প্রকাশনার ১৬ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

২০শে ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
৫ই পৌষ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
২৯শে জমাদিউস সানি, ১৪৪৭ হিজরি

গ্যাসে বড় সংকটের শঙ্কা

editor
প্রকাশিত আগস্ট ১৬, ২০২৫, ০৯:২৮ পূর্বাহ্ণ
গ্যাসে বড় সংকটের শঙ্কা

Manual5 Ad Code

 

প্রজন্ম ডেস্ক:

Manual5 Ad Code

দেশে গ্যাসের যে মজুদ আছে তা ক্রমাগত কমছে। নতুন কূপ খনন কার্যক্রমের গতিও ধীর। ফলে শিগগিরই নতুন কূপ আবিষ্কার এবং তা থেকে গ্যাস উৎপাদন শুরু করা অনেকটাই অনিশ্চিত। এর বিরূপ প্রভাব পড়েছে গ্যাস উৎপাদনে।

২০০ মিলিয়ন ঘনফুটেরও বেশি গ্যাস উৎপাদন কমেছে গত ১ বছরে। কয়েক বছর আগে দেশের সবচেয়ে বেশি প্রায় ১৫শ’ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদিত হতো বিবিয়ানা গ্যাস কূপ থেকে, তা এখন ৯০০ মিলিয়নের ঘরে নেমেছে। এর উৎপাদন যেকোনো সময় বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কমেছে অন্য কূপগুলোর উৎপাদনও।

অন্যদিকে বিদেশ থেকে উচ্চমূল্যে আমদানি করা এলএনজি সরবরাহের সক্ষমতা ১১শ’ মিলিয়ন ঘনফুটেই সীমাবদ্ধ। হঠাৎ করে দেশীয় কূপ থেকে গ্যাস উৎপাদন কমে গেলে গভীর সংকটের মুখোমুখী হবে দেশ। এলএনজি সরবরাহের সক্ষমতা সীমিত হওয়ায় আমদানি করা এলএনজি দিয়ে এই সংকট সামাল দেওয়া যাবে না। এমন অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে পেট্রোবাংলা নতুন কূপ খনন, নতুন এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণসহ নানা কার্যক্রমের ফিরিস্তি দিয়ে আশার বাণী শোনালেও বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা পোষণ করছেন।

Manual7 Ad Code

তারা বলছেন, ২০৩১ সালের আগেই মজুদ গ্যাস ফুরিয়ে যাবে। তার আগেই নতুন গ্যাস কূপ আবিষ্কারসহ নানা পদক্ষেপের মাধ্যমে গ্যাস সরবরাহ স্থিতিশীল রাখতে না পারলে গভীর সংকটে পড়বে দেশ।

পেট্রোবাংলার ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্যানুযায়ী, ২০২০ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি বহুজাতিক কোম্পানি শেভরন বাংলাদেশ ২৮টি কূপ থেকে ১৫১২ মিলিয়ন ঘনফুট সক্ষমতার বিপরীতে বেশি উত্তোলন করে। এদিন তারা ১৫৪৯ এমএমসিএফডি উত্তোলন করে। আর তাল্লো কোম্পানি ৫টি কূপ থেকে ১০৩ সক্ষমতার বিপরীতে ১০১ এমএমসিএফডি উত্তোলন করে। এদিন মোট সক্ষমতা ছিল ৩৭৬০ এমএমসিএফডি। এর মধ্যে ১ হাজার এমএমসিএফডি সক্ষমতা ছিল আরএলএনজি। তবে সেদিন মাত্র ৫৩৫ এমএমসিএফডি সরবরাহ করা হয়। তারপরও ৩১০৮ এমএমসিএফডি সরবরাহ করা সম্ভব হয়। এর কারণ তখন কূপগুলোতে গ্যাসের উপস্থিতি বেশি ছিল। সে জন্য সম্ভব হয়েছে।

