প্রকাশনার ১৬ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

২১শে ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
৬ই পৌষ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
১লা রজব, ১৪৪৭ হিজরি

১৪ হাজার ক্লিনিক থেকে বছরে ১৬ কোটি প্রান্তিক মানুষের সেবা

editor
প্রকাশিত আগস্ট ১৯, ২০২৫, ১১:২০ পূর্বাহ্ণ
১৪ হাজার ক্লিনিক থেকে বছরে ১৬ কোটি প্রান্তিক মানুষের সেবা

Manual3 Ad Code

 

প্রজন্ম ডেস্ক:

Manual8 Ad Code

দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের ৭০ শতাংশের বেশি মানুষ ইউনিয়ন পর্যায়ে নির্মিত কমিউনিটি ক্লিনিকের ওপর নির্ভরশীল। ১৪ হাজার ক্লিনিক থেকে বছরে ১৬ কোটি মানুষ সেবা নিচ্ছে। পাচ্ছে ২২ ধরনের ওষুধ। নতুন করে দেওয়া হচ্ছে উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের ওষুধ।

কমিউনিটি ক্লিনিককে আরও বেশি কার্যকর করতে নতুন বেশকিছু উদ্যোগ নিয়েছে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার। ইতিমধ্যেই ক্লিনিকে কর্মরত কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার বা সিএইচসিপিদের চাকরি রাজস্ব খাতে নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। বাকি উদ্যোগগুলো কার্যকর হলে এসব ক্লিনিক থেকেই রোগী রেফারেল সিস্টেম চালু হবে। প্রান্তিক মানুষ চিকিৎসার শুরুতেই তার রোগ শনাক্ত করতে পারবেন। সপ্তাহে দুই দিন দুই জন করে চিকিৎসক বসবেন কমিউনিটি ক্লিনিকে। তারা অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত রেফারেল রোগী দেখবেন।

এমনকি শুধু রোগের চিকিৎসায় নয়, রোগ প্রতিরোধ ও স্বাস্থ্যের উন্নয়ন নিয়ে বেশি কাজ করার পরিকল্পনাও নেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্ট প্রবিধানমালা তৈরি ও নতুন করে কমিউনিটি ক্লিনিক সহায়তা ট্রাস্ট পুনর্গঠনের কাজ চলছে। প্রবিধান হলে ক্লিনিকে কর্মরত কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার বা সিএইচসিপিদের উপজেলা ও জেলা পর্যায় পর্যন্ত পদায়ন করা যাবে। আর ট্রাস্টের নতুন বোর্ড ক্লিনিকে কর্মরতদের বেতন ও অন্যান্য সুবিধাদি নিশ্চিতে কাজ করতে পারবে।

কমিউনিটি ক্লিনিকে কর্মরত সিএইচসিপি, সহায়তা ট্রাস্টের কর্মকর্তা এবং ক্লিনিক পুনর্গঠনের সঙ্গে যুক্ত চিকিৎসক কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে দেশের কমিউনিটি ক্লিনিকের এই চিত্র পাওয়া গেছে।

অবশ্য এসব লোকজন কমিউনিটি ক্লিনিকের বেশ কিছু সংকটের কথা বলেছেন। তারা জানান, প্রশাসনিক জটিলতার কারণে গত ১৪ মাস ধরে বেতন পাচ্ছেন না ৬৭১ জন সিএইচসিপি। সাড়ে পাঁচ মাসের বেতন বকেয়া রয়েছে ১৩ হাজার ৮৬১ জন সিএইচসিপির। প্রবিধান না থাকায় তাদের চাকরির সুরক্ষা নেই। এসব নিয়ে তারা ভীষণ হতাশ।

Manual7 Ad Code

এমন অবস্থায় কমিউনিটি ক্লিনিককে আরও কার্যকর ও শক্তিশালী করতে আগামীকাল বুধবার রাজধানীতে এক সেমিনারের আয়োজন করেছে কমিউনিটি ক্লিনিক সহায়তা ট্রাস্ট। সেখানে কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণে নানা বিষয় আলোচনা হবে।

এ বিষয়ে কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আখতারুজ্জামান বলেন, দেশে স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় গত ৫৩ বছরে স্বাস্থ্য খাতে বড় সংস্কার এই কমিউনিটি ক্লিনিক। কারণ এটা শুধু ইউনিয়ন নয়, একেবারে ওয়ার্ড লেভেলেও স্বাস্থ্যসেবা। বাংলাদেশের ৭০ শতাংশ মানুষকে এখান থেকে প্রাথমিক বা প্রান্তিক স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হয়। জ্বর, সর্দি, কাশি, পেটের অসুখ, চুলকানিÑ এ ধরনের রোগের চিকিৎসা পান।

এই কর্মকর্তা আরও বলেন, আমরা রুট লেভেলে যদি স্বাস্থ্যসেবা দিতে পারি, তা হলে স্বাস্থ্যসেবায় একটা বড় পরিবর্তন আসবে। কারণ আমরা ক্লিনিক বা হাসপাতালে যেতে চাই না, আমরা সুস্থ থাকতে চাই। এটাই আমাদের লক্ষ্য।

বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের শিশু সার্জারি বিভাগের অধ্যাপক ডা. এস এম খালিদ মাহমুদ শাকিল বলেন, প্রান্তিক মানুষের দ্বারে দ্বারে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে চাইলে ক্লিনিকের সেবাটা নিশ্চিত ও আরও শক্তিশালী করতে হবে। এটা পুনর্গঠন করতে হবে। কারণ কমিউনিটি ক্লিনিক শক্তিশালী হলে আমাদের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, অর্থাৎ একদম অজপাড়া গাঁয়ের মানুষকে চিকিৎসার জন্য অন্য কোথাও যেতে হবে না। এটা শক্তিশালী হলে গোটা দেশের মানুষের রোগের প্রাথমিক স্ক্রিনিং এখান থেকেই শুরু করা সম্ভব। সেটা করা গেলে ভবিষ্যৎ জটিলতা থেকে মুক্তি পেতে পারে। কমিউনিটি ক্লিনিকে চিকিৎসা না হলে রোগীকে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে পাঠানো হবে। সেখানেও না হলে পাঠানো হবে জেলাপর্যায়ে হাসপাতালে। অর্থাৎ কমিউনিটি ক্লিনিককে শক্তিশালী করা গেলে এখান থেকেই চিকিৎসাসেবার বিভিন্ন তার খুলে যাবে।

সেবা পাচ্ছে ১৬ কোটি মানুষ : কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আখতারুজ্জামান বলেন, এখানে আরেকটি বড় ঘটনা হলো এই ক্লিনিক থেকে প্রেসার বা ডায়াবেটিস শনাক্ত করে দেয়। ফলে গ্রামের মানুষ এসব রোগের চিকিৎসার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এসব ক্লিনিকে ২২ ধরনের ওষুধ দেওয়া হচ্ছে। বিশেষ করে এখানকার রেফারেল সিস্টেম খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ কোনো রোগীর যদি রোগ শনাক্ত করা যায়, তা হলে এই ক্লিনিক থেকেই সংশ্লিষ্ট হাসপাতালে পাঠানো হয়।

এই কর্মকর্তা বলেন, আমাদের টার্গেট গ্রুপ গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলের দরিদ্র মানুষ। এই লোকগুলোকে বিনাপয়সায় চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। এই সংখ্যা ১৬ কোটি। প্রত্যন্ত অঞ্চলের এই ১৬ কোটি মানুষকে স্বাস্থ্যসেবা দিতে পারাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

এই কর্মকর্তা আরও বলেন, সরকার ২০১৮ সালে যে ট্রাস্ট গঠন করেছে, এটা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অধীনে ছিল। অধিদপ্তর তাদের অধীনস্থ ৩৭ হাজার চিকিৎসক নিয়ে নিজেরাই অচল অবস্থার মধ্যে আছে। উপজেলায় চিকিৎসক নেই, ইউনিয়নে তো নেই-ই, জেলাতেও নেই। চিকিৎসকরা শুধু ঢাকায় থাকতে চান। সেটাই অধিদপ্তর ম্যানেজ করতে পারছে না। তার ওপর তারা প্রাইমারি স্বাস্থ্যসেবাকে ম্যানেজ করতে চায়। সেটা কি করে সম্ভব? এখানে চিকিৎসক দরকার নেই। এখানে স্বাস্থ্যসেবায় প্রশিক্ষিত একজন দক্ষ স্বাস্থ্যকর্মী দরকার। যে মানুষকে গাইড দেবেন স্বাস্থ্যসেবা সম্পর্কে। তারা নরমাল ডেলিভারিকে উৎসাহিত করবে।

Manual6 Ad Code

বেতন নেই ১৪ মাস : হবিগঞ্জ সদর উপজেলা কমিউনিটি ক্লিনিকের সিএইচসিপি এবং হবিগঞ্জ জেলা বাংলাদেশ সিএইচসিপি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও একই অ্যাসোসিয়েশনের সিলেট বিভাগের সিনিয়র সহ-সভাপতি আব্দুর রশীদ বলেন, ৫ আগস্ট- এর পর থেকে কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো ভালই চলছে। বিগত সরকার আমাদের নিয়োগ দেওয়ার পর চাকরি স্থায়ীকরণ বা গ্রেড যুক্ত করা ও ইনক্রিমেন্ট দেওয়া এগুলো এই সরকার করছে। গত নভেম্বরে চাকরি স্থায়ীকরণের নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে ট্রাস্টের অনুকূলে রাজস্ব খাতে নেওয়ার জন্য। সারা দেশে মোট কমিউনিটি ক্লিনিক ১৪ হাজার ও ১৩ হাজার ৯৬১ জন সিএইচসিপি। কিন্তু ২০২২ সালে নিয়োগ পাওয়া ৬৭১ জন সিএইচসিপির বেতন ১৪ মাস ধরে বন্ধ প্রশাসনিক জটিলতার কারণে। আর আমরা যারা পুরনো ১৩ হাজার ৮৬১ জন সিএইচসিপির বকেয়া বেতন রয়েছে পাঁচ মাসের। তারা এখন বেতন পাচ্ছেন ১৬ হাজার টাকার মতো। ফলে বেতন না পাওয়ায় সিএইচসিপিদের মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে।

