাহের ভিত্তিতে বিদ্যুতের দাম নির্ধারণ করা। পাশের দেশ ভারতসহ বিশ্বের অন্য দেশে এ ধরনের নীতি চালু রয়েছে। বাংলাদেশেও এই নীতি অনুসরণ করে বিদ্যুতের দাম নির্ধারণের পরামর্শ দিয়েছে আইএমএফ।
উল্লেখ্য, বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি তুলে দিলে এর দাম সমন্বয় করতে হবে। অর্থাৎ দাম বাড়াতে হবে। এর ফলে জিনিসপত্রের দাম আরও বেড়ে যাবে এবং সাধারণ মানুষের কষ্ট বাড়বে। গত দেড় বছরে বিদ্যুতের দাম দুই দফা বাড়ানো হলেও কমেনি ভর্তুকি। বরং আরও বেড়েছে।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, শুধু বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে ভর্তুকির চাপ কমানো যাবে না। এ খাতে যে অনিয়ম-দুর্নীতি রয়েছে তা বন্ধ করতে হবে। পাশাপাশি বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ কমাতে হবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বলেন, গত অর্থবছরে বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি প্রায় ৮০ শতাংশ বেড়েছে। এই বৃদ্ধির পেছনে বেশ কিছু কারণ আছে। এর মধ্যে রয়েছে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি, ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন এবং আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি। তিনি আরও বলেন, ক্রমবর্ধমান ভর্তুকি সরকারের ওপর বড় ধরনের আর্থিক চাপ সৃষ্টি করছে, যা কমানোর জন্যই সরকার তিন বছরের রোডম্যাপ তৈরি করছে। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র বলেছে, বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি বাড়ার আরেকটি কারণ হচ্ছে বিপুল পরিমাণ বকেয়া বিল পরিশোধ না করা, যা ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার রেখে গেছে। অবশ্য বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বকেয়া বিলের বড় একটি অংশ পরিশোধ করেছে। ফলে আগামীতে ভর্তুকির চাপ কিছুটা কমবে বলে আশা করছে সরকার।
বিদায়ী অর্থবছরের বাজেটে ভর্তুকি খাতে মোট বরাদ্দ দেওয়া হয় ১ লাখ ১২ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে বিদ্যুতেই বরাদ্দ ছিল ৬২ হাজার কোটি টাকা। চলতি (২০২৫-২৬) অর্থবছরে বাজেটে ভর্তৃকিতে মোট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ১ লাখ ২২ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে বিদ্যুতে ৩৭ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। অর্থবছর শেষে এটি বিদ্যমানের চেয়ে দ্বিগুণ ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে মনে করেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। এখন বাজেটে মোট ব্যয়ের প্রায় ২০ শতাংশই চলে যায় ভর্তুকিতে। আইএমএফ চায়, বিদ্যুতে ভর্তুকি কমাতে পারলে সামগ্রিকভাবে বাজেটে এই চাপ কমে আসবে।
যোগাযোগ করা হলে বিআইডিএসের সাবেক মহাপরিচালক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. মোস্তফা কে. মুজেরী বলেন, ‘আমরা চাই একটি দুর্নীতিমুক্ত বিদ্যুৎ খাত। এই খাতের চুরি-চামারি বন্ধ করতে পারলে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ কমে আসবে। তখন আর এত বেশি ভর্তুকি দিতে হবে না।’ এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, বিদ্যুৎ খাতের দক্ষতা বাড়াতে পারলে দাম বাড়ানোর প্রয়োজন হবে না।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০২০-২১ অর্থবছর পর্যন্ত বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকির পরিমাণ ৭ হাজার কোটি থেকে ৯ হাজার কোটি টাকার মধ্যে ছিল। এর পর থেকে এই ভর্তুকির পরিমাণ অস্বাভাবিক বেড়েছে, যা সরকারের আর্থিক ব্যবস্থাপনায় একটি বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। এই ক্রমবর্ধমান চাপ কমানোর লক্ষ্যেই সরকার তিন বছরের রোডম্যাপ তৈরি করছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সরকার এখন বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ কমানোর উপায় খুঁজছে, যাতে ভর্তুকির প্রয়োজনীয়তা কমিয়ে আনা যায়। প্রাথমিক পরিকল্পনা অনুযায়ী, বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ প্রায় ১০ শতাংশ কমানোর লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এর ফলে ১০ থেকে ১১ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় হতে পারে।
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল তাদের ৫ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ কর্মসূচির পরবর্তী কিস্তি ছাড়ের জন্য বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি যৌক্তিকীকরণকে একটি মূল শর্ত হিসেবে নির্ধারণ করেছে। সংস্থাটির সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়কে অবশ্যই একটি তিন বছরের রোডম্যাপ গ্রহণ করতে হবে এবং তা প্রকাশ্যে জানাতে হবে। এই রোডম্যাপের উদ্দেশ্য হলো, বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ এবং বিক্রয় মূল্যের মধ্যে যে ব্যবধান আছে, তা কমিয়ে একটি আর্থিকভাবে টেকসই পর্যায়ে নিয়ে আসা। এ প্রসঙ্গে ড. মুজেরী বলেন, ‘আইএমএফ থেকে আমরা ঋণ নিয়েছি। কাজেই তাদের শর্ত সরকারকে মানতে হবে। তা না হলে কিস্তি আটকে যাবে।’
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বিদ্যুৎ খাতে বরাদ্দ দেওয়া ভর্তুকির সিংহভাগই ব্যয় হয় বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভাড়া বাবদ বা ক্যাপাসিটি চার্জে। দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রতিবছরই খরচ বাড়ছে। এর পেছনে কেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ অন্যতম কারণ। পাশাপাশি এ খাতে অযৌক্তিক ব্যয়, দুর্নীতিসহ নানা কারণেও খরচ বাড়ছে বলে মনে করেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিদ্যুৎ বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, সরকার বিদ্যুতের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে এবং গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো থেকে উৎপাদন বাড়াতে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস বা এলএনজি আমদানি বাড়াচ্ছে। এর কারণ হলো, গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন এখনো সাশ্রয়ী। এ ছাড়া বিদ্যুতের দাম কমাতে উচ্চব্যয়ের ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রোডিউসারস আইপিপি বা বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীদের সঙ্গে করা বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তিগুলোও পুনরায় পর্যালোচনা করা হচ্ছে। এই পদক্ষেপগুলো ভর্তুকির চাপ কমাতে এবং বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ সাশ্রয়ী করতে সহায়ক হবে।
বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, বর্তমানে সরকার যে পদ্ধতিতে বিদ্যুতের মূল্য নির্ধারণ করে তা সঠিক নয়। এটাকে আরও নমনীয় করতে হবে। এ জন্য আইএমএফ চাচ্ছে বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে চাহিদা ও সরবরাহের ভিত্তিতে বিদ্যুতের দাম নির্ধারণ করা। তিনি মনে করেন, শুধু বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে ভর্তুকির চাম কমানো যাবে না। বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ কমিয়ে আনতে হবে। এ জন্য তিনটি পরামর্শ দেন তিনি। প্রথমত; বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর জ্বালানি তেল আমদানিতে সার্ভিস চার্জ ৯ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করা, যা এরই মধ্যে কার্যকর করা হয়েছে। দ্বিতীয়ত; যেসব প্রতিষ্ঠান থেকে বিদ্যুৎ কিনছে সরকার, তাদের নিয়মিত বিল পরিশোধ করা এবং তৃতীয়ত; বিদ্যুৎ খাতে অপচয় কমানো।
Sharing is caring!