২০২৩ সালের ১০ আগস্ট শেভরন কোম্পানি জালালাবাদ, মৌলভীবাজার ও বিবিয়ানার ৩৮টি কূপ থেকে উত্তোলন করেছে ১২৯১ এমএমসিএফডি গ্যাস। আর তাল্লো করেছে ৪৫ এমএমসিএফডি। এলএনজি ১ হাজারের বিপরীতে সরবরাহ করা হয়েছে ৬৯২। এদিন মোট উৎপাদিত হয়েছে ২৮৫৯ এমএমসিএফডি গ্যাস। এদিন ১২শ মিলিয়ন ঘনফুট সক্ষমতার বিপরীতে বিয়িয়ানা উত্তোলন করেছে ১১শ মিলিয়ন ঘনফুট। ৩ বছরের ব্যবধানে প্রতিদিন প্রায় ১৫০ মিলিয়ন ঘনফুট উৎপাদন কমে যায় বিবিয়ানার।

গেল বছরের ১০ আগস্ট শেভরনের উৎপাদন আরও কমেছে। এদিন ৩৮টি কূপ থেকে ১৫১২ এমএমসিএফডি গ্যাস উত্তোলন সক্ষমতার বিপরীতে উত্তোলন করেছে ১১৯৪ এমএমসিএফডি গ্যাস। এর মধ্যে দেশের সবচেয়ে বেশি উৎপাদিত বিবিয়ানা থেকে ১২শর বিপরীতে উত্তোলন করা হয়েছে ১০২২ এমএমসিএফডি গ্যাস। যা আগের বছরের চেয়ে প্রায় ৮০ মিলিয়ন ঘনফুট কম। আর তাল্লো ৫টি কূপ থেকে ১০৩ এমএমসিএফডি গ্যাস উত্তোলন সক্ষমতার বিপরীতে উত্তোলন করেছে মাত্র ৩৮ এমএমসিএফডি গ্যাস। এদিন ১১শ এমএমসিএফডি আরএলএনজি সরবরাহ সক্ষমতার বিপরীতে সরবরাহ করা হয়েছে মাত্র ৫৯৯ এমএমসিএফডি গ্যাস। এদিন মোট সরবরাহ করা হয়েছে ২৬৩৮ এমএমসিএফডি গ্যাস।

গত বৃহস্পতিবার শেভরন উত্তোলন করেছে মাত্র ৯০০ মিলিয়ন ঘনফুট, যা গত বছরের তুলনায় প্রায় ১২০ মিলিয়ন ঘনফুট কম। তাল্লো করেছে ৩৫ মিলিয়ন ঘনফুট। এই তথ্যচিত্রই বলে দেয় দেশের চাহিদার অর্ধেক সরবরাহকারী বিবিয়ানা উৎপাদন কীভাবে কমছে।

জ্বালানি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিবিয়ানা কূপের গ্যাস আরও আগেই শেষ হওয়ার কথা, এখনও শেষ না হওয়া আমাদের জন্য সুসংবাদ। পেট্রোবাংলার ২০২৩ সালের ৩০ জুনের রিপোর্ট অনুযায়ী, বিবিয়ানার অবশিষ্ট মজুদ বলা হয়েছে ১ টিসিএফ (ট্রিলিয়ন ঘনফুট)। এরপর আরও ২ বছর চলে গেছে, দৈনিক প্রায় ১ বিসিএফ করে গ্যাস উত্তোলন ধরা হলে ৭৩০ দিনের উত্তোলন শেষে অবশিষ্ট মজুদ ২০০ বিসিএফ থাকার কথা। সে হিসেবে আগামী বছর এই কূপ থেকে গ্যাস উত্তোলন বন্ধ হয়ে যাবে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দিন দিন চাহিদা বাড়ছে। এই বাড়ন্ত চাহিদার বিপরীতে যেখানে দেশীয় গ্যাসের উৎপাদন বৃদ্ধি হওয়ার কথা, সেখানে বর্তমান উৎপাদন অব্যাহত রাখাই বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিদেশি কোম্পানির কাছে থাকা ৪৩টি কূপের গ্যাস প্রায় শেষ পর্যায়ে। সরবরাহ ঠিক রাখতে তারা পাম্পের মাধ্যমে গ্যাস উত্তোলন করছে। যেকোনো সময় সরবরাহ বন্ধ হয়ে যেতে পারে। দেশীয় কোম্পানির কাছে থাকা ৭৩টি কূপ থেকে সবসময় সক্ষমতার চেয়ে কম গ্যাস উত্তোলন করা হচ্ছে।