ট্রাস্ট চাইলে বেতন দিতে পারে : কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্টের সভাপতি ও স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশনের সদস্য ড. আবু মুহাম্মদ জাকির হোসেন বলেন, কমিউনিটি ক্লিনিক বন্ধ হবে না। বরং এটাকে পুনর্গঠন করা হচ্ছে।

এই কর্মকর্তা বলেন, যে সব সিএইচসিপির বেতন আটকে আছে, ট্রাস্টের পক্ষ থেকে আমরা বেতন দেওয়ার জন্য চিঠি দিয়েছি। অর্থ মন্ত্রণালয় কিন্তু সবার জন্য বেতন ছেড়ে দিয়েছে। এখন যেহেতু বোর্ড নেই, তাই বেতনের বিষয়টি সমাধান করা যাচ্ছে না। এখন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বেতন দিতে গড়িমসি করছে। ট্রাস্ট চাইলে এখন বেতন দিতে পারে। ট্রাস্টের সব কাজই চলছে শুধু বকেয়া বেতন দিচ্ছে না। অথচ বেতনের সব প্রক্রিয়া শেষ, অর্থ মন্ত্রণালয় ইতিমধ্যেই টাকা ছাড় করে দিয়েছে সবার জন্য। এখন ট্রাস্ট চাইলে বেতন দিতে পারে।

এই কর্মকর্তা আরও বলেন, আমি বলি ট্রাস্ট ভেঙে দিতে। ট্রাস্ট থাকার কোনো প্রয়োজন নেই। কমিউনিটি ক্লিনিকে যারা কাজ করেন তারা প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যার কর্মচারী। সেখানে স্বাস্থ্য সহকারী, পরিবার কল্যাণ সহকারী ও সিএইচসিপি আছেন। এই তিন জন মিলে একত্রে কাজ করার কথা। কিন্তু ট্রাস্ট করে এদের ভেঙে আলাদা করে দেওয়া হয়েছে। ফলে তাদের কোনো জবাবদিহিতা নেই।

Manual1 Ad Code

চাপ বেড়েছে মানুষের : আব্দুর রশীদ জানান, ১৯৯৮ সালে যখন কমিউনিটি ক্লিনিক তৈরি হয় তখন প্রতি ৬ হাজার জনসংখ্যার জন্য একটি ক্লিনিক ছিল। সে অনুযায়ী প্রতি ইউনিয়নে তিনটি কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপিত হওয়ার কথা। কিন্তু এখন প্রতি ১০ হাজারের বেশি মানুষের জন্য একটি ক্লিনিক হয়েছে। অর্থাৎ চাপ বেড়েছে। চাপ সামাল দিতে সরকার আরও চার হাজার ক্লিনিক নির্মাণ করার পরিকল্পনা করেছে।

এই সিএইচসিপি বলেন, কমিউনিটি ক্লিনিক বন্ধ হওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই। বছরে ১৫ কোটির বেশি মানুষ ১৫ কোটি বার সেবা নেয়, যা মোট জনগোষ্ঠীর ৭০ শতাংশ। এখন ২২ ধরনের ওষুধ দিচ্ছে। আগে এন্টিবায়োটিক দিত। এখন এন্টিবায়োটিক বন্ধ করে হাই প্রেসার ও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের জন্য ওষুধ দিচ্ছে। নতুন সরকার আসার পর কারও চাকরি যায়নি নতুন কোনো নিয়োগও হয়নি।

এই কমিউনিটি ক্লিনিক নেতা বলেন, আমাদের দাবি হচ্ছে বকেয়া বেতনগুলো ছাড় দিতে হবে। এখন পর্যন্ত কোনো অর্গানোগ্রাম হয়নি। ট্রাস্ট চলমান করার জন্য যে প্রবিধান দরকার, এই প্রবিধান দ্বারা আমাদের চাকরি সুরক্ষা ও নিয়ন্ত্রিত হবে। সেই প্রবিধান দীর্ঘদিন ধরে হচ্ছে না। এ কারণে আমরা হতাশায় আছি।

সেবা পাচ্ছেন ৬ দিন : সিএইচসিপিরা জানান, সরকারি ছুটির দিন ব্যতীত সপ্তাহে ৬ দিন (শনিবার হতে বৃহস্পতিবার) সকাল ৯ টা হতে বিকেল ৩ টা পর্যন্ত কমিউনিটি ক্লিনিক খোলা থাকে। কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার (সিএইচসিপি) প্রতি কর্মদিবসে কমিউনিটি ক্লিনিকে উপস্থিত থেকে সেবাপ্রদান করেন এবং সিএইচসিপির পাশাপাশি স্বাস্থ্য সহকারী ও পরিবারকল্যাণ সহকারী প্রত্যেক সপ্তাহে ন্যূনতম ৩ দিন করে (পূর্ব পরিকল্পনা অনুসারে) কমিউনিটি ক্লিনিকে সেবা প্রদান করেন।

Sharing is caring!

Manual1 Ad Code
Manual7 Ad Code