গত বৃহস্পতিবার ১১১৪ মিলিয়ন ঘনফুট সক্ষমতার বিপরীতে উত্তোলন করা হয়েছে মাত্র ৭১০ মিলিয়ন ঘনফুট। আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়িয়ে এগুলো থেকে গ্যাস উত্তোলন বাড়ানোর দ্রুত উদ্যোগ নিতে হবে। চাহিদা মেটাতে ২০৩০ সাল পর্যন্ত দৈনিক অন্তত দেশীয় উৎপাদন ২০০০ মিলিয়ন রাখতে হবে, এ জন্য অনুসন্ধান জোরদার করার বিকল্প নেই। সমুদ্রে অনেক সম্ভাবনা রয়েছে, যত দ্রুত সম্ভব অনুসন্ধান শুরু করা উচিত। ভাসমান ২টি এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ এখনই শুরু করা উচিত।

তারা বলছেন, বিগত সরকারের সময়ে অনুসন্ধানে স্থবিরতার কারণেই আজকে এই করুণ পরিণতির মুখোমুখী বাংলাদেশ। অচিরেই দেশে গ্যাস সংকট দেখা দেবে তা দৃশ্যমান হলেও এখন পর্যন্ত ঘাটতি সামাল দেওয়ার উদ্যোগ দুর্বল। কারণ দেশীয় উৎপাদন কমলে এলএনজি আমদানি বাড়ানোর সুযোগ নেই। দুটি এলএনজি টার্মিনাল দিয়ে ১১শ মিলিয়ন ঘনফুট সরবরাহ করা হচ্ছে, আরও ১শ’ মিলিয়ন ঘনফুট সক্ষমতা বাড়ানো সম্ভব। ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল করলে চুক্তির পর ২ বছর লাগবে আর ল্যান্ডবেজ করলে লাগবে প্রায় ৭ বছর। এ ছাড়া আমদানির পরিমাণ ১৪০০ মিলিয়নের ওপরে হলে গভীর সমুদ্র থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত নতুন পাইপলাইন বসাতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন বড় বিনিয়োগ। ফলে সংকট সামাল দেওয়া কঠিন হবে।

পেট্রোবাংলা বলছে, সমীক্ষায় পাওয়া কূপে মজুদ থাকা গ্যাস একসময় শেষ হবে, এটা স্বাভাবিক। গ্যাস সংকট কাটাতে নতুন করে এক্সপ্লোরেশন, ড্রিলিং ও ওয়ার্কওভার কার্যক্রম চলছে। ৫০টি কূপ খনন কার্যক্রম ও ১শটি কূপের খনন কার্যক্রম চলছে। এর মধ্যে অনুসন্ধান ও উন্নয়ন কূপ ৬৯টি আর ৩১টি পুরোনো কূপের ওয়ার্কওভার। দুটি নতুন এলএনজি টার্মিনাল করা হবে। যত দ্রুত সম্ভব চুক্তি হবে, হলে নির্মাণ করতে ২ বছর সময় লাগবে। সেই দুটি দিয়ে ১২শ মিলিয়ন ঘনফুট সরবরাহ সক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। এসব উন্নয়ন কার্যক্রম সম্পন্ন হওয়ার আগে গ্যাস উৎপাদন কমে গেলে কিছুই করার থাকবে না। দেশে চাহিদানুযায়ী গ্যাস সরবরাহ করা যাচ্ছে না, উৎপাদন কমে গেলে সংকট আরও বাড়বে। গ্যাস অপচয় ও চুরি রোধ এবং সাশ্রয়ী হওয়ার জন্য নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন বলেন, আমাদের গ্যাসের মজুদ ৯ টিসিএফের (ট্রিলিয়ন ঘনফুট) নিচে নেমে গেছে। মজুদ কমে যাওয়ায় প্রতিদিনই গ্যাসের উৎপাদন কমতে থাকবে। আর যদি আবিষ্কার করতে না পারি, মজুদ ২০৩১ সালের মধ্যেই ফুরিয়ে যাবে।

তিনি বলেন, এর আগেই দেশে গ্যাস সংকট ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে। অনেক দিন ধরেই বিশেষজ্ঞরা এ কথা বলে আসছেন। কিন্তু বিগত সরকার তা কর্ণপাত না করায় আজকের আশঙ্কাজনক পরিস্থিতিতে আমরা পতিত হয়েছি। দেশীয় উৎপাদন ২০০০ মিলিয়ন রাখতে হলে অনুসন্ধান জোরদার করার বিকল্প নেই। এলএনজি আমদানির চেয়ে দেশীয় গ্যাস বেশি লাভজনক। সেদিকে নজর দিতেই হবে। আরও ২টি ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল স্থাপন জরুরি। না হলে বিপর্যয় ঠেকানো কঠিন হবে।

Manual6 Ad Code

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পেট্রোবাংলার পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড মাইন্স) প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম বলেন, গ্যাস রিজার্ভারের একটা পরিমাণ রয়েছে। গ্যাস তুলতে তুলতে একটা সময়ে কমে শেষ হয়ে যাবে। আজীবন চলবে না। এটা ফোরকাস্ট করা আছে। বিবিয়ানা এক সময় ১৪ থেকে ১৫শ মিলিয়ন উৎপাদন করত, এটা আস্তে আস্তে কমে এখন ৯শর কিছু বেশি উৎপাদন করছে। জালালাবাদ বিবিয়ানা মিলিয়ে হাজার পঞ্চাশের মতো দিচ্ছে। এটা একটু ডিক্লারমিং, আরও কমে যাবে।

তিনি বলেন, সংকট কাটাতে নতুন করে এক্সপ্লোরেশন, ড্রিলিং ও ওয়ার্কওভার কার্যক্রম চলছে। ৫০টি কূপ এবং ১শ কূপ খনন করার কার্যক্রম নেওয়া হয়েছে। কিছু কাজ চলছে, সামনে কিছু কাজ হবে। এ ছাড়া ২টি এলএনজি টার্মিনাল করার প্রক্রিয়া চলমান। সেটা হলে আরও ১২শ মিলিয়ন এলএনজি সরবরাহ করা যাবে। যতদ্রুত সম্ভব করার চেষ্টা চলছে। চুক্তি হওয়ার পর দুই বছর লাগবে।

Manual3 Ad Code

আমাদের যে ক্যাপাসিটি আছে তার মধ্যেই সরবরাহ করা হবে সরকার সেভাবেই চেষ্টা করবে। কিছু কিছু গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে, এখনও অনেক বড় আকারে পাওয়া যায়নি। সমীক্ষার ওপর নির্ভর করেই কার্যক্রম চালানো হয়েছে। মাটির নিচের বিষয় তো কেউ বলতে পারবে না। খনন করার পর জানা যাবে।

পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান রেজানুর রহমান বলেন, আমরা দেশীয় গ্যাসের উত্তোলন ও অনুসন্ধান জোরদার করেছি। নতুন করে আরও দুটি রিগ কেনা হচ্ছে। আশা করছি দেশীয় উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব হবে।

Sharing is caring!

Manual1 Ad Code
Manual7 Ad Code